সোহেল সামি
জন্মেই শিশুটি পরিচয় হারালো
প্রকাশ: ০৫:৪০ পিএম, ২ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৫:৫৯ এএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
১৮ বছরের নিরন্তর সংগ্রামের ফসল হয়ে একটি শিশু ঘরে এলো। তাকে কেউ ডাকছে অভ্যুত্থান বা গণঅভ্যুত্থান বলে। অনেকে বলছে আন্দোলন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন অথবা ছাত্র-জনতার আন্দোলন। আবার দু-একজনকে মিনমিনে গলায় বলতে শুনছি, এটি একটি বিপ্লব ছিলো। বহু বোদ্ধা আবার খিচুরি বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়ে বলছে, ওপরের সবগুলোই।
আসলে কি? দীর্ঘ ত্যাগের পথ পরিক্রমায় আগষ্টের ৫ তারিখে যে শিশুটি জন্ম নিলো, তার নাম কি, কি-ই বা পরিচয়? আসুন, বই-পুস্তক ঘেঁটে দেখা যাক।
অভ্যুত্থান : অভ্যুত্থানের ইংরেজি coup (কপ) যা ফরাসি kudeta (ক্যুদেতা) থেকে এসেছে। যা হঠাৎ ও অবৈধভাবে নির্বাচিত সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে দলগতভাবে কোন গোষ্ঠী বা সংস্থার অবস্থান ব্যক্ত করাকে বোঝায়। কোন একটি রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক কিংবা দল যখন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন তাকে বলে গণঅভ্যুত্থান। আর যদি সেনাবাহিনী নেয়, তখন সেটি হয় সেনাঅভ্যুত্থান। এক্ষেত্রে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের পতন হতেও পারে নাও পারে।
যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ৭৯ এর গণঅভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হয়নি। আবার ২০০৫ সালের ৩ আগস্ট মৌরিতানিয়ার রাষ্ট্রপতি সৌদি আরব থাকাবস্থায় অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তিত হয়।
অনানুষ্ঠানিকভাবে ‘অভ্যুত্থান’ বা ‘ক্যু’ শব্দটি প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়ে থাকে। দায়িত্বভার গ্রহণ, বিজয় কিংবা স্থান পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ‘ক্যু’ শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে। সাধারণত ছোট্ট একটি দলের সদস্য হিসেবে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রাষ্ট্রের বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান কাজ পরিচালনা করে থাকে। এমনকি একজন ব্যক্তি হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশের সেনাবাহিনী প্রধানের মাধ্যমেও অভ্যুত্থান কার্য পরিচালনা হতে পারে। এছাড়াও, অন্য দেশের মাধ্যমেও অভ্যুত্থান কাজ সংগঠিত হতে পারে।
বিপ্লব : একটি বিপ্লব হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে একটি মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন, যখন জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে ওঠে। বিপ্লব মানব ইতিহাস জুড়ে ঘটেছে এবং পদ্ধতি, স্থায়িত্ব, এবং প্রেরণাদায়ী মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বিপ্লবের ফলে সংস্কৃতি, অর্থনীতি, এবং সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমন- ফরাসি বিপ্লব, ইরানের ইসলামি বিপ্লব, অতি সম্প্রতি আফগানিস্তানের তালেবান বিপ্লব।
ডেভিসের মতে, “বিপ্লব হচ্ছে হিংসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত শাসকশ্রেণিকে হিংসার মাধ্যমে উৎখাত করে জনসাধারণের অধিকাংশের সমর্থনপুষ্ট কোনো শ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।”
ক্রেন ব্রিনটনের মতে- “প্রতিষ্ঠিত সরকারকে বিধিবহির্ভূতভাবে সশস্ত্র উপায়ে পরিবর্তন করাই হলো বিপ্লব।”
