সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা
গণতন্ত্রের পথপরিক্রমা কুসুমাস্তীর্ণ নয়
প্রকাশ: ০৩:২৪ এএম, ২৮ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৩৫ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
গণতন্ত্রের অভিযাত্রা বেশ প্রাচীন। কিন্তু তা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। গণতন্ত্র যখন কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থের প্রতিকূলে চলে গেছে, তখন তারা গণতন্ত্রের গলা চেপে ধরেছে গণতন্ত্র রক্ষার নামেই। আর তা সূচনাকাল থেকে এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। মূলত, ‘গণতন্ত্র’ ইংরেজি Democracy থেকে এসেছে। অর্থ ‘জনগণের শাসন’। খ্রিষ্টপূর্ব ৫ম শতকে অ্যাথেন্সসহ অন্যান্য গ্রিক নগররাষ্ট্রে বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বোঝাতে শব্দটির প্রথম প্রয়োগ। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ক্লিসথেনিস থিউরিতে নতুন ধরনের সরকার চালু হয় এবং সেই সঙ্গে বিশ্বের প্রথম গণতন্ত্র চালু হয় গ্রিসের ছোট একটি শহর-রাষ্ট্র এথেন্সে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপজাতির মধ্য থেকে নেতাদের বেছে নেয়ার যে প্রচলিত রীতি চালু ছিলো, ক্লিসথেনিস তার অবসান ঘটান এবং তিনি মানুষের নতুন নতুন জোট তৈরি করে প্রতিটি ইউনিটকে ডিময় (Demoi) অথবা প্যারিশ (Parish)-এ বিভক্ত করেন। মুক্ত নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে শহর-রাষ্ট্রের সরকার পরিচালনায় সরাসরি অংশগ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। বস্তুত এই ঘটনাই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রারম্ভিক উন্মেষরূপে গণ্য। নামকরণ করা হয় ডেমোক্রেশিয়া (Democratia) যার অর্থ হচ্ছে জনগণের (demos) শক্তি (Kratos)।
অবশ্য বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন উপায়ে এবং নানাবিধ পদ্ধতিতে গণতন্ত্রকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪২২ সালে ক্লিয়ান ডেমোক্রেসিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে-"That shall be the democratic which shall be the people, for the people". আরও বেশ পরে আব্রাহাম লিঙ্কন তার এক ভাষণে গণতন্ত্রের প্রায় অভিন্ন একটি সংজ্ঞা প্রদান করেন। আব্রাহাম লিংকন (Abraham Lincoln) November ১৯, ১৮৬৩ তারিখে তার দেয়া Pennsylvania state এর গেটিসবার্গ বক্তৃতাতে (Gettysburg Address) গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছিলেন, "Government of the the people, by the people, for the people." যার অর্থ দাঁড়ায়, গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের, জনগণের দ্বারা ও জনগণের জন্য। বস্তুত বিগত এক দশকে বিশ্বজুড়ে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ একেবারে প্রান্তসীমায় নেমে এসেছে। বিশেষ করে আমাদের দেশের গণতন্ত্র চর্চার প্রেক্ষাপটে তা আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। কারণ, গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও জনগণের শাসন বলতে যা বোঝায় তা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রায়ই উপেক্ষিত হয়ে আসছে।
একথাও ঠিক যে, গণতান্ত্রিক পদ্ধতির শাসন পুরোপুরি ত্রুটিমুক্ত নয়। অবশ্য গণতন্ত্রের কুফলের চেয়ে সুফলই অধিক বলে মনে করা হয়। কিন্তু গণতন্ত্র সম্পর্কে মানুষের যথাযথ জ্ঞান ও গণতন্ত্র মনস্কতার অভাব, দাসপ্রবণ মানসিকতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বিশেষত আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে মারাত্মক সঙ্কটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হচ্ছে তাতে গণতন্ত্র কোন নির্দিষ্ট কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকেনি। সঙ্গত কারণেই গণতন্ত্রের কোনো সর্বজনীন সংজ্ঞাও এখন খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর হয়ে পড়েছে। কারণ, স্থান, কাল ও পাত্রভেদে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পার্থক্যের বিষয় জোড়ালোভাবেই