অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিনুর রহমান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
‘রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিবেদিত জিয়া’
প্রকাশ: ০৯:৪৬ পিএম, ১৮ জানুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ১১:১৪ পিএম, ২ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
মহান সৃষ্টিকর্তা যুগে যুগে পৃথিবীতে মানব জাতির কল্যাণ এবং মুক্তির জন্য যে সব ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের আর্বিভাব ঘটিয়েছেন, জিয়া তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এসব মহাপুরুষ বিভিন্ন ভূ-খন্ডে তাঁদের অবদানের জন্য ইতিহাসে আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলাদেশে জিয়া’র আর্বিভাব তেমনি একটি ঘটনা।
উপনিবেশ- উত্তর তৃতীয় বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নেতাদের জীবন আবর্তিত হয়েছে মূলত : দুটি ধাপে। প্রথম ধাপটি উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায়। দ্বিতীয় ধাপটি দেশ ও জাতি গঠনে ব্যাপৃত। উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম সংগঠিত করার কাজে জিয়া সরাসরি অংশগ্রহন না করলেও পেশাগত কারণে শোষণ ও নির্যাতনে জিয়া ছিলেন সর্বদা সচেষ্ট, যা পরবর্তীতে দেশ মাতৃকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বাধীনতার ঘোষনা এবং সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়। রাজনীতি হলো রক্তপাতহীন যুদ্ধ এবং যুদ্ধ হলো রক্তপাতময় রাজনীতি। কখনো কখনো রাজনীতি রক্তপাতময় হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে প্রচণ্ড ঝুঁকিপূর্ণ (মাসুম, ২০১২)। ‘আনুগত্য ও নির্দেশ পালনের দীক্ষায়’ দীক্ষিত একজন সেনা কর্মকর্তার পক্ষে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানো ছিল নিঃসন্দেহে জিয়া’র জন্য এক কঠিন সিদ্ধান্ত। যদিও এ বিদ্রোহের পেছনে ছিল তাঁর রাজনৈতিক চেতনা, ছিল মানবিক প্রবৃত্তি এবং নিজ ভূ-খন্ডের প্রতি গভীর দেশপ্রেম ও ভালোবাসা।
বাংলাদেশের ‘আইকন’ জিয়া’কে মানুষ প্রথম জানতে পায় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ইথারে ভেসে আসা চার শব্দের সেই বাক্য- ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ যা পুরো জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহনে (উল্লাহ্,২০১৬)। প্রফেসর রেহমান সোবহান, Untranquil Recollections: The Years of Fulfilment ––এ লিখেছেন “I spent the night of 27 March in my new refuge, that night we turned in on the radio and heard a faint broadcast by Major Zia, proclaiming the Independence of Bangladesh” (সোবহান, ২০১৬)।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জিয়াই সর্ব প্রথম ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে রাতে বিদ্রোহ করেন এবং চট্রগ্রামে তাঁর অধিনস্থ সৈন্যদের নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন এবং পরবর্তীতে ‘জেড ফোর্স’ এ নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধশেষে জিয়া আবারও তাঁর পেশাগত জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন।
যে মানুষটি জাতির ক্লান্তিকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের জীবনকে নিয়তির কাছে সমর্পন করেছিলেন তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি, জাতির আর একটি বড় সংকটে নিরব থাকার। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এ সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান আবারও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জিয়া’কে শীর্ষে নিয়ে আসে যা পরবর্তীতে রাষ্ট্র ও জাতি গঠণে ব্রত হন তিনি। জিয়া’র আদর্শ, জাতি গঠন, গণতন্ত্র বিনির্মাণ, জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে কর্মকৌশল নির্ধারণ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে নানামুখী কর্ম পরিকল্পনায় মনোনিবেশ করেন তিনি।
পৃথিবীর ইতিহাসে যারা সমরনায়ক থেকে জাতি ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্রনায়ক হয়েছেন তাঁদের সকলেই সফল না হলেও কেউ কেউ সফল হয়েছেন। সমকালীন ইতিহাসে কামাল আতার্তুক, মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার, ফরাসি প্রেসিডেন্ট দ্য গল, জামাল আবদুন নাছের এবং বাংলাদেশে জিয়া। রাজনীতি অধ্যয়নের পণ্ডিত এস পি হান্টিংটনের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন- "A great military leader is one who can imagine, turning a conflict into equal opportunities for adversaries in a situation where people can make a living, trading peacefully, violence, become costly choices‟।
