লোকে বলে টাকা নাকি সেকেন্ড গড
প্রকাশ: ০২:৫৭ এএম, ৩ ফেব্রুয়ারী, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৫৩ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
লোকে বলে টাকা নাকি সেকেন্ড গড (!), কেউ কেউ বলেন টাকা হলে বাঘের চোখ পাওয়া যায়। টাকায় কিনা হয়? এটাই মানুষের ধারণা। সমাজের বিত্তশালী লোকদের সকলেই সমীহ করে, সম্মান করে। টাকার মালিক বা বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক সংশ্লিষ্ট লোকেরা কি ভাবে হলো কেউ তার খোঁজ নিতে চায় না। টাকা হলেই সব পাওয়া যায়। টাকার কাছে যেন নৈতিকতার কোন মূল্য নাই। একজন চরিত্রবান মানুষের বর্তমানে সমাজে কোন মূল্য নাই, যদি তার টাকা না থাকে। সমাজ তার নিজস্ব রূপ-চরিত্র বদলে ফেলেছে। টাকার কাছে সমাজ নির্বিকার হয়ে যাচ্ছে। পূর্বে দেখেছি যে ব্যক্তি অসৎ পথে অর্থ উপার্জন করে তার বাড়িতে মসজিদের ইমাম সাহেবরা খেতে যেতেন না। এখন মসজিদে মোটা অংকের টাকা দিলেই সমাজে চিহ্নিত অসৎ ব্যক্তিকেই মসজিদ কমিটির সভাপতি বা সেক্রেটারী মনোনীত করা হয়। কোন চাকরি পেলে ঘুষ খাওয়া যায়, জমিজমা বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে মানুষ সে চাকরির খোঁজে থাকে। বাংলাদেশে খুঁটির জোর বা অঢেল টাকা না হলে চাকরি পাওয়া যায় না। স্কুল শিক্ষক বা সুইপার, পিওন, দারোয়ান ও দপ্তরী পদে টাকা ছাড়া চাকরি হয় না। কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও এমপিদের টাকা না দিলে স্কুলে কোন শিক্ষক বা কোন পোস্টে চাকরি হয় না। হাইকোর্টের নির্দেশে সম্প্রতি এমপিদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। এমপিদের রাহুগ্রাস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেঁচে যাওয়ায় শিক্ষক ও পরিচালনা পর্ষদ হাঁফ ছেড়ে রক্ষা পেয়েছেন।
সমাজের নৈতিকতাবোধ আজ তলানিতে পৌঁছেছে। যাদের নৈতিকতাবোধ রয়েছে তারা আছেন সবচেয়ে কঠিন মানসিক যন্ত্রণায়, তারা অনৈতিকতার প্রতিরোধ বা প্রতিকার করতে পারছেন না; এ ব্যর্থতার গ্লানি নিয়েই তাদের দিন কাটে। মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা সাক্ষী বা মিথ্যা প্রতিবেদন দেয়া যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। লোকে এখন সহসাই বলে থাকে যে, সত্যের ভাত এদেশে নাই। তবে ‘সদা সত্য কথা বলবো’ এ কথাগুলো কি শুধু পাঠ্যবইয়ের মাধ্যই সীমাবদ্ধ থাকবে? নাকি মানুষের ‘অভ্যাসের’ অন্তর্ভুক্ত হবে এটাই এখন একটি প্রশ্ন যার সমাধান প্রত্যাশা করা যায় না। নিরাপত্তার প্রশ্নে ‘কারাগার’ সবচেয়ে দুর্গম এলাকা যেখানে হাজতী বা কয়েদি এবং কারারক্ষী ছাড়া অন্য লোকের প্রবেশ করার ন্যূনতম সুযোগ নাই। কিন্তু টাকা হলে বাংলাদেশের যে কোন জেলখানায় নারীসঙ্গ থেকে শুরু করে কারাগার কর্তৃপক্ষ সবকিছুই ব্যবস্থা করে দেয়। ইতোপূর্বে আমি নিজে কয়েকবার জেল খেটেছি। ১/১১ অবৈধ সরকারের আদেশে ২৬ মাস কারাগারে ছিলাম। সেখানে দেখেছি যে, টাকা হলেই যে কোন নেশার দ্রব্য কারাগারে পাওয়া যায়। তখন মোবাইলে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আমাদের সাথে ডিভিশন সেল ছাড়াও প্রভাবশালী সাধারণ কয়েদীদের হাতেও মোবাইল দেখেছি। এগুলো সবই হয়েছে কারাগার কর্তৃপক্ষকে অর্থের বিনিময়ে রাজি-খুশি করার মাধ্যমে। অর্থের পরিমাণ বেশি হলে কারাগার থেকে বাড়িতে গিয়ে দু-এক রাত কাটানোর ইতিহাসও রয়েছে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, হলমার্ক কেলেঙ্কারি মামলার অন্যতম আসামি হলমার্কের মহাব্যবস্থাপকের সাথে বহিরাগত এক নারীকে ৪৫ মিনিট অবস্থান করার সুযোগ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছে কারাগার কর্তৃপক্ষ। কারাগারের সিসিটিভি ক্যামেরায় ধারণকৃত এ ভিডিও চিত্রটি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হলে তা ভাইরাল হয়ে উঠে। অথচ করোনাকালীন সময়ে কারাগারের বন্দিদের সাথে কোন দর্শনার্থীর সাক্ষাৎ করা নিষিদ্ধ রয়েছে।