দৃৃশ্যমান হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে স্থান করে নিয়েছে স্বেচ্ছাচারিতা, গণবিরোধিতা ও আত্মপুজা নানাবিধ গণতন্ত্র বিরোধী অনুসঙ্গ। তাই গণতন্ত্রের সংজ্ঞার প্রশ্নটি এখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানেও বহুল আলোচিত, সমালোচিত ও বিতর্কিত বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। বিগত কয়েক দশক ধরে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণ-বিষয়ক গবেষণা, আলোচনা, পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও গণতন্ত্রের প্রকৃতি নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল আমাদের কোন সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা দিতে পারেনি। ফলে গণতন্ত্রের ব্যাপ্তি, পরিসর ও অবয়ব খোলাসা করা সম্ভব হয়নি।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে দু’টি প্রধান ধারার অস্তিত্ব রয়েছে। প্রথমটিতে গণতন্ত্রকে বিবেচনা করা হয় একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে। যা নির্দিষ্ট ‘নির্বাচনী’ ও ‘পদ্ধতিগত’ মানদণ্ড অর্জনে সক্ষম। অপর ধারাটিতে গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রায়ণকে সমাজে কতগুলো সঠিক গণতান্ত্রিক ‘সাংস্কৃতিক’ উপাদান অর্জিত হওয়ার নিরিখে বিবেচনা করা হয়। পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের ধারণার জনক হিসেবে জোসেফ সুম্পিটারই স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব। সুম্পিটারের ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ ক্যাপিটালিজম, সোশ্যালিজম অ্যান্ড ডেমোক্রেসিতে গণতন্ত্রকে বর্ণনা করেছেন নেতৃত্ব নির্বাচনের ব্যবস্থা হিসেবে। সুম্পিটার লিখেছেন, "The democratic method is that institutional arrangement for arriving at political decisions in which individuals acquire the power to decide by means of a competitive struggle for people's vote". ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, যেখানে জনগণের ভোট পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা লাভ করে’। (সুম্পিটার, ১৯৫০: ২৬৯)। গণতন্ত্রের এই পদ্ধতিগত ধারণাকে রবার্ট ডাল তার বিখ্যাত গ্রন্থ পলিয়ার্কি ঃ পার্টিসিপেশন অ্যান্ড অপজিশন-এ বিস্তারিত ও সম্প্রসারিত পর্যালোচনা উপস্থাপন করেছেন। রবার্ট ডাল (১৯৭২) পদ্ধতিগত গণতন্ত্রের সুস্পষ্ট নির্ধারকের তাগিদ দিয়ে বলেন যে, বহুজনের শাসনব্যবস্থার কতগুলো মৌলিক উপাদান রয়েছে। সেগুলো হলোÑসরকারে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত কর্মকর্তা থাকা; নিয়মিত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন; সকল প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; সরকার বা কোনো একক গোষ্ঠীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন উৎস থেকে তথ্য পাওয়ার সুযোগ, সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার স্বাধীনতা। ডালের এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, বহুজনের শাসন হলো শাসনব্যবস্থার জন্য কতগুলো প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির সমন্বিত রূপ। ডালের এই সংজ্ঞা বা বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে বিস্তর সমালোচনা থাকলেও এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও গুণাগুণ বিচারে এগুলোই বহুল আলোচিত ও প্রচলিত মানদণ্ড। সুম্পিটার ও ডালের এই মানদণ্ডকে গণতন্ত্রের পদ্ধতিগত (Procedural) এবং সবচেয়ে সীমিত (Minimalist) সংজ্ঞা বলা হয়ে থাকে।
চুলচেরা বিশ্লেষণে গণতন্ত্র বলতে জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন বা স্বশাসনকেই বোঝায়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও একবিংশ শতাব্দীর সূচনার মধ্য দিয়ে বিশ্বে গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের সংকট দেখা দিতে শুরু করছে। এমনকি অবাধ গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সদ্য সমাপ্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বড় ধরনের অভিযোগ অভিযোগ উঠেছে।
