দৈনিক দিনকাল.নেট
বেগম খালেদা জিয়া : মানচিত্রে মিশে থাকা নাম
প্রকাশ: ০২:৪৮ এএম, ৯ সেপ্টেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০২:১২ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যায়ে তখন। চারদিকে ধ্বংস আর ধ্বংসাবশেষ। প্রলয়ঙ্করি এমনই এক সময়ে ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদার দম্পতির কোলজুড়ে নতুন ভোরের দীপ্তি নিয়ে আগমন করেন খালেদা খানম পুতুল। সময়ের পরিক্রমায় বাবা-মায়ের আদরের সেই পুতুলই বর্তমান বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সমার্থক দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। ১৯৬০ সালে তৎকালীন ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সেই থেকে দিনাজপুরের এক অরাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে খালেদা খানমের বাংলাদেশের রাজনীতি ও ইতিহাসের সঙ্গে যুগপৎ পথচলা শুরু। দিনে দিনে বাংলার আপামর জনতার আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক, সুখ-দুঃখের সারথি বনেছেন। মানষু তাঁকে ভালবেসে দেশনেত্রী উপাধিতে ভূষিত করছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অন্যায়ের সাথে কখনো আপোস করেননি। তাই তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আপোসহীনতার প্রতীক। গণতন্ত্রের জন্য তাঁর দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম তাঁকে ভূষিত করেছে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসী’ খেতাবে। তবে তাঁর এই দেশনেত্রী বা মাদার অব ডেমোক্রেসী হয়ে উঠার পথ কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রথম লগ্ন থেকেই বেগম খালেদা জিয়ার কণ্টকাকীর্ণ পথচলা শুরু। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে অভিভাবকহীন দিশেহারা জাতির জন্য যখন আলোকবর্তিকা হয়ে জিয়াউর রহমানের অভ্যুদয় ঘটলো তখন থেকেই বেগম জিয়ার সংগ্রামী জীবনের সূচনা। দেশমাতৃকার টানে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। ‘আই রিভল্ট’ বলে বিদ্রোহের সূচনা করেন এবং মহান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে পরিবার পরিজন রেখে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দুই শিশুপুত্র নিয়ে সেই অনিশ্চিত ও ঘোরতর অমানিশার মাঝে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। কিছুদিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে সেখান থেকে বড় বোন খুরশিদ জাহান হকের সাথে যোগযোগ করে দুই সন্তানসহ লঞ্চযোগে ১৬ মে ১৯৭১ নারায়ণগঞ্জে পৌঁছান। তবে তিনি বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পাবেননি। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয়ের চেষ্টাকালে পাক বাহিনী তাঁর সন্ধান পেয়ে যায় এবং ২রা জুলাই এস কে আব্দুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসভবন থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৬ ডিসেম্বর- ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি সামরিক হেফাজাতে বন্দিজীবন কাটান।
পাক বাহিনীর দীর্ঘ জুলুম, নির্যাতন ও অপশাসন থেকে মুক্তিলাভের পর জিয়া সামরিক শৃঙ্খলা মেনে ব্যারাকে ফিরে যান এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পুর্গঠনে নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে থাকেন ৷ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ১৯৭৫ সালের ঘটনাবহুল পরিক্রমার মধ্য দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা জিয়া জনতার জিয়ায় পরিণত হন। ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জিয়া শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনকালে বেগম খালেদা জিয়া সব সময়ই পাদপ্রদীপের পেছনে ছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করে একজন আপাদমস্তক গৃহবধূ হিসাবে অনাড়ম্বর জীবনযাপন করছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে তিনি স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন দেশে সফর করেছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও স্বামী জিয়ার দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, নেতৃত্বদানের বলিষ্ঠতা বেগম জিয়ার মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাই তো ১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় দুষ্কৃতকারীর বুলেটের আঘাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাদাতবরণের পর তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনের দায়িত্বভার গ্রহণ করে সফলতার সাথে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলছেন বাংলার এই অবিসংবাদিত কিংবদন্তী।