নেতৃত্ব একটি নৈতিক ও সামাজিক অবস্থান। নেতৃত্ব ব্যক্তির সেই কাঙ্খিত গুণ বা গুনাবলী, যা সমাজের অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদের উদ্দীপ্ত করতে পারে। Chester I Bernard বলেন- "Leadership refers to the quality of the behavior of individuals whereby they guide people or their activities in an organized effort‟। নেতৃত্ব হলো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের এমন সব গুনাবলী, যার মাধ্যমে তিনি বা তাঁর সংগঠিত কর্মোদ্যোগে জনগণের অথবা রাষ্ট্রের কার্যপ্রণালির দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। সাধারণ নেতৃত্ব থেকেই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব বিকশিত হয়ে থাকে। কখনও বা সুপ্ত নেতৃত্ব বিশেষ পরিবেশ বা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আবার কখনও কখনও পরিবেশ, পেশাগত অবস্থান এবং ঘটনা প্রবাহ ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে সমাজ, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে প্রতিষ্টিত করতে পারে (মাসুম- ২০১২)। সময়ের পথ পরিক্রমায় জিয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে আর্বিভূত হন।
দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ভারতের অভ্যুদয়ের এক দশক আগে ১৯ জানুয়ারী ১৯৩৬ সালে জিয়া জন্ম গ্রহণ করেন। বগুড়া জেলার বাগবাড়ি জিয়া’র পূর্ব পুরুষের বাসস্থান হিসেবে পরিচিত হলেও প্রকৃত পক্ষে একই জেলার গাবতলি উপজেলার মহিষাবান গ্রাম ছিল তাঁদের মূল বসতি। পিতা মুনসুর রহমান ও মাতা জাহানারা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান জিয়া। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘কমল’ যা হয়ত অনেক পাঠকেরই জানা নেই। জিয়া’র হাতে খড়ি পিতার কর্মস্থল কলকাতায়। শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ডেভিড হেয়ার স্কুলে। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালে করাচি এসে একাডেমি স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে জিয়া করাচি ডি জে সায়েন্স কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকের পর সে বছরই কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে অফিসার ক্যাডেট হিসাবে যোগ দেন (উল্লাহ্, ২০১৬)।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়া’র আর্বিভাব সনাতনী রাজনীতিকরা খুব সহজে গ্রহণ করেননি। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যা সনাতনী রাজনীতিকদের ব্যর্থতাকেই প্রমাণ করেছে। সেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য রাজনীতিকরা কুৎসিত সমালোচনার সূত্রপাত করেন, কিন্তু এর ফলে ইতিহাস পরিশীলিত হয়নি, বরং অনুল্লেখিত বা অনুদঘাটিত ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অবশ্য এ অভিযোগ শুধু রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের লেখাপড়া জানা বিজ্ঞ মানুষরাও নিজেদের অনেক ভূমিকাকেই প্রয়োজনে অস্বীকার করতে স্বচ্ছন্দ্যবোধ করেন (আহমদ ২০০৪)।
স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব জিয়া’কে জাতীয় জীবনের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে আসে। তখন দেশে কোন নিয়ন্ত্রণ কাঠামো অক্ষত ছিলনা। দেশে ছিল না কোন রাজনৈতিক দল। প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল স্থবির। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার অব্যবহিত পরেই, ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্ব মুহূর্ত দেশের সকল ডানপন্থী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। “১৯৭৫ সালে একদলীয়শাসন ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের বামপন্থী দলসহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরে খন্দকার মোশতাক আহমদ বাকশালকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে ওই সময়ে গণতান্ত্রিক শাসন কেন, যে কোন ধরণের শাসনের জন্য জনসংযোগ অথবা যোগাযোগ কিংবা নির্দেশ দানের লক্ষ্যে যে অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে রাজনৈতিক দলেরও কোন অস্তিত্ব ছিল না।
অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা হয়ে পড়ে অকার্যকর। না ছিল তার গতিশীলতা, না ছিল কোন সুসংহত প্রশাসনিক কাঠামো। ছিল না নির্দেশ পালন অথবা নির্দেশ দানের কোন সক্ষমতা। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশের ফলে প্রশাসনিক দক্ষতা ও তার নৈতিক মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে উপনীত হয়। এমনকি সামরিক বাহিনীও ছিল অত্যন্ত করুণ অবস্থায়, অন্ততপক্ষে চারটি খন্ডে যা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সামরিক বাহিনীর একাংশ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বামঘেঁষা হয়ে ওঠে। তাওয়াবের নেতৃত্বে আর এক অংশ দক্ষিণপন্থী ভাবধারায় প্রবল হয়ে ওঠে। সামরিক বাহিনীর আর একটি অংশ খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্ষমতা লাভের জন্য ভীষণভাবে সুযোগ সন্ধানী হয়ে পড়ে। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারীরা এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে সুসংহত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে নিজেদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এই অবস্থায় দেশব্যাপী সূচনা হয় গভীর অনিশ্চয়তার।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে ওঠে দ্বন্দ্বসঙ্কুল, ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। ব্যক্তিকেন্দ্রিক অশুভ প্রবণতায় চারদিকে সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তার ঘণ কুয়াশা। ক্ষমতাশ্রয়ীদের চক্রান্তে জনজীবন হয়ে পড়ে অতিষ্ঠ। এমনি এক সংকটময় মুহূর্তে জিয়াকে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করতে হয়। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর অগ্রবতী চিন্তা, সুগভীর জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে” (আহমদ, ২০০৪)।
জিয়া নিহত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই জিয়া বিরোধীরা তাঁর মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করার জন্য এক অশ্লীল লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। যে মানুষটি বিশ্বসভায় বাংলাদশের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছিলেন, জাতিগঠনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সে মানুষটির মর্যাদাকে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর প্রতিপক্ষরা এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করেনি। তাঁকে কলুষিত করার জন্য এমন কোনো মিথ্যা ছিল না, যার আশ্রয়তারা নেয়নি। এই মিথ্যার চর্চা এখনো অব্যাহত আছে। জিয়া বিরোধীরা উপলব্ধি করেছিলেন, একজন জীবিত জিয়ার চেয়ে একজন মৃত জিয়া অনেক বেশী শক্তিশালী এবং কর্মের সাফল্য তাঁর জীবনকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা তাঁর আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তাকে কখনও মেনে নিতে পারেননি, মেনে নিতে পারেন না। ঘরে বাহিরে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সত্বেও জিয়া সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি ও প্রশংসা অর্জন করেন।
নিউ ইয়র্ক টাইমস্ জিয়া’কে "Hard working and apparently incorruptible in personal life‟ বলে অবিহিত করে। লন্ডন টাইমস্ লিখে- "By and large president Zia kept the country away from hopes and pointes quarrels"। প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তালুকদার মনিরুজ্জানের ভাষায় "Zia was on the few rulers from the military profession who understood the need for politics and politicians, the tend to prescribe simple unitary solutions to complex political problems. Zia clearly understood the destination in the functional roles of politics and arms. As he used to say frequently, politics should be met by politics, fire power by fire power" (মনিরুজ্জামান, ১৯৮২)। “একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একথা আজ স্বীকার করতেই হবে যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেসব মহান ব্যক্তিত্ব নিজেদের জীবন, দেশ, জাতি এবং জনগণের কল্যাণে নিবেদন করেইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, জিয়া তাঁদের মধ্যে অন্যতম” (মন্ডল,২০০৩)।
একজন খ্যাতিমান কূটনীতিক হেনরী কিসিঞ্চার রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন, “The Statesman‟s duty is to bridge the gap between experience and vision" সত্যিই জীবনের বাস্তবতা রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতার সমন্বয়ের এক বিরল সমাহার ঘটেছিল জিয়া’র জীবনে” (মাসুম, ২০১২)।
জিয়া’র ব্যক্তিগত সততা, দেশপ্রেম, কঠোর পরিশ্রম, শৃংঙ্খলাবোধ, দ্রুত সিন্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতা, প্রবল ইচ্ছাশক্তি, সাধারণ জীবন যাপন, আত্মসংযম, আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থাও বিশ্বাসআধুনিক বাংলাদেশ বির্নিমানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ন বাংলাদেশ এবং জনগণের কল্যাণই ছিল জিয়া’র প্রথম ও প্রধান সাধনা। এ লক্ষ্যে তিনি প্রখ্যাত গীতিকার মনিরুজ্জামান মনিরের লেখা গানটি নির্বাচন করেন।
"প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ
জীবন বাংলাদেশ, আমার মরণ বাংলাদেশ"।
লক্ষ কোটি বাংলাদেশীর হৃদয়ে এ গানের মূর্ছনায় তাদের মানসপটে উজ্জল হয়ে ওঠে প্রিয় নেতা জিয়া’র ছবি, যা প্রতিফলিত হয়, সোনালী ধানের শীষে।