আদালতকে বলা হয় একটি পবিত্র জায়গা। কিন্তু সময়ের সন্ধিক্ষণে মানুষ তা বিশ্বাস করে কিনা তা হলো ভিন্ন কথা। কিন্তু কথায় বলে অযাচিত টাকার জন্য কোর্টের ইট-পাথরও হাঁ করে থাকে। ব্রিটিশ আমল থেকে এ পদ্ধতি শুরু হয়েছে। এখন বাড়তি টাকা দেয়া যেন একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। এ রেওয়াজ বন্ধ করার জন্য ‘লোক দেখানো’ কথা বলা হয় সত্য, কিন্তু বাস্তবে উল্লেখযোগ্য কোন উদ্যোগ নাই। দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো দিন দিন কর্মহীন এবং গরিবির দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশ ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। ২৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয়া হয়েছে তা আদায় হচ্ছে অনেক ধীরগতিতে বা আদায়ই হচ্ছে না। বোদ্ধা মহলের ধারণা যে এই ঋণ বাবদ গৃহীত অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে বাড়ি-গাড়ি হচ্ছে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থে। দেশটিকে দেউলিয়ায় পরিণত করায় যা যা উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার একশ্রেণীর পুঁজিপতিরা সরকারি ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিতÑতারা সবই করে যাচ্ছে। দেশকে লুট করার উদ্যোগ প্রতিরোধ করার জন্য সরকারি কোন উদ্যোগ নাই। একটি জাতিকে সামগ্রিকভাবে গতিশীল করার জন্য যে উদ্যোগ সমষ্টিগতভাবে হওয়া দরকার, তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম হতে যাচ্ছে, কিন্তু জাতি আজ বিভিন্ন কারণে দ্বিধা-বিভক্ত, এ বিভক্তি সহসা দূর হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। একটি জাতিকে গতিশীল করতে হলে তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। দেশপ্রেম থাকলে রাতারাতি কেউ ধনী-সম্মৃদ্ধশালী হওয়ার অপকৌশল খুঁজতে পারে না। এ দেশে একশ্রেণীর মানুষের মুখের জোর এতোই বেশি যে, তাদের বক্তব্যে বুঝাই যাবে না যে, কে দেশপ্রেমিক এবং কে দেশপ্রেমিক নয়। বিভিন্ন অপকৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভিন্নখাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। নিজ নিজ স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য একশ্রেণীর সুবিধাবাদী গোষ্ঠী নিজ কর্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে চালিয়ে দেয়। গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের জনগণ। কিন্তু মানুষের সেই স্বপ্ন কি বাস্তবায়িত হয়েছে? গরিব দিন দিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কোটিপতির সংখ্যা যাদের একটি অংশ সরকারি ঘরানার, বাকী অংশ হচ্ছে নব্য আওয়ামী লীগার। নব্য আওয়ামী লীগারদের সম্পর্কে আওয়ামী লীগের মূল শ্রোতধারা অসন্তোষ প্রকাশ করলেও নব্যরা বহাল তবিয়তে আছে। তবে ক্যাসিনো বা এ ধরনের কোন অপরাধে ধরা পড়লে মন্ত্রীরা বলে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএনপি থেকে এসেছে। বিএনপির প্রতি সরকারি দলের এলারজি আছে বিধায় প্রতিক্ষেত্রেই সরকারি দল বিএনপিকে দোষারোপ করে।