১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে কতিপয় বেপথু সেনাসদস্যের গুলিতে প্রেসিডেন্ট জিয়া শাহাদতবরণ করলে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-তে অন্তকলহ প্রকট হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় প্রয়োজন ছিল সর্বজনে গ্রহণযোগ্য একজন নেতা, যিনি শহীদ জিয়ার দেখানো পথে তাঁর প্রবর্তিত আদর্শকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দলকে পরিচালিত করতে পারবেন। নিভৃতচারী বেগম খালেদা জিয়াই ছিলেন সেই আইকনিক ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন বিএনপি নেতৃবৃন্দের অনুরোধে তিনি শহীদ জিয়ার অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তারিখে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। সেই থেকে তাঁর বিপ্লব ও সংগ্রামের সূচনা। ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বিচারপতি আবদুস সাত্তার অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন এবং এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
১৯৮৩ সাল থেকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি রাজপথে জনতার কাতারে নেমে এসে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনসমূহ এরশাদের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। নব্বই দশকে সেই স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে অনেকেই সমঝে চলার নীতি গ্রহণ করলেও বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কোন আপস করেননি। এর ফলে বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করল। একাধিকবার তিনি স্বৈরাচারী এশাদ সরকারের রোষানলে পড়েন। তাঁকে মোট চারবার ১৯৮৩ সালের ২৮শে নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩রা মে এবং ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর আটক করা হয়। ১৯৮৭ সালে হোটেল পূর্বাণী থেকে আটক করে আরও কয়েকজন নেতাসহ তাঁকে মতিঝিল থানায় নেয়া হয়। তবে সে সময় পুলিশ তাকে জেলে পাঠায়নি। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় তাঁকে এক প্রকার গৃহবন্দী করে রাখা হয়। কিন্তু তিনি দমে যাননি। সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য তিনি সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বার বার দীপ্তি ছড়িয়েছেন। অতঃপর দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে নব্বইয়ের ছাত্র-জনতার প্রবল গণঅভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। জনগণের মুক্তির জন্য আপোসহীন সংগ্রামী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের রায়ে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালের ১৯শে মার্চ শপথ গ্রহণ করেন। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তাঁকে শপথ বাক্য পাঠ করান। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে বিএনপি আরো দুইবার বিজয় লাভ করে। ২০০১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
গণতন্ত্রের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রাম আজোবধি অব্যাহত রয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের মতই আধিপত্যবাদী ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি বার বার তাঁর ওপর খড়গহস্ত হয়েছে। ২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়েও তাঁকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়েছে। রাজনীতি থেকে তাঁকে মাইনাস করে দেয়ার এক নীলনকশা প্রস্তুত করছিল এক-এগারোর অবৈধ সরকার। নানারূপ হমকি-ধমকি, প্রলোভন দেখিয়েও তাঁকে দেশ ছাড়া করা সম্ভব হয়নি। এদেশের মানুষের সাথেই তিনি নিজের ভাগ্যকে মিলিয়ে নিয়েছেন। বর্তমানে বৃদ্ধাবস্থায় এসেও অবরুদ্ধ গণতন্ত্রের মুক্তির পক্ষে কথা বলার কারণে তাঁকে বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী থাকতে হাচ্ছে। কিন্তু তিনি হার মানেন নি, আধিপত্যবাদী শক্তির আগুনসদৃশ লালচোখের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি গণতন্ত্রের, জাতীয় ঐক্যের, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের কথা বলেছেন। ২০১৭ সালে বকশিবাজরের বিশেষ আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, “এদেশের গতি -প্রকৃতির সাথে আমার নাম লেখা হয়ে গিয়েছে।” ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবরণের আগের দিন তিনি এক বার্তায় বলেন, ‘কম বয়সে স্বামীকে হারিয়েছি। দেশের জন্য জিয়াউর রহমান জীবন দিয়েছেন। কারাগারে থাকতে আমি আমার মাকে হারিয়েছি। অফিসে অবরুদ্ধ থাকা অবস্থায় একটি সন্তান হারিয়েছি। আরেকটি সন্ত্রাস দূরদেশে চিকিৎসাধীন। আমার স্বজনহীন জীবনে দেশবাসীই আমার স্বজন। আমি যেমন থাকি, যেখানেই থাকি, যতক্ষণ বেঁচে থাকবো দেশবাসীকে ছেড়ে যাবো না।’ প্রকৃত অর্থেই তিনি এ দেশের দেশপ্রেমিক আপামর জনতার আস্থা ও বিশ্বাসের মূল কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। ১৯৯১ সালে আধিপত্যবাদী শক্তির দোসরদের বিপরীতে সগর্বে মাথা উঁচু করে বেগম খালেদা জিয়া উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ওদের হাতে গোলামির জিঞ্জির; আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা।’ এই ভয়ডরহীন আত্মমর্যাদাবোধই তাঁকে রাজনীতির উচ্চাসনে আসীন করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের গেঁথে দেয়া বুনিয়াদের উপর দাঁড়িয়ে একটি সার্বভৌম মর্যাদাসম্পন্ন, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় তাঁর মাঝে রয়েছে, তা আর কোন রাজনৈতিক নেত্রীত্বের মাঝে মেলা ভার। ভূরি ভূরি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, গালগল্পের ভিড়ে বেগম জিয়ার ‘দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও’-এই একটি বাক্যই দেশ ও জনগণের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতির বর্ণনা দিতে যথেষ্ট। ২০০৮ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি এই আহ্বান জানিয়েছিলেন, যা আজও বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
বিপ্লবী বেগম জিয়া বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের পাশে থাকার পুরস্কারস্বরূপ তিন-তিনবার এদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। জনগণ যখনই সুযোগ পেয়েছে, তখনই তাঁকে নির্বাচিত করেছে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার উচ্চাসনে আসীন হয়েও তিনি জনগণের পাশেই ছিলেন। দেশ গড়ার লক্ষ্যে ভাগ্যবিড়ম্বিত আপামর জনতার ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিজেকে ব্রত রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষক ও রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ-তিতিক্ষাকে অমর করে রাখা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসমূহকে সমুজ্জ্বল রাখার লক্ষ্যে প্রভূত কাজ করেছেন। তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন; দুই শিশুপুত্রসহ মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েছিলেন। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর রয়েছে প্রবল আবেগ। তিনি ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষা ও স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রায়েরবাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের হাতে নির্মমভাবে নিহত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি জাতির সম্মান প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। ২০০১ সালে সরকার গঠন করে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ সাধন ও তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সুব্যবস্থা গ্রহণে সরাসরি সরকারকে সম্পৃক্ত কলার নিমিত্তে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিযোদ্ধা রেদোয়ান আহমদ এ মন্ত্রণালয়ের প্রথম প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবিকে খুঁজে বের করে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় পদক ‘বীর প্রতীক’ হস্তান্তর করা হয়। তিনি পাকিস্তানে অসম্মানিত অবস্থায় পড়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের বীর সৈনিক বীরশ্রষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের ২৪শে জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহণ করেন। অতঃপর তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দেশের মাটিতে সমাহিত করা হয়। এর আগে ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে খালেদা জিয়া এক জনসভায় ঘোষণা করেন, শিগ্গিরই মতিউরের দেহাবশেষ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হবে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর অনুমানের নামে খুলনায় একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সরকারের আমলে এসে সেটি পরিবর্তন করে দেয়া হয়! দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষা সৈনিকদের স্মৃতি রক্ষার্থে এরকম আরো স্থাপনাসমূহের নামকরণ করেন।
তিন দফায় সরকার গঠন করে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেগুলো এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পার্লামেন্টারি পদ্ধতীর সরকার প্রতিষ্ঠা ও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ এসবের মধ্যে অন্যতম। খালেদা জিয়ার সরকার রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনায় ৬০টি সংসদীয় কমিটি গঠন করেন, যাতে বিরোধীদলীয় সাংসদদেরকে গুরুত্বসহকারে অবস্থান দেয়া হয়।