জিয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্র, সমাজ এবং ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সেই বিরল রাষ্ট্রনায়ক, যিনি তাঁর জাতীয় রাষ্ট্রের গণমানুষের হৃদয় বুঝতে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সক্ষমছিলেন। জিয়া যুদ্ধ বিধস্ত অর্থনীতিতে রক্তসঞ্চালণ করেছেন, রাজনীতিতে এনেছেন স্থিতিশীলতা এবং সমাজে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করেছেন। সংস্কৃতিতে স্বকীয়তা আনয়ন, সেনাবাহিনীতে পেশাদারিত্ব এবং জন প্রশাসনে মর্যাদা ফিরিয়ে এনেছিলেন।
“একথা আজ সূর্যের আলোর মত সত্য, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যর্থ ও অকার্যকর করে বিশ্বের মানচিত্র থেকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এক উন্মাদনায় মত্ত হয়ে উঠেছে ফ্যাসিস্ট, সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদীরা এ লক্ষে দেশের ভিতর এবং বাহিরে দু পক্ষই সর্বশক্তি দিয়ে নিয়োজিত রয়েছেন তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক তাবেদার ও আজ্ঞাবাহক গণমাধ্যমকে। এ কুচক্রি সম্মিলিত শক্তি টার্গেট করেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবজ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত জিয়া’র রাজনৈতিক দর্শন ‘বাংলাদেশী জাতীয়াতাবাদ’ এবং তাঁর পরিবার” (সিকদার, ২০১১)।
আমার এই প্রবন্ধ উপস্থাপনের মূল উদ্দেশ্য জিয়া নিজের প্রয়োজনে নয়, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নিবেদিত হয়ে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে ১৯৭১ এবং ১৯৭৫ সালে জাতির এক ক্লান্তিকালে কান্ডারি হিসেবে আর্বিভূত হন। জিয়া’র অনুসারী, কর্মী, সমর্থক এবং রাজনীতিবিদদের উচিত জিয়া’র আদর্শ এবং দেশ ও জাতি গঠনে তাঁর ভূমিকাকে নিয়ে বেশি বেশি চর্চা করা এবং তা দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণের মাঝে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরা।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের নেপথ্যে অনেক কীর্তিমান ব্যক্তিত্বের অবদান স্বীকার্য। তাঁদের কেউ কেউ অনেক সীমাবদ্ধতার ভিতর দিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছেন, আমরা তাদের ভুলে যাই। খাজা সলিমুল্লাহ্, নওয়াব আলী চৌধুরী, শেরে বাংলা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। তাঁরা প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জাতিকে উজাড় করে দিয়ে গেছেন (সিকদার, ২০১১)।
কিন্তু জিয়া এদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি একবার নয়, বার বার জাতীর সংকটময় মুহূর্ত্বে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কান্ডারি হিসেবে আর্বিভূত হয়েছেন। (এক) ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন ব্যর্থ, সংকট- সন্ধিক্ষণে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে জাতিকে উজ্জিবীত করেছেন। (দুই) ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে যে কঠিন সময় বাংলাদেশ অতিক্রম করেছে জিয়া তা সফলভাবে মোকাবেলা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে প্রফেসর এমাজ উদ্দিন আহমদ মন্তব্য করেন- "Zia saved Bangladesh army from an impending doom‟ জিয়া সেই ব্যক্তি যার কোন ক্যু সংশ্লিষ্টতা নেই। জিয়া ক্ষমতা দখল করেননি বরং ঘটনা প্রবাহ এবং রষ্ট্রের চরম প্রয়োজনে তাঁকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আসনে সিপাহী-জনতার বিল্পব অধিষ্ঠিত করেছে মাত্র। তাঁর কৌশলী নেতৃত্ব বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত, ভারসাম্য নীতি বাংলাদেশকে বহি: শত্রুর আক্রমণ ও গৃহযুদ্ধের আশংকা থেকে মুক্ত করেছে। (তিন) রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি চুপচাপ বসে থাকেননি কিংবা সামরিক আইন দীর্ঘায়িত করেননি। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে গণতন্ত্রকে অবমুক্ত করে বহু দলীয় গণতন্ত্রের পথ উন্মুক্ত করেন, রাজনৈতিক কর্মকান্ড সচল করেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। দেশের শান্তি, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা আনায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সর্বোপরি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ প্রণয়ন করেন। যার মাধ্যমে জাতীয় সংহতি ও জাতীয় ঐক্য বির্ণিমানে মনোযোগী হয়ে ওঠেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি জনমানুষের হৃদয়ে স্থান করে নেন। জিয়া উপলদ্ধি করেছিলেন বাংলাদেশকে ‘টেকসই’ (Sustainable) রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা মাধ্যমে অগ্রসর হতে হবে।
