ড. আব্দুল হাই তালুকদার
জিয়া মানেই স্বাধীনতা-গণতন্ত্র-উন্নয়ন
প্রকাশ: ০৯:৩৮ পিএম, ১৮ জানুয়ারী, বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:৩০ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
শহীদ জিয়া এদেশের শ্রেষ্ঠতম মানুষদের অন্যতম। জাতীয় দুর্যোগময় ও সংকটময় মুহূর্তে বার বার জিয়ার আগমনে দেশ গতি ও আবেগ দুটোই পেয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে ও কর্তৃত্বে দেশ সংকটকাল উতরাতে পেরেছে। জিয়া শুধু একটি নাম বললে তাঁর প্রতি অবিচার করা হবে। জিয়া তাঁর বহুমুখী কর্মকান্ড ও কীর্তি দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছেন। খাঁটি দেশপ্রেমিক ও মানবকেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনার অধিকারী এই মানুষটি জাতীয় প্রয়োজনে ও মানুষের কল্যাণ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করে গেছেন। দিশেহারা, পথহারা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এ জাতিকে তিনি দিক-নির্দেশনা দিয়ে সঠিক পথে পরিচালনায় সহায়তা দিয়েছেন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ২৫ তারিখ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সেনাশাসক বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়, সেসময় দেশ নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। ২৫ তারিখের কালরাত্রিতে এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানী হানাদাররা যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঢাকার রাস্তায় রক্তগঙ্গা বয়ে যায়, সে সময়ের অবস্থার কথা ভাবুন। একদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের শূন্যতা, অন্যদিকে স্বাধীনতাকামী মানুষের স্বাধীনতা লাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা সেসময় প্রবলভাবে অনুভূত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেসময় যে অবস্থা সৃষ্টি করেছিল তাতে স্বাধীনতা ঘোষণার কোনো বিকল্প ছিল না। অথচ সেসময় স্বাধীনতা ঘোষণা দেবার মত কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপস্থিতও ছিলেন না। শরমিন আহমদ রচিত ‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থটিতে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট আলোচিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাথে আব্বুু টেপরেকর্ডার নিয়ে যান। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আব্বুু ফিরে আসেন’। ‘আমি জিয়া বলছি’ এই বাণীটি মানুষকে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত করে। শরমিন আহমদের বই থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘কালুরঘাট চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী বেলাল মোহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তী সময়ে জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট) ২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।’ প্রিয় পাঠক, শরমীন আহমদ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা। অতএব, তার ব্যাখ্যা প্রামাণ্য দলিল হিসাবে গ্রহণ করা যায়। এ বক্তব্য তার কিছু অভিজ্ঞতা ও কিছু শোনা।
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণাটি ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে জড়ানোর নির্দেশিকা। তাঁর ঘোষণার পর দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ইতিহাস। যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এদেশের অসংখ্য তরুণ-যুবক-কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ। ইপিআর, সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য, পুলিশ বাহিনীর সদস্য সকলে মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের দল গঠন করা হয়েছিল। এসব জওয়ানরা জীবনপণ করে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকেননি। জীবনবাজি রেখে সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। ২৫ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত জাতি আর কোন দিক-নির্দেশনা পায়নি। জিয়াউর রহমানের ভাষণ বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১১ এপ্রিল যে ভাষণ দেন সেখানে উল্লেখ ছিল। জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেবার অব্যবহিত পরে জেড ফোর্স গঠন করেন। জেড ফোর্সের নেতা ও পরিচালক হিসেবে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ‘রাষ্ট্রনায়ক জিয়া’ প্রবন্ধে বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণাদানকারী অজেয় এক সৈন্য (জিয়া)। গণমনে স্বাধীনতার চেতনা উদ্রেককারী অসীম সাহসী এক যোদ্ধা। পরবর্তীকালে অন্য কোন ভূমিকা পালন না করলেও তাঁর নাম লেখা হতো বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে।’ আমরা স্যার-এর বক্তব্যকে সমর্থন করে বলতে চাই- অনেক সময় একটি মহৎ ও গঠনমূলক কাজ শত কাজের চেয়ে উত্তম। শরৎ বাবু সম্পর্কে বলা হয়, তিনি কেবল ‘মহেশ’ গল্পটি লেখার পর অন্য কোন গল্প বা উপন্যাস যদি নাও লিখতেন সেক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে তার মর্যাদার আসনের কোনো ঘাটতি হত না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা লাভের পরে ব্যারাকে ফিরে যান। কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে তাঁকে আবার এই নবীন রাষ্ট্রের হাল ধরতে হয়।
তাঁর প্রতিষ্ঠিত বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বৈরাচারী এরশাদের সময় এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আমলে বন্দি হয়ে আছে। জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি, গণতন্ত্রের মাতা, দেশনেত্রী বেগম জিয়ার দীর্ঘ নয় বছর রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম ও এদেশের ছাত্র-জনতা, রাজনীতিকদের ক্লান্তিহীন সংগ্রাম গণতন্ত্রকে মুক্ত করেছিল। কিন্তু সেই গণতন্ত্র আজ নয়া বাকশাল আর আধিপত্যবাদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত |
শেখ সাহেব বাকশাল কেন করেছিলেন সে বিষয়ে নানারকম বক্তব্য দিয়ে তার এ কাজকে জায়েজ করার নানা যুক্তি দেয়া হয়। নবীন জাতিকে পুনর্গঠনের কাজে বাকশাল নাকি খুব কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারত। বহু দল-মত থাকায় জাতির অগ্রগতি ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। শেখ সাহেব একদল করে সকলকে নিয়ে জাতি গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন ইত্যাদি। আমাদের কথা হলো- নানামতকে একত্রিত করে একটি গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেবার আরও অনেক পথ ছিল। সকল দল থেকে জ্ঞানী, গুণী ও দক্ষ রাজনীতিককে নিয়ে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা যেত। তার জন্য সকল দল ও সকল সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে একদলীয় সরকার গঠনের আবশ্যকতা ছিল কি? বাকশাল গঠন করে বাক্ ও ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করার আবশ্যকতা ছিল কি? আমি মনে করি বাক্ ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। স্বাধীনতাহীনতায় কেউ বাঁচতে চায় না। শত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও মানুষ বন্দি জীবনযাপন করতে চায় না। আর স্বাধীনতার মূল চেতনাই ছিল ব্যক্তির স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান ও পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো যদি ষড়যন্ত্র না করে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের সুযোগ দিত, সেক্ষেত্রে আমরা নিশ্চয় স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম না। আর স্বাধীনতা যুদ্ধের ডাক দিলেও পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা সে ডাকে সাড়া দিতো না। আমরা অধিকার ও মর্যাদা আদায়ের লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলাম। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুরকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণ জানালে গণতন্ত্রের বিজয় হত। আর গণতন্ত্রের বিজয়ের সাথে আমরা অধিকার ও মর্যাদা ফিরে পেতাম। দীর্ঘ ২৩ বছর আমরা শোষণ, বঞ্চনা ও অধিকার হারা হয়ে পরবাসীর মত জীবনযাপন করেছি। মানুষের মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও যন্ত্রণা জমা হয়েছিল। ’৭০ সালের নির্বাচনে সুযোগ পেয়ে মানুষ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। মওলানা ভাসানীর ন্যাপসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করে। ভোট বর্জন না করে শেখ সাহেব রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। মানুষ ভোটের মাধ্যমে তার রাগ, ক্ষোভ ও মনের পুঞ্জীভূত আক্রোশ মিটাতে সক্ষম হয়।
