অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিনুর রহমান, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
শহীদ জিয়া’র ১৯ দফা কর্মসূচী ও এর বর্তমান উপযোগিতা
প্রকাশ: ০৭:৩৯ পিএম, ২৯ মে,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৩২ এএম, ২৩ নভেম্বর,শনিবার,২০২৪
দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতের অভ্যুদয়ের এক দশক আগে ১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬ সালে শহীদ জিয়া বগুড়ায় জন্মগ্রহন করেন। এর প্রায় তিন দশকের বেশী সময় পর স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ- যে দেশের জন্মের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। “বাংলাদেশের ‘আইকন’ জিয়াকে মানুষ প্রথম জানতে পায় ২৬মার্চ ১৯৭১ সালে ইথারে ভেসে আসা কণ্ঠস্বর থেকে। সে সময় একজন সামারিক কর্মকর্তার কণ্ঠ পুরো জাতিকে নাড়া দিয়েছিল, উদ্দীপ্ত করেছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণে। স্বাধীনতার পর শহীদ জিয়ার উত্তরণ ঘটে কালজয়ী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে। স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে জিয়ার ভূমিকা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে যারা সর্বময় ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিলেন তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়” ( উল্লাহ, ২০১৬)।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে, যা সনাতনী রাজনীতিকদের অনেকের ব্যর্থতাকেই প্রমান করেছে। সেই ব্যর্থতা ঢাকার জন্য রাজনীতিকরা কুৎসিত সমালোচনার সূত্রপাত করেন, কিন্তু এর ফলে ইতিহাস পরিশীলিত হয় নি, বরং অনুল্লেখিত বা অনুদ্ঘাটিত ইতিহাস সম্পর্কে মানুষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অবশ্য এ অভিযোগ শুধু রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের লেখাপড়া জানা বিজ্ঞ মানুষরাও নিজেদের অনেক ভূমিকাকেই প্রয়োজনে অস্বীকার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
”বাংলার উর্বর মাটিতে নেতৃত্বের সোনালী ফসল ফলেছে যুগে যুগে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অবদান এ সমাজ চিরদিন স্মরণ রাখবে। জনকল্যাণমুখী রাজনীতির সফল উদ্যোগকে স্বার্থক করে তুলতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সমগ্র সমাজে সচেতনতার মাত্রা উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। জাতীয় রাজনীতির লক্ষ্য হতে হবে দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কল্যাণ, এই কথাগুলো জোরেসোরে উচ্চারন করেছিলেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। রাজনীতিকে জনগণের কাছে অর্থপূর্ণ করে তুলতে স্বাধীনতা যে অপরিহার্য-সেজন্য জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে একদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতা এবং অন্যদিকে দখলদার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্মমতায় সম্বিৎহীন জাতির কাছে গভীর সংকটকালে স্বাধীনতার ঘোষণা দান এবং সদলবলে বিদ্রোহ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বহন করে জিয়াউর রহমান যে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল” (আহমদ, ২০০৪)। এইসব মহান ব্যক্তিত্বের বহুমুখী অবদানে সমৃদ্ধ হয়েই বাংলাদেশ মাথা উঁচু করেছে বিশ্বের দরবারে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে পরিচ্ছন্নভাবে অগ্রসরমান করতে হলে যার যা প্রাপ্য, বিশেষ করে অতীতের শ্রদ্ধেয় নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়েই, তা নির্ধারণ করতে হবে। “১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে ভাষণ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এই ধারার সূচনা করেন। শ্রদ্ধেয় নেতা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেই তিনি বক্তৃতা শুরু করেন। কোনো বক্তব্যে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে শত্রু হিসেবে গ্রহণ করতেন না। তাঁর কথায়, রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু বৈরিতার কোন স্থান নেই” (আহমদ, ২০০৪)।
স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব জিয়াকে জাতীয় জীবনের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে আসে। তখন দেশে কোন নিয়ন্ত্রণ কাঠামো অক্ষত ছিলনা। দেশে ছিল না কোন রাজনৈতিক দল। প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল স্থবির। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হবার অব্যবহিত পরেই, ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার দেশে প্রত্যাবর্তনের পূর্ব মুহূর্ত দেশের সকল ডানপন্থী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। “১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের বামপন্থী দলসহ সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পরে খন্দকার মোশতাক আহমদ বাকশালকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ফলে ওই সময়ে গণতান্ত্রিক শাসন কেন, যে কোন ধরণের শাসনের জন্য জনসংযোগ অথবা যোগাযোগ কিংবা নির্দেশ দানের লক্ষ্যে যে অপরিহার্য মাধ্যম হিসেবে রাজনৈতিক দলেরও কোন অস্তিত্ব ছিল না। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে প্রশাসনিক ব্যবস্থা হয়ে পড়ে অকার্যকর। না ছিল তার গতিশীলতা, না ছিল কোন সুসংহত প্রশাসনিক কাঠামো। ছিল না নির্দেশ পালন অথবা নির্দেশ দানের কোন সক্ষমতা। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশের ফলে প্রশাসনিক দক্ষতা ও তার নৈতিক মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে উপনীত হয়।