শহীদ জিয়া হতাশায় নিমজ্জিত জাতিকে আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি বহুধাবিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, দেশকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। “তলাবিহীন ঝুড়ি” অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটি আত্মনির্ভরশীল, মর্যাদাপূর্ণ এবং টেকসই (Sustainable) বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল প্রদত্ত একটি রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচী ১৯ দফা প্রণয়ন করেন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণায় জনগণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার তথা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির যে আকাঙ্খা ও চেতনা তার ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশের যাত্রাপথ রচনায় জিয়া’র ১৯ দফা কর্মসূচি ছিল একটি মাইল ফলক।
ভূ-রাজনৈতিক কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের উত্তরে হিমালয় ও দক্ষিণে বঙ্গপোসাগরের মাঝখানে সংকীর্ণ পরিসরের এই দেশের পূর্বে এশিয়া এবং পশ্চিমে দক্ষিণ এশিয়া। একারণে আঞ্চলিক এবং সার্বিক বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিশেষ কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। ফলে জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা, অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। এদেশের মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাছাড়া স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের সমর্থন, সহযোগীতা এবং আকৃষ্ট করার লক্ষে শাসনতন্ত্রের মূলনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরী ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ মানেই গ্রাম। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য গ্রাম-বাংলার উন্নয়ন একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এ লক্ষ্যে জিয়া খাল খনন, বৃক্ষ রোপণ, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন, বয়স্ক শিক্ষা এবং কৃষির আধুনিকায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি তথা জাতীয় অর্থনীতিকে অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দেন।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারীদের শিক্ষিত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে যথাযোগ্য মর্যাদা সুনিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব দেন। তাছাড়াও যুবসমাজকে সুসংহত ও উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে যুব কমপ্লেক্স স্থাপন করেন। দেশের বে-সরকারী খাত ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহ ও প্রণোদনা প্রদান করেন। শিল্প কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক বান্ধব সম্পর্ক ও পরিবেশ গড়ে তোলার উপর জোর দেন। এছাড়াও তৈরী পোষাক শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে তরান্বিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সরকারী চাকুরীজীবিদের প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে নিয়োজিত থেকে দূনীতিমুক্ত, ন্যায় ভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেন। প্রশাসনিক সেবা ও উন্নয়ন জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণসহ স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করেন।
সর্বোপরি, তিনি বিশ্বাস করতেন, সীমিত সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে না পারলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। অন্তঃ এবং অন্তঃরাষ্ট্রীয় (Intra and Inter State Relations) সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধ অবসানে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শুধু দেশেই নয় বর্হিবিশ্বেও সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য রাষ্ট্র এবং বিশ্ব পরিমন্ডলে সকল রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা জরুরী। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্বেও শাসনতন্ত্রে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণে বদ্ধ পরিকর ছিলেন।
জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় সংহতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল জাতিসত্তা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শনে পরিচিত করে তোলেন। এ প্রসঙ্গে জিয়া’র নিজের লেখা- ‘একটি জাতির জন্ম’ যার কিছু অংশ উল্লেখ করা হলো- “বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ একটি চেতনা। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’দর্শন শত শত বর্ষ ধরে এদেশের সর্বস্তরের জনগণের অন্তরে চির জাগরূক রয়েছে। যুগ যুগান্তরের দেশ প্রেমিকদের হৃদয়ের মর্মমূলে নিহিত তাদের সর্ব উৎসাহ, উদ্যোগ ও প্রেরণার উৎস এই দর্শন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিমূলে রয়েছে, শোষন মুক্ত সমাজের স্বপ্ন। শোষন মুক্ত সমাজ বলতে- ধর্ম-বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার মে․লিক চাহিদা পূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন- বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে- একটি শোষনমুক্ত সমাজ যা অত্যন্ত বাস্তব ও প্রগতিশীল একটি সমাজ, যাতে থাকবে সমতা, নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার”।