জনগণের নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পুলিশ। লজিসটিক সাপোর্ট দিয়ে পুলিশকে অনেক সমৃদ্ধশালী করা হয়েছে। পুলিশকে জনগণের বন্ধু বানানোর জন্য সরকারের আপ্রাণ চেষ্টা থাকলেও জনগণ পুলিশকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতে পেরেছে কি? এখনো মানুষের বদ্ধমূল ধারণা এই যে, থানায় যেতে হলে টাকা নিয়ে যেতে হবে এবং টাকা ছাড়া থানায় কোন কাজ হয় না। একটি জিডি করতে গেলেও ডিউটি অফিসারের জন্য টাকা নিয়ে যেতে হয়; এ ধারণা থেকে গণমানুষ সরে আসতে পারে নাই। কারারক্ষী বা পুলিশের একটি অংশ মাদক ব্যবসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত। সরকারের কোন দপ্তরেই অযাচিত অর্থ ব্যয় না করলে কোন সেবা পাওয়া যায় না। ইদানীং বিভিন্ন সরকারি অফিসে লেখা রয়েছে যে, ‘না মার্কস, নো সার্ভিস’। কিন্তু বাস্তবে চিত্রটা এই যে, ‘নো টাকা, নো সার্ভিস’। এই নীতিতেই সরকারি অফিসগুলো চলছে। মাঝেমধ্যে দু-চারজন হাতে গোনা সরকারি কর্মচারী পাওয়া যায় যারা ঘুষ নেন না। ঘুষ ছাড়া একমাত্র সেবা পাওয়ায় ব্যাংক কর্মচারীদের নিকট থেকে যারা নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারী, যাদের দায়িত্ব শুধু টাকা জমা করা বা প্রদান করা। কিন্তু ব্যাংক যারা পরিচালনা করে এবং নীতি-নির্ধারক তারা মোটা অংকের বিনিময়ে বিভিন্ন অযাচিত ঋণ দিয়ে ব্যাংক খালি করে দেয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকগুলো পরিচালনায় রয়েছে সরকারি ঘরানার লোকেরা।
অযাচিত লেনদেন একটি সামাজিক ব্যাধি। দেশে শিক্ষিত লোকের অভাব নাই এবং শিক্ষিত লোকেরাই সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরিতে রয়েছেন। শিক্ষার পাশাপাশি যদি নৈতিকতা না থাকে তবে শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের মাঝে কোন তফাৎ থাকে না। নৈতিকতা শিক্ষা দেয়ার কোন প্রতিষ্ঠান নাই যা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজেকে নিজে নৈতিক আদর্শ গড়ে না তোলেন। নৈতিকতা কোন বই-পুস্তক ও স্কুল-কলেজের বিষয় নয় এটা পুরোপুরি মন-মগজ ও নিজ বিবেকের বিষয়। বিবেক কি তাও কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করা যাবে না। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলেই ‘বিবেক’ জবাব দেয়Ñকোন কাজটি নৈতিক ও কোন কাজটি অনৈতিক। ধর্মীয় পুস্তক পড়ে নৈতিকতা শিক্ষা লাভে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু নিজ থেকে সচেতন না হলে কেউ নৈতিকতাপূর্ণ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হতে পারে না। এ জন্য দরকার কোন কাজ করার পূর্বে বা কোন বক্তব্য দেয়ার পূর্বে নিজেকে নিজে জিজ্ঞাসা করাÑতবেই নিজ ‘বিবেক’ কম্পিউটারের মত সঠিক রাস্তা প্রদর্শন করবে, নতুবা নয়। ফলে শিক্ষা এবং নৈতিকতা একটি ভিন্ন দিক, যা অর্জন করতে হবে নিজ প্রচেষ্টায়।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
taimuralamkhandaker@gmail.com
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
দেশের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো দিন দিন কর্মহীন এবং গরিবি দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে দেশ ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। ২৩ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি শিশু জন্মগ্রহণ করে। ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয়া হয়েছে তা আদায় হচ্ছে অনেক ধীরগতিতে বা আদায়ই হচ্ছে না। বোদ্ধামহলের ধারণা যে এই ঋণ বাবদ গৃহীত অর্থ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। বিদেশে বাড়ি-গাড়ি হচ্ছে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের অর্থে। দেশটিকে দেউলিয়ায়ে পরিণত করায় যা যা উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার একশ্রেণীর পুঁজিপতিরা সরকারি ঘরানার লোক হিসেবে পরিচিত তারা সবই করে যাচ্ছে। দেশকে লুট করার উদ্যোগ প্রতিরোধ করার জন্য সরকারি কোন উদ্যোগ নাই। একটি জাতিকে সামগ্রিকভাবে গতিশীল করার জন্য যে উদ্যোগ সমষ্টিগতভাবে হওয়া দরকার, তা পরিলক্ষিত হচ্ছে না