ন্যায়পাল গঠনও এখন সময়ের দাবি অ্যাভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার
প্রকাশ: ০১:০৭ এএম, ১৩ জানুয়ারী, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০২:১০ পিএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
দেশের খ্যাতনামা ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে টুর্নীতির অভিযোগ এনে তদন্তের জন্য সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করার জন্য রাষ্ট্রপতির নিকট আবেদন জানিয়েছেন। যা গঠন করার একমাত্র এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির রয়েছে। যদিও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ বা মতামত ছাড়া বর্ণিত বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না, এ বিষয়ে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য যাতে লিখা রয়েছে “এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের ৩ দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।”
সংবিধানের ৭৭(১) অনুচ্ছেদ মোতাবেক একজন ন্যায়পাল (Ombudsman) নিয়োগ দেয়ার বিধান রয়েছে, কিন্তু এই দীর্ঘ ৫০ বছর সময়ের মধ্যে কোন সরকারই ‘ন্যায়পাল’ নিয়োগ দেয় নাই, যা রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে। দেশে যদি একজন ন্যায়পাল থাকতো এবং সেই ন্যায়পাল মাজাভাঙা না হয়ে যদি মেরুদণ্ড সম্পন্ন হতো তবে হয়তো কিছুটা হলেও সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা দমন হতো। ন্যায়পাল নিয়োগ ও তার কার্যক্রম সম্পর্কে সংবিধানে যা বলা হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো : “(১). সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন। (২) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যে কোন কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন। (৩) ন্যায়পাল তাঁহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বাৎসরিক রিপোর্ট গ্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।” ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্টপতির নিকট একটি সুপ্রীম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি, চুরি, স্বেচ্ছাচারিতা প্রভৃতি বিষয়ে তদন্ত দাবি করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, ০.৫০ (পঞ্চাশ পয়সার) টাকার একটি সাদা কাগজ এবং ৪ টাকা মূল্যের একটি বলপেন দিয়ে কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের বাক্সে ফেলে দিলেই তদন্ত শুরু হয়ে যায়। অনেক সময় পত্রিকায় দুর্নীতি সম্পর্কিত কোন সংবাদ প্রকাশিত হলেই সে সংবাদের সূত্র ধরেই সম্পদের হিসাব চাহিয়া দুদকের নোটিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট চলে যায়। অন্যদিকে দুদকের নোটিশ মানেই একটি আতঙ্ক। কিন্তু রাষ্ট্রে ৪২ জন নাগরিক সুর্নিষ্ট অভিযোগ করার পরও দুদক কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। দুদক আইনে ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, “এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হইবে।” একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবে কেন? নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট, দেশের নামি-দামী অনেক ব্যক্তি আবাসন প্রকল্পের নামে তিন ফসলী জমি, নদী, নালা, জলাভূমি, পুকুর, বিল প্রভৃতি বালু দ্বারা ভরাট করে ফেলেছে, ভূমিদস্যুরা জমির মালিক থেকে জমি ক্রয় না করেই দখল করে। সাইনবোর্ড স্থাপন করে দামী কাগজে ব্রুসিয়ার ছাপিয়ে মার্কেটিং করছে, এ্যাডভান্স বুকিং মানি নিচ্ছে, অথচ জমি হস্তান্তর করছে না। এর মূল কারণ মূল মালিকদের নিকট থেকে আবাসন প্রকল্পের মালিকেরা জমি ক্রয় করেনি। এই যে এতো বড় দুর্নীতি হচ্ছে এর জন্য দুদকের কোন কার্যক্রম লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দুদকের এ ধরনের নীরবতার পিছনে কি কোন উদ্দেশ্য লুকায়িত?
যে ৪২ জন নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেছেন তারা সমাজে ও জাতির জন্য আলোকিত ব্যক্তিত্ব। তাদের বক্তব্য গোটা জাতির বক্তব্য। ভোট কাস্ট করতে না পারা ব্যক্তিদের আর্তনাদ ৪২ জনের বক্তব্যে উঠে এসেছে। তারা (৪২ জন) নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেছেন মাত্র, এখনো শাস্তি দাবি করেননি। কিন্তু বঙ্গভবনের চার দেয়ালের ভিতরে অবস্থানরত মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট ভোটাধিকার প্রয়োগে ব্যর্থ নাগরিকদের বোবা কান্না হয়তো তিনি শুনতে পান না। এ জন্য তিনি বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের মতো বলতেই পারেন যে, কবর জেয়ারত এবং মিলাদে অংশ গ্রহণ করা ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানে কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কাগজে-কলমে সব ক্ষমতার উৎস রাষ্ট্রপতি, কিন্তু কোন ক্ষমতাই তার নেই যদি না প্রধানমন্ত্রী তাকে ঝঢ়ধপব দেন। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির নিকট দাখিলকৃত ৪২ জনের আবেদন ডাস্টবিনে যাবে, না কার্যকর তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে তা অগ্রীম আঁচ করা যাচ্ছে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত এর যবনিকা প্রস্ফুটিত হয় (!) ‘কোন ব্যক্তি জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে কেহ নয়’ এটাই হওয়া উচিৎ স্বাধীনতার চেতনার অন্যতম চেতনা। রাষ্ট্র প্ররিচালনায় যদি জবাবদিহিতাকে নিশ্চিত করা যেতো তবে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা পুকুর চুরি থেকে সাগর চুরি করতে পারতো না। উন্নত দেশে জবাবদিহিতার গুরুত্ব অনেক। যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে জবাবদিহিতার প্রয়োজন হয় না, বরং এক ব্যক্তিকে খুশি রাখতে পারলেই হলো। অথচ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সিনেট তদন্ত করেছে। মক্কা শরীফে বায়তুল মাল অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কাপড় প্রদান করা হতো। একবার কাপড় বিতরণের পর খলিফা হযরত ওমর (রা:) জুম্মার নামাজে খুদবা দেয়ার সময় একজন সাহাবী খলিফাকে প্রশ্ন করে বলেন যে, হে আমিরুল মুমেনীন, সকলের জন্য একটি করে নতুন কাপড় বিতরণ করা হয়, কিন্তু আপনার পরনে তো ২টি নতুন কাপড় দেখা যাচ্ছে। “এতে আপনার জবাব কি”? খলিফা দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দিয়ে বলেছিলেন যে, আমার পরনে নতুন ২টি কাপড়ের মধ্যে একটি আমার পুত্রের ও অন্যটি আমার নিজের। অথচ এ ধরনের প্রশ্ন যদি আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি বা নেতাদের করা হয় তবে প্রশ্নকারীর ঘারে মাথা থাকবে কি না সন্দেহ আছে। তৎসময়ে রাষ্ট্রনায়কদের জবাবদিহিতার মানসিকতা ছিল বলেই হযরত ওমর (রা:) প্রশ্নকারীর জবাব দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছিলেন।
৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিকের অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কি আলোর মুখ দেখবে না? নাকি কলাপাতার মত শুকিয়ে যাবে? কলাপাতা শুকানোর পর জ্বালানি হিসাবে এখনো গ্রামে-গঞ্জে ব্যবহৃত হয়। ৪২ জন নাগরিকের অভিযোগ যদি যথাযথ বিধি মতে ব্যবহৃত না হয় তবে দেশবাসীর মনের আগুন জ্বলে উঠতে পারে যে কোন দিন। ৪২ জান নাগরিকের অভিযোগ তদন্তের পূর্বেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার অন্য কমিশনারদের সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো যে, ‘ঠাকুর ঘরে কে আমি কলা খাই না।’ নির্বাচন কমিশন যদি এতোই স্বচ্ছ থাকে তদন্তের বিরোধিতা তারা করবে কেন? অন্যতম নির্বাচন কমিশনারের সময়ে সময়ে প্রদত্ত বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশন একটি দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শপথ গ্রহণপূর্বক জাতির সামনে সত্যকে গোপন করে ঘটনার বিবরণ দিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে অসত্য কথা বলেন তা শুনে শুনে জাতি হয়রান হয়ে পড়েছে। চাকরি রক্ষা করাই যদি শপথ পাঠপূর্বক সাংবিধানিক পদে আরোহণ করে অসত্য ঘটনার বিবরণ দেয় তবে শপথের মর্যাদা থাকে কোথায়? ৪২ জন নাগরিকের অভিযোগ যদি রাষ্ট্রপতি আমলে না নেন তবে জাতির একটি বদ্ধমূল ধারণা এই হবে যে, সত্য ঘটনা উৎঘাটনে মহামান্য রাষ্ট্রপতি সদিচ্ছা প্রতিবদ্ধকতার সৃষ্টি করেছে, অন্যদিকে তদন্তের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে। তবে প্রধানমন্ত্রীর পূর্বাপর বক্তব্য এবং মন্ত্রীদের সরাসরি বক্তব্যে প্রমাণ করে, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত সরকার সমর্থন করে না, বরং বিরোধিতা করছে। আমাদের রাষ্ট্রে এখন নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চলছে, অর্থাৎ সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারবে না। সরকারি দল বা সরকার সমর্থিত দল রাজপথে মিটিং-মিছিল করতে পারবে, কিন্তু বিরোধীদল করতে পারবে না। দেশে যদি স্বচ্ছভাবে গণতন্ত্র চালু থাকতো তবে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্তের কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো না। সরকারি ভাষ্য মতে, দেশে এখন উন্নয়নের জোয়ারে গণতন্ত্র নির্বাসিত।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (এ্যাপিলেট ডিভিশন)
রাষ্ট্র প্ররিচালনায় যদি জবাবদিহিতাকে নিশ্চিত করা যেতো তবে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা পুকুর চুরি থেকে সাগর চুরি করতে পারতো না। উন্নত দেশে জবাবদিহিতার গুরুত্ব অনেক। যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে জবাবদিহিতার প্রয়োজন হয় না, বরং এক ব্যক্তিকে খুশি রাখতে পারলেই হলো। অথচ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সিনেট তদন্ত করেছে। মক্কা শরীফে বায়তুল মাল অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কাপড় প্রদান করা হতো। একবার কাপড় বিতরণের পর খলিফা হযরত ওমর (রা:) জুম্মার নামাজে খুদবা দেয়ার সময় একজন সাহাবী খলিফাকে প্রশ্ন করে বলেন যে, হে আমিরুল মুমেনীন, সকলের জন্য একটি করে নতুন কাপড় বিতরণ করা হয়, কিন্তু আপনার পরনে তো ২টি নতুন কাপড় দেখা যাচ্ছে। এতে আপনার জবাব কি? খলিফা দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দিয়ে বলেছিলেন যে, আমার পরনে নতুন ২টি কাপড়ের মধ্যে একটি আমার পুত্রের ও অন্যটি আমার নিজের। অথচ এ ধরনের প্রশ্ন যদি আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি বা নেতাদের করা হয় তবে প্রশ্নকারীর ঘারে মাথা থাকবে কি না সন্দেহ আছে