দৈনিক দিনকাল.নেট
আবার গাজায় ইসরাইলি তান্ডব
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ জুন,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৪৭ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
সাম্প্রতিক সময়ে গাজা যুদ্ধে ব্যর্থ হয়ে পরাজিত ইসরাইলি সেনারা গাজা উপত্যকায় বিমান হামলা চালিয়েছে । গত শুক্রবার আল আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে মুসল্লিরা মিছিল বের করলে ইসরাইলি সেনারা গুলি চালায়। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের বিদায়ের মধ্যদিয়ে ক্ষমতার ভাগাভাগি'র মাধ্যমে উগ্র ডানপন্থী ইয়ামিনা পার্টির নেতা নাফতালি বেনেতের ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর দয়িত্ব নেওয়ার পর উগ্র ইহুদিবাদীদের পতাকা মিছিলের ইস্যুতে ফের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। কট্টর ইহুদিদের দ্বারা অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে পতাকা মিছিলের ঘোষণাকে ঘিরে এ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর পরই কট্টর ইহুদিদের এই ধরনের পতাকা মিছিলের অনুমতি দিয়েছে নতুন সরকার। এই পতাকা মিছিলের মাধ্যমে উগ্র ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনিদের সমূলে উচ্ছেদের আহ্বান জানানোর চেষ্টা করছে। ইহুদিদের এই পতাকা মিছিলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠনগুলো কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের কমান্ডাররা পতাকা মিছিলের প্রতিক্রিয়ায় হুঁশিয়ার করে বলেছেন, ইসারাইলের যে কোন ক্ষুদ্র ভুলের প্রতিশোধ নিতে তারা বড় ধরনের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। তাছাড়া উগ্র ইহুদিবাদীদের পতাকা মিছিল মোকাবিলায় ফিলিস্তিনিদের মসজিদুল আকসায় সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদ আন্দোলন ও ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। তাদের মতে পতাকা মিছিল আয়োজন উসকানিমূলক ও বিপজ্জনক পদক্ষেপ। এই অবস্থায় ইহুদিদের পতাকা মিছিল আর একটি যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। এর আগে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিন মুসলমানদের ওপর দীর্ঘ ১১ দিন নির্বিচারে সর্বাত্মক হামলা চালিয়ে অবশেষে ২০ মে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করেছে। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক তৎকালিন মন্ত্রিসভা কমিটির বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, মিশরের প্রস্তাবে যুদ্ধ বিরতিতে তারা সম্মত এবং এই যুদ্ধবিরতি হবে পারস্পারিক ও নিঃশর্ত। এদিকে মিশরের উদ্যোগে কোন পূর্বশর্ত ছাড়াই গত ২০ মে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও ইসরাইলি বাহিনী এই যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার পর যুদ্ধে বিধ্বস্ত গাজাবাসী ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে বিজয় উৎসব পালন করেছিল।
১৯৪৭ সালে ইসরাইল- ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব শুরু করার পর থেকে নানা কৌশলে ইসরাইলি ইহুদিবাদী সরকার ফিলিস্তিনে অবৈধ বসতি স্থাপনের মাধ্যমে দখল করতে করতে ফিলিস্তিনকে একটি ছোট ভূখন্ডে পরিণত করে ফেলেছে । তারপরেও থেমে থামেনি। গত ২৫ এপ্রিল ইসরাইলি একটি আদালতের আদেশের অজুহাতে অধিকৃত জেরুজালেমের শেখ জারবাহ মহল্লা থেকে ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ শুরু করলে এর প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা ব্যাপক বিক্ষোভ করে। এই বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে ইসরাইলি বাহিনী কয়েক দফা মসজিদুল আকসায় হামলা চালায়। ৭ মে থেকে ১০ মে পর্যন্ত এসব হামলায় এক হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়। মসজিদুল আকসায় মুসল্লিদের ওপর ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ১০ মে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে মসজিদ থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে ইসরাইলকে আলটিমেটাম দেয়। আলটিমেটাম শেষ হওয়ার পর গাজা থেকে ইসরাইলের বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে রকেট হামলা শুরু করে হামাস। এই অবস্থায় গত ১০ মে থেকে গাজায় ব্যাপক ভাবে বিমান ও কামান হামলা শুরু করে দখলদার সন্ত্রাসী ইসরাইলি বাহিনী। জবাবে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী গাজা থেকে ইসরাইলি ভূখন্ডে ৪ হাজার ৩ শত ৬০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে হামাস। অপরদিকে ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনিদের বেশ কিছু আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। এতে ২৩৩ জন ফিলিস্তিনি শাহাদৎবরণ করেছে। এর মধ্যে ৬৫ জন শিশু এবং ৩৯ জন নারী রয়েছে। আহত হয়েছে এক হাজার ৯০০ জন। এ হামলায় ফিলিস্তিনের প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ তাদের বসতবাড়ি বা আশ্রয় হারিয়েছে।একই সময়ে হামাসের রকেট হামলায় ইসরাইলে নিহত হয়েছে ২ শিশু, ১ সেনা সহ ১২ জন। আহত হয়েছে ৭ শ' ৯৬ জনের বেশি মানুষ। ইসরাইলি এ হামলায় সবছেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু।