দুঃখের বিষয় ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত গণতান্ত্রিক অধিকার কয়েক মিনিটের মধ্যে পার্লামেন্টে বাতিল করে বাকশাল কায়েম করা হয়। আমি কয়েকটি লেখায় বলেছি, আজীবন গণতন্ত্রের জন্য, মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য-যে শেখ সাহেব সংগ্রাম করেছেন, তিনি কার প্ররোচনায় গণতন্ত্রের কবর রচনা করে একদলীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। একটি বহুত্ববাদী (Phualistic) সমাজকে এক দলের মধ্যে আনা সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনচেতা মনমানসিকতার অধিকারী। তারা কষ্টসহিষ্ণু ও খুবই রাজনীতিসচেতন। রাজনীতিকদের কর্মকা- তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। ভয়ে ও ভাবে অনেক সময় সত্য কথা বলে না। তবে সুযোগ পেলে সুযোগের ষোলআনা সদ্ব্যবহার করে। বাকশাল গঠন করে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত করায় মানুষ খুশি হতে পারেনি। আড়ালে-আবডালে নানারকম আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তোলে। ১৫ আগস্ট শেখ সাহেব সপরিবারে নিহত হন। ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। জিয়াকে বন্দি করা হয়। অশান্তি, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা সমাজে বিরাজ করে। দেশ থেকে আইনের শাসন নির্বাসিত হয়। প্রশাসনযন্ত্র স্থবির হয়ে পড়ে। এক ঐতিহাসিক প্রয়োজনে সিপাহী-জনতা ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে ক্ষমতার মসনদে বসায়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দেশের ও প্রশাসনের শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তিনি বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন। জিয়াউর রহমান সৈনিক, অতএব তিনি রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝেন না বলে যারা তাঁর সমালোচনায় মুখর তাদের উদ্দেশে আমি বলতে চাই- জিয়াউর রহমান সত্যিকার গণতান্ত্রিক মনমানসিকতার অধিকারী ছিলেন। ক্ষমতার মসনদে বসেই তিনি মানুষের অধিকার ও মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে উন্মুখ ছিলেন। বিচারপতি সায়েমের পদত্যাগের পর জিয়াউর রহমান স্বাধীনভাবে দেশের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের অধিকার পান। তিনি নিজে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন ও নিষিদ্ধ ঘোষিত সকল রাজনৈতিক দলকে বৈধভাবে রাজনীতি করার আদেশ জারি করেন। রাজনীতিক না হয়েও সত্যিকার দেশপ্রেমিক শাসকের ভূমিকা পালন করেন। ২ বছরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করে জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরে দিয়ে তাদের অধিকার ও মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। জিয়াউর রহমান ব্যারাক থেকে এসে গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন করেন। তিনি প্রয়োজনের বেশি একদিনও সামরিক শাসন চালু রাখেননি। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না করলে দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসত কিনা সংশয় রয়েছে। ক্ষমতাসীন হয়েই জিয়া রেডিও বাংলাদেশে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বলেন যে, তিনি সাময়িকভাবে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর অনুরোধে ও দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, সাধ্য অনুযায়ী তিনি তাঁর কর্তব্য পালন করবেন। দেশকে এগিয়ে নিতে তিনি সকলের ঐক্য ও কঠোর পরিশ্রম প্রত্যাশা করেন। সকলকে অবিলম্বে কাজে যোগ দেবার নির্দেশ দেন। শুরু হলো দেশ গড়ার মহাযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার সম্মিলিত উদ্যোগে যে বিপ্লব সংঘটিত হয় তার ফল ভোগ করে সমগ্র দেশবাসী। খোন্দকার মুশতাক বিচারপতি সায়েমের নিকট ক্ষমতা দিয়ে সরে পড়েন। সংবিধান স্থগিত করা হয়। সামরিক আইন জারি করা হয়। তবে জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন ছিল গণমানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতা পাবার পরে তিনি বেসামরিকীকরণের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন ও ১৯ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল দেশ ও সমাজের উন্নয়ন সাধন করা। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে তিনি এ বাহিনীকে চৌকশ ও শক্তিশালী বাহিনীতে পরিণত করার যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আগেই বলেছি তাঁর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল মানবকল্যাণ। পদ-পদবি বা ক্ষমতার প্রতি জিয়ার লোভ ছিল না বললেই চলে। দেশের শাসনভার কাঁধে নেবার পর গ্রাম-উন্নয়ন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে গ্রামীণ জনপদের গরীব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। যুব সমাজকে জাতীয় উন্নয়নে শরিক করে জাতীয় উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করেন। তিনি নিজে খাল খনন, রাস্তা তৈরি, গাছ লাগানো প্রভৃতি উন্নয়নমূলক কাজ করে সকলকে এসব কাজে উদ্বুদ্ধ করে জড়িত করেন। জিয়া নির্লোভ, নিরহংকারী- দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিকে তিনি ঘৃণা করতেন। তাঁর কাছে আপন-পর বলে কোনরকম বিবেচনা ছিল না। দেশের সকল মানুষকে তিনি সমান চোখে দেখতেন। তাঁর অসংখ্য কর্মকান্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ১. সংবিধানে বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযোজন, ২. খাল খনন কর্মসূচি, ৩. জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি, ৪. রাষ্ট্রীয় পরিচিতি দান, ৫. সার্ক প্রতিষ্ঠায় অবদান, ৬. গণতান্ত্রিক শাসন প্রবর্তন।