জিয়ার নেতৃত্বে খুব অল্প সময়ে সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি কঠিন সেতু বন্ধন সৃষ্টি করেছিল যা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। জিয়া বলেছিলেন- “I will make politics difficult” (মাসুম, ২০১২)। এর শাব্দিক অর্থ ‘রাজনীতি কঠিন করা’ বোঝাতে বা বিধি-নিষেধ যুক্ত করতে তিনি একথা বলেননি। তাঁর এ কথার অর্থ ছিল ‘ব্যাক টু দ্য ভিলেজ’- বাংলাদেশের গণমানুষের পীঠস্থান গ্রামে ফিরে যেতে রাজনীতিবিদদের বাধ্য করা এবং রাজধানী কেন্দ্রীক প্রাসাদ রাজনীতির বেড়াজাল থেকে জনগণকে মুক্ত করা।
২০২১ সালে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখনও আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে বিশ্বপরিমন্ডলে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়নি। প্রশাসন ও সমাজের সকলস্তরে দূর্নীতির সূচক বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ জনগণ সুফল থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়াও সামাজিক বৈষম্য, মানবাধিকার লংঘন, ধর্ষন, নারী নির্যাতন, সীমান্ত হত্যা, পরনির্ভরশীল পররাষ্ট্রনীতি, নিয়ন্ত্রিত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আধিপত্যবাদের প্রভাবের ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আকাঙ্খাগুলো এখনও সুদূর পরাহত। গণতন্ত্র, মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আজ এক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন।
সামাজিক ন্যায় বিচার, সামাজিক ও ধর্মীয় এবং মানবিক মূল্যবোধ আজ প্রায় সর্বক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভে․মত্ব চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন। দূর্নীতি, কালোটাকা এবং মাদকের প্রভাবসমাজের প্রতিটি স্তরকে গ্রাস করেছে। বেকারত্ব এবং অদক্ষ বৃহৎ জনগোষ্ঠী আজ হতাশায় নিমজ্জিত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনসেবার চাইতে রাজনৈতিক নির্দেশ পালনকেই মুখ্য মনে করে। সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যত অকার্যকরে পরিণত হয়েছে। প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি ও নির্যাতন জনজীবনকে করেছে বিপর্যস্ত। ফলশ্রুতিতে আইনের শাসনের জায়গায় পেশী শক্তির অবারিত আস্ফালন এবং সমাজের সর্বস্তরে আতংকের পরিবেশ বিরাজ করছে। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
“রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জিয়া মহান দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। শাসন-প্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশাসকদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে পেশাদারিত্ব সৃষ্টিতে মনোযোগী হন। নিজে দল গঠন করেন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত দলসমূহের পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং মানুষের বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবর্তনসহ রাজনৈতিক অধিকারসমূহ অবমুক্ত করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জাতীয়, দলীয় নয়। তাঁর পথ ছিল সর্বব্যাপক, সংকীর্ণতার গুহায় আবদ্ধ নয়। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। অতীতের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ভবিষ্যৎমুখী হয়েই তিনি পথ চলেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে প্রভাব বা বৈভবের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ না করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে দেখতে থাকেন। তিনিই সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন যে, মাটি আর মানুষই হল দেশ। কিছু সংখ্যক নগর-শহরে বসবাসকারী জনসমষ্টির উন্নতি বিধানই যথেষ্ট নয়। জাতীয় অগ্র্রগতির জন্য প্রয়োজন শহর-গ্রামাঞ্চলের সুষম উন্নয়ন” (আহমদ, ২০০৪)।
এই লক্ষ্যে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। জানতে চেয়েছেন গ্রামের সমস্যা সম্পর্কে, গ্রামীণ জনগণের দুঃখ কষ্ট-বঞ্চনার কথা। তাঁর গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা, বিশেষ করে কৃষিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে গতিশীল করার চিন্তা-ভাবনা, খাল খনন ও বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন এদিক থেকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাঁর মতে দেশের অগ্রগতির অর্থ হলো মানব সম্পদের উন্নয়ন এবং মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে তাকে অধিক ফলনশীল করা।