এমনকি সামরিক বাহিনীও ছিল অত্যন্ত করুণ অবস্থায়, অন্ততপক্ষে চারটি খন্ডে যা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সামরিক বাহিনীর একাংশ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে বামঘেঁষা হয়ে ওঠে। তাওয়াবের নেতৃত্বে আর এক অংশ দক্ষিণপন্থী ভাবধারায় প্রবল হয়ে ওঠে। সামরিক বাহিনীর আর একটি অংশ খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্ষমতা লাভের জন্য ভীষণভাবে সুযোগ সন্ধানী হয়ে পড়ে। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারীরা এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে সুসংহত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে নিজেদের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এই অবস্থায় দেশব্যাপী সূচনা হয় গভীর অনিশ্চয়তার। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হয়ে ওঠে দ্বন্দ্বসঙ্কুল, ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। ব্যক্তিকেন্দ্রিক অশুভ প্রবণতায় চারদিকে সৃষ্টি হয় অনিশ্চয়তার ঘণ কুয়াশা। ক্ষমতাশ্রয়ীদের চক্রান্তে জনজীবন হয়ে পড়ে অতিষ্ঠ। এমনি সময়ে বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করতে হয় জিয়াউর রহমানকে। বলতে দ্বিধা নেই, তাঁর অগ্রবতী চিন্তা, সুগভীর জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং ব্যবস্থাপনা কৌশল অতি অল্প সময়ের মধ্যে দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে” (আহমদ, ২০০৪)।
শহীদ জিয়া নিহত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই জিয়ার বিরোধীরা তাঁর মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করার জন্য এক অশ্লীল লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। যে মানুষটি বিশ^সভায় বাংলাদশের মর্যাদাকে সমুন্নত করেছিলেন, জাতিগঠনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, সে মানুষটির মর্যাদাকে ধূলায় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁর প্রতিপক্ষরা এমন কোনো কাজ নেই যা তারাকরেনি। তাঁকে কলুষিত করার জন্য এমন কোনো মিথ্যা ছিল না, যার আশ্রয়তারা নেয়নি। এই মিথ্যার চর্চা এখনো অব্যাহত আছে। বিরোধীরা উপলব্ধি করেছিলেন, একজন জীবিত জিয়ার চেয়ে একজন মৃত জিয়া অনেক বেশী শক্তিশালী এবং কর্মের সাফল্য তাঁর জীবনকে ছাড়িয়ে গেছে। তারা তাঁর আকাশ ছোঁয়া জনপ্রিয়তাকে কখনও মেনে নিতে পারেননি, মেনে নিতে পারেন না।
“একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে একথা আজ স্বীকার করতেই হবে যে, মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেসব মহান ব্যক্তিত্ব নিজেদের জীবন, দেশ, জাতি এবং জনগণের কল্যাণে নিবেদন করেইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তাঁদের মধ্যে অন্যতম” (মন্ডল,২০০৩)।
একজন খ্যাতিমান কূটনীতিক হেনরী কিসিঞ্চার রাষ্ট্রনায়কের দায়িত্ব সম্পর্কে বলেন, “The Statesman’s duty is to bridge the gap between experience and vision" সত্যিই জীবনের বাস্তবতা রাষ্ট্রীয় অভিজ্ঞতার সমন্বয়ের এক বিরল সমাহার ঘটেছিল শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনে”(মাসুম, ২০১২)।
শহীদ জিয়া হতাশায় নিমজ্জিত জাতিকে আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন। তিনি বহুধাবিভক্ত জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে, দেশকে অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিয়ে আধুনিক বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। “তলাবিহীন ঝুড়ি” অপবাদ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে একটি আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল প্রদত্ত একটি রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচী ১৯ দফা প্রণয়ন করেন।
১৯ দফা কর্মসূচীগুলো হলো:
১. সর্বতোভাবে স্বাধীনতা, অখগুতা ও সাবভৌমত্ব রক্ষা করা।
২. শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সমাজতন্ত্র জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।
৩. সর্ব উপায়ে নিজেদের একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা।
৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে, উন্নয়ন কার্যক্রম এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা।
৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে, তার ব্যবস্থা করা।
৭. দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা।
৮. কোন নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে, তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা।
৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।
১০. সকল দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।
১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতিগঠনে উদ্ধুদ্ধ করা।
১২. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান।
১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।
১৪. সরকারী চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তিকে উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. জনসংখ্যা বিষ্ফোরণ রোধ করা।
১৬. সকল বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা।
১৭. প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা।
১৮. দুর্নীতিমুক্ত, ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।
১৯. ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় করা।
শহীদ জিয়া’র ১৯ দফা কর্মসূচি মূলত: বাংলাদেশের জন্য একটি দর্শন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণায় জনগণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার তথা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির যে আকাঙ্খা ও চেতনা তার ভিত্তিতে ভবিষৎতের জন্য একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন এবং আগামীর বাংলাদেশের যাত্রাপথ রচনায় ১৯ দফা কর্মসূচীই ছিল একটি মাইল ফলক।