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগটি হলো এর মাধ্যমে জনরঞ্জনবাদী ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চিন্তাধারাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে নির্বাচনে জয়লাভ করে। অভিযোগটি আমাদের দেশের জন্য বেশ যুৎসই বলতে হবে। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতন্ত্র বলতে কেবল নির্বাচনকে ও জনগণের ভোটাধিকারকেই মনে করা হয়। কারণ, একটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যসহ যে সকল বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায়, তা কেবল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব। মূলত গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রথম এবং প্রধান শর্তটির নাম নাগরিকদের সুশিক্ষিত হিসেবে গড়ে তোলা; মানুষকে গণতন্ত্রমনা, চিন্তাশীল ও আত্মসচেতন হতে উদ্বুদ্ধ করা। গণতন্ত্রকে সফল ও সার্থক করতে আরো কয়েকটি শর্ত যেমন, রাজনৈতিক সচেতনতা, মানুষের অধিকার সচেতনতা, স্বাধীনতা, সাম্য, আইনের শাসন প্রয়োজন হলেও শিক্ষার সম্প্রসারণ ব্যতীত তা অর্জন সম্ভব নয়। এ বিষয়ে একজন মধ্যযুগীয় শাসকের অভিব্যক্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি জিজ্ঞাসিত হয়েছিলে যে, তিনি তার রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন ? তার সাদামাটা জবাব ছিল, তিনি তার দেশের প্রতিরক্ষার জন্য প্রভূত সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছেন। পাল্টা প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষার জন্য কী কাজে আসবে ? তার ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ জবাব, জাতি শিক্ষিত হলেই তারা আত্মসচেতন হয়ে উঠবে। আর আত্মসচেতন মানুষই হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষার সবচেয়ে শক্তিশালী অনুসঙ্গ।
মূলত শিক্ষাই একজন নাগরিককে পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিজ বিচার-বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করার মাধ্যমে ত্যাগ, সহানুভূতি, স্বার্থহীনভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের সেবা, নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্য পরায়ণতা ও ভ্রাতৃত্ববোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। আর শিক্ষার মাধ্যমেই নাগরিকের মানসিক, নৈতিক ও মূল্যবোধের স্ফূরণ ঘটে। তাই গণতন্ত্রের জন্যও নাগরিকদের প্রস্তুত করতে শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি অনস্বীকার্য। বর্তমান সময়ের গণতন্ত্রের সাফল্যে বাধাসৃষ্টিকারী নানা সমস্যাসংক্রান্ত আলোচনায় শিক্ষার প্রসঙ্গটি অব্যক্ত ও অমূল্যায়িত থেকে যাচ্ছে। আসলে আমরা এখনও সমস্যার কেন্দ্রেই পৌঁছতে পারিনি। মূলত সঙ্কটটা তো সেখানেই। প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো ও এরিস্টটল গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন। কারণ, তৎকালীন গ্রিসে কেবল যোদ্ধা ও ভূমির মালিকদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হতো। এরা ছিল মোট জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। অন্যদের অধিকাংশই ছিল অশিক্ষিত। প্লেটো তার `Republic’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘প্রশাসন হলো এমন একটি কলা যা সাধারণ মানুষের দ্বারা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। শুধু বুদ্ধিমান ও যোগ্য মানুষের পক্ষেই প্রশাসনকে অনুধাবন করা সম্ভব।’ বস্তুত একজন মানুষকে অসাধারণ, বুদ্ধিমান ও যোগ্য করে তুলতে শিক্ষার আলো সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নেই। আর কোন সমাজ-রাষ্ট্রের মানুষকে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করা গেলেই কেবল সে সমাজ-রাষ্ট্রে গণতন্ত্রসহ সকল ইতিবাচক প্রচেষ্টাই সফল ও সার্থক হয়ে উঠবে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদের প্রবক্তা জন স্টুয়ার্ট মিল গণতন্ত্রের প্রধান দু’টি শর্ত হিসেবে শিক্ষা ও উত্তম নৈতিক চরিত্রের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। মিল তার `Considerations on Representative Govement’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘জনগণের জন্য সার্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করার পূর্বে সার্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি।’