জিয়া বিশ্বাস করতেন, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এবং সামগ্রিক দিক থেকে বিধস্ত বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট বলয়ে আবদ্ধ রেখে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করলে উন্নত এবং সমৃদ্ধ দেশ গড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি সফলতার সাথে বিশ্বের সকল দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ইন্দো-সোভিয়েত বলয় থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। পূর্ব এশিয়ায় চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন নতুন বন্ধু সংগ্রহ করে, অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানের সঙ্গে হৃদ্যতা স্থাপন করে সৃষ্টি করেন নতুন অধ্যায়। ইঙ্গ-মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশর অর্থনীতিকে সংশ্লিষ্ট করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে তৈরী পোষাক শিল্প প্রবেশ করিয়ে এবং রেমিট্যান্স উপার্জনে মধ্যপ্রাচ্যে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানীর মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
তিনি অনুভব করেন, আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতার সূত্র বিস্তৃত না হলে জাতীয় অগ্রগতি প্রতিনিয়ত ব্যাহত হতে থাকবে। তাই ভারত ও পাকিস্তান যেক্ষেত্রে চুপচাপ থেকেছে সেক্ষেত্রে জিয়ার নেতৃত্বে সৃজনশীল বাংলাদেশ অগ্রসর হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে।
সুতরাং স্বাধীনতার ৫০ বৎসর পূর্তিতে বাংলাদেশে এখনো অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা ধারাবাহিকভাবে জাতিকে বিভক্ত করে চলেছে। জাতি আজ বিরক্ত। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে বীরত্ব গাঁথা ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় ‘খেতাব’ও আজ অসহায়। দূর্ভাগ্যজনকভাবে এ বিভাজন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রায় প্রতিটিক্ষেত্রে তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, শ্রমিক সংগঠনে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি প্রশাসনের বিভিনড়ব স্তরে এর দীর্ঘ ছায়া সবকিছুকে মলিন করে তুলছে। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় শুধু জাতীয় ঐক্য নয়, জাতীয় অগ্রগতির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জিয়া বিশ্বাস করতেন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাংলাদেশকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর মেধা তীক্ষন্ন দৃষ্টি ও প্রজ্ঞাদিয়ে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
জিয়া কখনও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে এমনকি পারিবারিক স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করেননি বরং জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী এবং জনগণের স্বার্থই ছিল মুখ্য ভূমিকায়। এটি তাঁর শ্রেষ্টতম অবদান যা আজও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বরণ করে। আজকের বাংলাদেশকে অনগ্রসরতার অন্ধকার গুহা থেকে আলোর রাজ্যে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার’ ভিতর থেকে দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে রাষ্ট্র ও জনগণের প্রয়োজনে নিবেদিত হয়ে জিয়া’র মত জাতির কান্ডারী হিসেবে আর্বিভূত হবেন এটিই আজ সকলের প্রত্যাশা।
লেখক- প্রফেসর এ কে এম মতিনুর রহমান, লোক প্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :
১. মন্ডল, শাহাদত হোসেন (২০০৩), জিয়া বাংলাদেশের অহংকার, শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
২. মাসুম, আবদুল লতিফ (২০১২), রাষ্ট্রনায়ক জিয়া, শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
৩. আহমদ, এমাজ উদ্দীন (২০০৪), রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান এবং আজকের বাংলাদেশ, শ্যালেন প্রিন্টার্স লিমিটেড, কমলাপুর ঢাকা।
৪. উল্লাহ, মাহফুজ (২০১৬), প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক জীবনী, অ্যাডর্ন পাবকিলেকশন, সেগুন বাগিচা, ঢাকা।
৫. সালেহ, আবু (২০০২), ৭ নভেম্বর স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের দিন, ফারহানা বুক্স, বাংলাবাজার ঢাকা।
৬. ওয়াহেদ, শাকিল (২০১২), জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও চলমান প্রসঙ্গ, শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
৭. সিকদার, আব্দুল হাই (২০১১), ‘জ্যেতির্ময় জিয়া এবং কালো মেঘের দল’ শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
৮. Moniruzzaman, Talukder (1982) „Group Interest and Political Changes: Studies on Pakistan and Bangladesh,‟ South Asian Publishers, New Delhi, P.204.
৯. Shobhan, Rehman (2016) „Untranquial Recolletions: The Years of Fulfilment,‟ Sage Publications, New Delhi, P. 347.