ফিলিস্তিনের শিশুরা এমন বীরত্বপূর্ণ ভাগ্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে যে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই মাতৃভূমি রক্ষায় লড়াই, সংগ্রাম এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। কারণ বাঁচতে হলে লড়তে হবে। ফলে অনেক ফিলিস্তিনি শিশু- কিশোরকে দেখা যায় সশস্ত্র দখলদার ইহুদি বাহিনীর সামনে পাথর খন্ড নিয়ে রুখে দাঁড়াতে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে পাথর ছুঁড়ে প্রতিবাদ জানাতে। ফিলিস্তিনের শিশুরা জন্মের সাথে সাথে আজানের ধ্বনি'র পরিবর্তে শুনে জঙ্গি বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র আর বিমান থেকে ফেলা বোমার গর্জন । চোখ মেলে তাকালে দেখতে পায় ধ্বংস¯ূÍপের মধ্যে পিতা, মাতা, আত্মীয়- স্বজনের রক্তাক্ত বীভৎস্য ক্ষতবিক্ষত দেহ । এখানেই শেষ না, বর্বর দখলদার ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে নির্বিচারে নারী ও শিশুদের তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতন করছে। শিশুরা রাতে পিতা- মাতার সাথে ঘুমিয়ে থাকে, কিন্তু হঠাৎ বিকট শব্দে তারা জেগে উঠলে দেখতে পায় সবকিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। কেউ তার সাথে নেই। ইসরাইলিদের বর্বরোচিত নির্বিচার বিমান হামলায় পরিবারেব সদস্যরা শাহাদৎবরণ করেছে। তাদের নির্মম নির্যাতনে সম্ভবত ফিলিস্তিনের এক শিশু আর্তনাদ করে বলেছিল, আমি আল্লাহ্েক সব বলে দিবো। পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা হলো পশ্চিমা ইয়াহুদীদের দ্বারা অবৈধভাবে দখল হয়ে যাওয়া একটি এলাকা। ১০ মে শুরু হওয়া ইসরাইল ফিলিস্তিনের যুদ্ধের ১১ দিন পর ২০ মে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও থেমে থাকেনি ইহুদিদের চক্রান্ত, নির্যাতন। তারা চুক্তির প্রতি খুব একটা সম্মান দেখাচ্ছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন অজুহাতে প্রতিদিনই তারা পশ্চিম তীরের শহরগুলোতে আগ্রাসন চালাচ্ছে। পবিত্র জেরুজালেম আল- কুদস থেকে ফিলিস্তিনি বাসীকে উদ্বাস্তু করে দেয়ার হুমকি দিয়ে চলেছে। সুযোগ পেলেই গ্রেফতার করছে ফিলিস্তিন শিশু ও যুবকদের। হামলা করছে ফিলিস্তিনি জনগন ও স্বাধীনতাকামী সংগঠন সমূহের ওপর। যুদ্ধ বিরতির পর অতিসম্প্রতি ইসরাইলি বাহিনী অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ডের পশ্চিম তীরের জেনিনে এক গুপ্ত অভিযান পরিচালনা করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএল) অধীন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর দুই কর্মকর্তাসহ ৩ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে। নিহত ৩ জনের মধ্যে ক্যাপ্টেন তায়সিন ইসা (৩২) ও লেফটেন্যান্ট আদহাম (২৩), অপর নিহত ব্যক্তি জামিল আল- আমুরি। তিনি ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইসলামি জিহাদের সামরিক শাখা আল-কুদস ব্রিগেডের সদস্য বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কাজেই চরিত্রগত কারণেই ইসরাইলের বিশ্বাস নেই, যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে যুদ্ধবিরতি। ইহুদিবাদী ইসরাইলি সরকার তাদের অবৈধ দখলদারি বসতী সম্প্রসারণ করতে কিংবা ইহুদিবাদী সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার কারণে অথবা যে কোনো অজুহাতে পশ্চিম তীরে ও গাজায় হামলা চালাতে পারে।
ইসরাইলি পত্রিকাতেই বলা হচ্ছিল- শেখ জাররাহ এলাকায় ফিলিস্তিনি বাড়িঘর উচ্ছেদ এবং আল-আকসায় নামাজিদের ওপর হামলা থেকে ফিলিস্তিনিদের সাথে যুদ্ধ শুরু হবে সেটি জেনেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডা থেকেই এই কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি ভেবেছেন, এই যুদ্ধের মাধ্যমে যদি হামাসের প্রতিরোধ ক্ষমতা গুঁড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে তিনি যে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়েছেন সেই সুযোগ আবার তার হাতে ফিরে আসবে এবং ডানপন্থী ইহুদি দলগুলো তাকে ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে আবার সমর্থন দেবে। ১৯৬৭ সালে আরব- ইসরাইলের মধ্যে সংঘটিত ৬ দিনের যুদ্ধের পর ইসরাইল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। ১৯৮০ সালে ইসরাইল পুরো শহরটি ইসরাইলের সাথে যুক্ত করে নেয় এবং দখলকৃত শহরটিকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে।
লেখক : অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ শাহ্ আলম, কলামিস্ট ও আইনজীবী