শিক্ষাখাতে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন এবং মেয়েদের জন্য দশম শ্রণী পর্যন্ত বিনা বেতনে পড়াশুনার ব্যবস্থা করা তাঁর সরকারের অন্যতম অবদান। তাঁর সরকারের আমলেই বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যলয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন তাঁর সরকারের আম্মলেই গৃহীত হয়। তিনি জিয়াউর রহমানের অর্ধনীতির অনুসরণ করে প্রাইভেটাইজেশনের উপর গুরুত্বারোপ করেন। ব্যক্তিগত আয়কর প্রদানের হার ৫৫ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসেন। ব্যবসায় সহজ করার লক্ষ্যে ২৭ ধরনের শুল্ক হ্রাস করে ৭ ধরনের আমদানি শুল্ক নির্ধারণ করেন। বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে মুক্তবাজার অর্থনীতির সূচনা করেন। দেশের ভূ-ভাগের খনিজ সম্পদকে কাজে লাগাতে বড়পুকুরিয়ায় কয়লা খনি ও মধ্যপাড়ার শ্বেত পাথরের খনি থেকে উত্তোলন কার্যক্রমের সূচনা তাঁর সরকারের আমলেই করা হয়। এছাড়াও ভোলা, বঙ্গোপসাগর ও দিনাজপুরে তাঁর শাসনকালে নতুন প্রাকৃতিক গ্যাসের খনির সন্ধান পাওয়া যায়।
বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে নারীদের আত্মনির্ভরশীলরূপে গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচির অংশ হিসেবে সহজ শর্তে ঋণসেবা সহায়তায় তিনি আনসার-ভিডিপি ব্যাংক প্রতিস্থা করেন। স্বাস্থ্যখাতে সমস্যা ও সংকট নিরসনে তাঁর সরকারসমূহের কার্যক্রম সুবিদিত। প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ এবং জেলা কমপ্লেক্সকে ১০০ থেকে ২৫০ এবং ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের জন্য তাঁর সরকার সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন খাতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর সময়েই সেলুলার ফোন ও আইএসডি ফোনের সূচনা হয়; অন্তত তিন লক্ষ টেলিফোন সংযোগ চালু করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ৩৩০টি উপ-জেলাকে বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসে। উপকূলীয় এলাকাগুলোতে এক হাজারেরও বেশি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করেন। ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় বেগম খালেদা জিয়ার সরকার প্রবল গুরুত্ব দেয়। তাঁর সরকারের আমলে এদেশে অসংখ্য মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ ও অন্যান্য উপাসনালয় নির্মাণে সরকারি তহবিল থেকে অনুদান প্রদান করা হয়। ঢাকার আশকোনায় হজযাত্রীদের সুবিধার্থে একটি স্থায়ী হাজী ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়াও তাকলীগ জামাতের বৃহৎ সম্মেলন বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে অতিরিক্ত ৩০০ একর জমির বন্দোবস্ত করে বেগম খালেদা জিয়ার সরকার।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিতকরণ, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় সংগ্রাম ও রাষ্ট্র গঠনে অবিস্মরণীয় অবদান রাখা এই মহিয়সী নারীর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় যখন, তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। ১৯৮৪ সালে তখন আমরা আমার সিভিল সার্জন বাবার কর্মস্থল পিরোজপুরে ছিলাম। স্বৈরাচার এশাদ বিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে তখন তিনি বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর করছিলেন। এমনি এক সফরে তিনি পিরোজপুরে আসেন এবং সাবেক মন্ত্রী আফজাল সাহেবের বাসায় অবস্থান করেন। আফজাল সাহেবের বাসার ঠিক বিপরীতে ছিল আমাদের বাসা। তিনি যখন বিদায় নিচ্ছিলেন, তখন আমি তার সাদা করোলা গাড়িটির দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিলাম। আমাকে দেখে প্রথমে লিনি কললেন, ‘এই ছেলে, সরো।’ কথার স্বর না থামতেই তিনি মায়াবি কণ্ঠে বললেন, ‘কি নাম তোমার? কোন ক্লাসে পড়ো?’ আমি কোন ভয় না পেয়ে উত্তর দিলাম। এরপর তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সে-ই ছিল আমার প্রথম কথোপকথন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এই জীবন্ত কিংবদন্তী মাদার অব ডেমোক্রেসি খ্যাত দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখন ৭৬ বছর বয়স্কা একজন নারী। কিন্তু বরাবরের মতই এই বয়সে এসেও তাঁকে নানারূপ জুলুম, অবিচারের শিকার হাতে হচ্ছে। শাসকশ্রেণী আপোসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ঔজ্জ্বল্য রুখতে অসংখ্য চেষ্টা করেছে; এখনো করছে। কিন্তু যে নামের অর্থই ঔজ্জ্বল্য, তার আবির্ভাবকে কি চিরতরে রুদ্ধ করা যায়! যায়নি। তিনি বারবার দ্যুতি ছড়িয়েছেন। যে ‘বাংলাদেশবাদ’ জিয়া এই জাতিকে দিয়ে গিয়েছেন, সেই দর্শনের ঝান্ডা হাতে নিয়ে তিনি আগুয়ান হয়েছেন; জীবনের ঘোরতর সঙ্কটাúন্ন অবস্থায় থেকেও জাতিকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। জাতিও তাঁর উপরে আস্থা রেখেছে অদ্যাবধি। এ ধারা অব্যাহত থাকবেই।
লেখক : অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, মার্কেটিং বিভাগ; যুগ্ম-আহ্বায়ক, সাদা দল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সহ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।