গণতন্ত্র বলতে কোনও জাতি-রাষ্ট্রের এমন একটি শাসনব্যবস্থাকে বোঝায় যেখানে নীতিনির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক বা সদস্যের সমান ভোটাধিকার থাকে। গণতন্ত্রে আইন প্রস্তাবনা, প্রণয়ন ও তৈরির ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ রয়েছে। মূলত একটি সফল ও সার্থক গণতান্ত্রিক সমাজ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে সুশিক্ষিত, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং সমঝদার জনগোষ্ঠী আবশ্যকতার বিষয়টি উপেক্ষা করা যায় না। আমরা গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার জন্যই এক সর্বাত্মক মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার শর্তগুলো অপূরণীয় থাকায় স্বাধীনতার অন্যতম চেতনা ‘অবাধ গণতন্ত্র’ আজও আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে। বিশেষ করে দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের অনেকটাই হতাশ করেছে। দশম জাতীয় নির্বাচনে তো ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। একদলীয় নির্বাচনে বাকি আসনগুলোতেও ভোট চুরির মহড়া দেখতে হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন তো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ‘মিডনাইট ইলেকশন’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। মূলত আমাদের দেশের সাম্প্রতি সময়ে জাতীয় ও স্থানীয় কোন নির্বাচনেগুলোতে নির্বাচনে গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায় তার কোন প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এজন্য আমরা বিশেষ গোষ্ঠীকে দায়ী করে নিজেদের দায় শেষ করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত কারণগুলো উপলব্ধি করার চেষ্টা করিনি। আমাদের দেশের গণতন্ত্রের বেহাল দশার জন্য সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচন কমিশনগুলোকেও দায়ী করা হয়। দেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার পরিবর্তে মহল বিশেষের আজ্ঞাবহ হওয়ার গুরুতর অভিযোগ রয়েছে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। আর তা আরও জোরালো ভিত্তি পেয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে ‘গুরুতর অসদাচরণের’ অভিযোগের গুরুতর অভিযোগের মাধ্যমে। শুধু অসদাচরণ নয়, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নিয়োগ বাণিজ্যেরও অভিযোগ এনেছেন তারা। এমনকি বর্তমান নির্বাচন কমিশন সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্ত এবং মুজিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। দেশের একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের জন্য মোটেই শোভন নয়।
দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথামালার ফুলঝুড়ি শোনা গেলেও নিজেরা যেমন গণতন্ত্রের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠিনি, ঠিক তেমনিভাবে আমরা গণতন্ত্রমনাও নই। মূলত শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাদপদতা, আত্মসচেতনা বিমুখতা, মূল্যবোধের সঙ্কট সর্বোপরি অবক্ষয়ের জয়জয়কারটাই আমাদের দেশের গণতন্ত্রকে মারাত্মক সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচন কমিশনগুলোর দাসপ্রবণ মনোবৃত্তি। তাই আমাদের দেশের গণতন্ত্রের পথপরিক্রমাকে সুন্দর, সাবলীল ও গতিশীল করতে হলে গণতন্ত্রের জন্য সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। আর নির্বাচন কমিশনকে ঢেলে সাজাতে হবে মূল্যবোধ সম্পন্ন এবং দেশ, জাতি ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীলদের দিয়ে। নতুন বছরে প্রত্যয় গ্রহণ করতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
smmjoy@gmail.com