প্রেসিডেন্ট জিয়া ছিলেন একজন খাঁটি ধার্মিক। তিনি উপলব্ধি করেন এদেশের ৯০% মুসলমান। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবশত তিনি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম সংযুক্ত করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর আবেগ ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান জানান। অন্যান্য ধর্মের মানুষের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা বজায় রাখতে সামাজিক ন্যায়বিচার সংবিধানে জুড়ে দেন। এতে হিন্দু-মুসলিম সকলের প্রতি সমআচরণ ও ব্যবহার নিশ্চিত হয়। তাঁর সময়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। কৃষিক্ষেত্রে যুগান্তকারী উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য তিনি ১৯৭৯ সালের ১ নভেম্বর খাল খনন কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। তিনি নিজে খাল খনন করে অপরকে উদ্বুদ্ধ করেন। গ্রীষ্মকালীন সেচের সুবিধার্থে ৯০০০ মাইল নতুন খাল খনন ও পুরনো খাল পুনঃখনন করেন। ৬ লাখ টন অতিরিক্তি খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে এই খাল খনন পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তিনি মনে করেন, শুষ্ক মৌসুমে তাঁর পরিকল্পনা কৃষকদের অনেক উপকারে আসবে। তাঁর পরিকল্পনা ছিল স্বেচ্ছাশ্রমে কাজটি সম্পন্ন করা। তবে স্বেচ্ছাশ্রমে জনগণ এগিয়ে না আসায় কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু করেন। স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠনের রূপকার জেনারেল জিয়ার এই পরিকল্পনা দেশের খাদ্য উৎপাদনে প্রভূত সহায়তা দিয়েছিল। তাছাড়া খালের দু’পাশে ফলদ বৃক্ষ লাগায়ে কিছুটা ফলের চাহিদা মিটানো সম্ভব হয়। জিয়া বাড়ির চারপাশে পতিত জায়গায় শাক-সবজি, ফলমূল ও ফলদ বৃক্ষ লাগাতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। দেশ খাদ্যে অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়। বিশ্বসভায় হতদরিদ্র ‘তলাবিহীন ঝুড়ির’ অপবাদ ঘুচায়ে দেশকে এক মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। এভাবে তিনি গ্রামীণ জনপদের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশোধন করে ‘বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহিম’ সংযুক্ত করে ক্ষান্ত হননি। এদেশের মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় অক্ষুণœœ রেখে রাষ্ট্রীয় পরিচয় বাংলাদেশী সংযোজন করেন।
বাঙ্গালী, অবাঙ্গালী, চাকমা, মারমা, উড়াও, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় ঠিক রেখে সকলকে বাংলাদেশী হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিতি দেন। তার বাংলাদেশী পরিচিতির মধ্যে সকলের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিচয় অক্ষুণœ থাকে। শুধু ভাষার ভিত্তিতে বাঙালী জাতীয়তাবাদ মুছে ফেলে বাংলাদেশী পরিচয়ে সকলকে এককাতারে শামিল করেন। এখন আর কাউকে বলতে হয় না, ‘আমি বাঙ্গালী নই, আমি চাকমা’। বাংলাদেশী পরিচয়ের মধ্যে সকলে গৌরবান্বিত হয় ও মনে কোন রকম খেদ বা গ্লানিমা বহন করতে হয় না। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। তাঁর নীতি ছিল- সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে শত্রুতা নয়।
জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করায় জিয়াউর রহমান বিশ্বে নতুনভাবে পরিচিতি লাভ করেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তিনি সার্ক প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার ভিত্তিতে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সাতটি দেশ নিয়ে সার্ক প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। তিনি শুধু স্বপ্ন দেখে ক্ষান্ত হননি, তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে কার্যকরী পদক্ষেপ নেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে সার্কের একটি কাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হন। অবশ্য কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্র ও কূটকৌশলে জিয়াউর রহমান সার্ক প্রতিষ্ঠা দেখে যেতে পারেননি। তাঁর অকাল মৃত্যু বাংলাদেশের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের সার্ক প্রতিষ্ঠার স্বপ্নকে বিলম্বিত করে। অবশ্য জিয়ার মৃত্যুর পর সার্ক প্রতিষ্ঠিত হলেও সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জিয়া মনেপ্রাণে একজন খাঁটি গণতন্ত্রী নেতা ছিলেন। সৈনিক জীবনের কঠোর নিয়ম-কানুন তিনি সারাজীবন অনুসরণ করেছেন। বাকশালের জগদ্দল পাথর সরিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন চালু করে এদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করে সকলের মত ও পথকে অবারিত করেছেন। পত্রিকাগুলোর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ায় মানুষ প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে পারে।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক সংকট চলছে, এসময় জিয়াউর রহমানের মত উদার, মহানুভব ও খাঁটি দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের আবশ্যক। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বহুদলীয় গণতন্ত্র স্বৈরাচারী এরশাদের সময় এবং বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বন্দি হয়ে আছে। জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরি, গণতন্ত্রের মাতা, দেশনেত্রী বেগম জিয়ার দীর্ঘ ন’বছর রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রাম ও এদেশের ছাত্র-জনতা, রাজনীতিকদের ক্লান্তিহীন সংগ্রাম গণতন্ত্রকে মুক্ত করেছিল। কিন্তু সেই গণতন্ত্র আজ নয়া বাকশাল আর আধিপত্যবাদের থাবায় ক্ষতবিক্ষত। বর্তমান সরকার গণতান্ত্রিক শাসনকে পদদলিত করে আবার অঘোষিত বাকশাল চালু করে। মানুষ ভোটের অধিকার হারায়ে মর্যাদাহীন ও মূল্যহীন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিরোধীদলকে এমনভাবে কোণঠাসা করা হয়েছে যে, তারা স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। সরকারের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা না থাকায় কর্তৃত্ববাদী শাসন চালাচ্ছে। এ সরকারের হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিতে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে গিয়ে বেগম জিয়া বিনাদোষে জেলখানায় অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার নীতি ও আদর্শ অমর-অক্ষয়। আমরা আশা করি জিয়াউর রহমানের প্রয়াণ দিবসে, তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বেগম জিয়ার সাথে এদেশের লক্ষকোটি জনতা একতাবদ্ধ হয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করবেন। আমরা এই মহৎপ্রাণ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি ও বেগম জিয়ার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সফল পরিণতি প্রত্যাশা করছি।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিশাল কর্মপরিকল্পনা মিশন ও ভিশন বিশ্বে তাঁকে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। ১৯৭৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর ভারত সফরে গেলে ভারতের রাষ্ট্রপতি নীলম সঞ্জিব রেড্ডি ভোজসভায় জিয়াকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক ও সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বাংলাদেশের কৃতী সন্তান। বাংলাদেশকে আধুনিক, উন্নত, সমৃদ্ধ, উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করা ছিল তাঁর স্বপ্ন। মাত্র সাড়ে চার বছর ক্ষমতায় থেকে তিনি উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সৃষ্টিতে অবদান রাখেন। তাঁর অভাব এদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। দুর্নীতি, দুঃশাসন, গুম, খুন, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও বিনা বিচারে হত্যা সমাজ কাঠামোকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জিয়া মৃত হলেও তাঁর রেখে খাওয়া প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, কৃষকদল, তাঁতিদল, শ্রমিকদল, জাসাস প্রভৃতি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন জিয়ার নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করছে। তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এসব সংগঠন বাংলাদেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় অসামান্য অবদান রাখবে বলে প্রত্যাশা করছি।
লেখক : প্রফেসর, দর্শন বিভাগ ও সাবেক ডীন, কলা অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়