অক্টোবর বিপ্লবের নেতা ভ্লাদিমির লেনিনের মতে, “হিংসার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত শাসকশ্রেণিকে হিংসার মাধ্যমে উৎখাত করে জনসাধারণের অধিকাংশের সমর্থনপুষ্ট কোনো শ্রেণির রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই বিপ্লব।”
এরিস্টটল দুই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের বর্ণনা দিয়েছেন-
১. এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন।
২. একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার।
কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সামাজিক সম্পর্কসমূহের গুণগত পরিবর্তনকেই বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। তারা দেখান যে, ইতিহাস মূলগতভাবে গতিময় এবং এই গতিময়তার উৎস হলো সমাজের বিভিন্ন সম্পর্কের, বিশেষত অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্রমাগত পরিবর্তন।
আন্দোলন : সুনিদির্ষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম সাধনার নামই আন্দোলন। আন্দোলনের ইংরেজি- Movement (মুভমেন্ট), আরবি حركة (হারাকাতুন), বাংলা- আন্দোলন। আন্দোলনের সমার্থক শব্দ হলো আলোড়ন, সঞ্চালন। বিভিন্ন ধরনের আন্দোলন হতে পারে। যেমন সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি।
একটি সামাজিক আন্দোলন হলো নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য একটি বৃহৎ গোষ্ঠির দ্বারা শিথিলভাবে সংগঠিত প্রচেষ্টা। এটি হতে পারে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য, অথবা কোনটিকে প্রতিরোধ বা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য। যেমন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পূর্বপাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রচেষ্টার নাম ‘ভাষা আন্দোলন’।
মোটাদাগে :
১. বিপ্লব হয় না, গড়ে ওঠে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফল হলো বিপ্লব, আর অভ্যুত্থান হলো হঠাৎ সংগঠিত প্রচেষ্টা।
২. বিপ্লবাত্মক কর্মকাণ্ডে বৃহৎসংখ্যক জনগোষ্ঠী অংশ নেয়, কিন্তু অভ্যুত্থানে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি অংশ নিয়ে থাকে।
৩. অভ্যুত্থানে পরিবর্তন আসতেও পারে, নাও পারে। বিপ্লব ব্যাপক পরিবর্তনের আকাঙ্খা নিয়ে আবির্ভূত হয়।
৪. যে কোন বিপ্লবে ব্যাপক সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, অভ্যুত্থানে প্রাণহানি ঘটতেও পারে নাও পারে।
৫. অপরদিকে আন্দোলন শিথিলভাবে সংগঠিত প্রচেষ্টার নাম মাত্র।
রোমহর্ষোক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যার জন্ম হলো, আয়নার মতো পরিষ্কার হওয়ার পরও তাকে আমরা ‘বিপ্লব’ বলে ডাকতে পারলাম না। চিৎকার করে পৃথিবীকে জানাতে পারলাম না- ৫ আগষ্ট হলো আমাদের বিপ্লব, গণতন্ত্রে ফেরার বিপ্লব। কেন পারলাম না, কারা ভুলিয়ে দিলো, কি জন্য ভুলিয়ে দিলো? তার উত্তর পরের লেখায় খুঁজবো।
এখন, দীর্ঘ ১৮ বছরের নিরন্তর সংগ্রাম, মামলা-হামলা, গুম-খুনের দরিয়া সাঁতরে বাংলাদেশের মানুষ যা হাসিল করলো, বাচ্চাগুলো কাতারে কাতারে জীবন দিয়ে, হাজারে হাজারে অন্ধ, বধির, পঙ্গুত্ব বরণ করে, একটা মরে, একটাই পড়ে, বাকিগুলো যে প্রেমের টানে গুলির সামনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো, যদি না তার একটা নাম ঠিক করা গেলো, যদি না নির্দিষ্ট হলো তার পরিচয়, তাহলে যে সে অবৈধ হলো, আর কে না জানে, নাম-পরিচয়হীন অবৈধ সন্তানকে কি (?) বলা হয়!
(চলবে....)
লেখক - সোহেল সামি
শিক্ষক/সাংবাদিক