ভু-রাজনৈতিক কারণেই দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় তার স্বাধীনতা, অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব এবং সীমান্তে নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে প্রথম দফাতে তার সুস্পষ্ট উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। এদেশের মানুষ ধর্মীয় অনুভূতিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাছাড়া স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের সমর্থন, সহযোগীতা এবং আকৃষ্ট করার লক্ষে শাসনতন্ত্রের মূলনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অত্যন্ত জরুরী ছিল। বাংলাদেশকে মর্যদাপূর্ণ ও একটি আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গ্রামীণ জনগণের সার্বিক উন্নতির উপর তিনি অধিক গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলাদেশ মানেই গ্রাম। জনগণের স্বতঃফূর্ত অংশগ্রহণের উপর অধিক গুরুত্বারোপ করে, জনগণের সর্ব ক্ষেত্রে অংশগ্রহন নিশ্চিত না হলে সুশাসন, উন্নয়ন এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়ন, অগ্রগতি এবং স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য গ্রাম বাংলার উন্নয়ন একটি অপরিহার্য পূর্বশর্ত। বাংলাদেশ যেহেতু কৃষি নির্ভর দেশ, সেহেতু কৃষির আধুনিকায়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদানের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি তথা জাতীয় অর্থনীতিকে অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দেন। তিনি জানতেন বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। তাই গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনকরবে, কোন মানুষ না খেয়ে থাকবে না, গ্রামে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, গৃহহীন মানুষ বাসস্থানের সুযোগ পাবে। কৃষি উন্নতি হলে শিল্প কলকারখানার জন্য কাঁচামাল সরবরাহ সহজলভ্য হবে, ফলে দেশে কাপড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হলে মানুষ আয় রোজগারের মাধ্যমে জীবন মান উন্নত করবে এবং তাদের ও তাদের সন্তানদের মৌলিক অধিকার সমূহ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বাসস্থানের সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারীদের শিক্ষিত করে জাতি গঠনের উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে যথাযোগ্য মর্যাদা সুনিশ্চিত করার উপর গুরুত্ব দেন। নারীরা শিক্ষিত হলে সচেতনতা সৃষ্টি হবে ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করা সহজ হবে। তাছাড়াও যুবসমাজকে সুসংহত ও উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে যুবকমপ্লেক্স স্থাপন করেন। দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে তরান্বিত করার জন্য বে-সরকারী খাত ও উদ্যোক্তাদের উৎসাহ ও প্রণোদনা প্রদান করেন। শিল্প কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক বান্ধব সম্পর্ক ও পরিবেশ গড়ে তোলার উপর জোর দেন। এছাড়াও তৈরী পোষাক শিল্প প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে তরান্বিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সরকারী চাকুরীজীবিদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনয়ন এবং তাদেরকে জনগণের সেবা নিশ্চিত করণ তথা দেশ ও জাতি গঠনে উৎসাহিত করণসহ সর্বোতভাবে প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে নিয়োজিত থেকে দূনীতিমুক্ত, ন্যায় ভিত্তিক সমাজ বিনির্মানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করেন। প্রশাসনিক সেবা ও উন্নয়ন জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণসহ স্থানীয় সরকার কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে গ্রাম সরকার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করেন। সর্বোপরি, তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন, সীমিত সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করতে না পারলে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। অন্তঃ এবং আন্তঃ রাষ্ট্রীয় (Intra and Inter State Relations) সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ইরান-ইরাক যুদ্ধ অবসানেতিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শুধু দেশেই নয় বর্হিবিশ্বেও সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, প্রতিবেশী ভারতসহ অন্যান্য রাষ্ট্র এবং বিশ্ব পরিমন্ডলে সকল রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদার করা জরুরী। বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়া সত্বেও শাসনতন্ত্রে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণে বদ্ধ পরিকর ছিলেন। জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় সংহতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে বসবাসকারী সকল জাতিসত্তা ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দর্শনে পরিচিত করে তোলেন।
শহীদ জিয়ারনেতৃত্বে ১৯ দফা কর্মসূচী খুব অল্প সময়ে সরকার ও সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি কঠিন সেতু বন্ধন সৃষ্টি করেছিল যা তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যায়। জিয়াউর রহমান বলেছিলেন- "I will make politics difficult” (মাসুম, ২০১২)। এর শাব্দিক অর্থ ‘রাজনীতি কঠিন করা’ বোঝাতে বা বিধি-নিষেধ যুক্ত করতে তিনি একথা বলেননি। তাঁর এ কথার অর্থ ছিল ‘ব্যাক টু দ্য ভিলেজ’- বাংলাদেশের গণমানুষের পীঠস্থান গ্রামে ফিরে যেতে রাজনীতিবিদদের বাধ্য করা এবং রাজধানী কেন্দ্রীক প্রাসাদ রাজনীতির বেড়াজাল থেকে জনগণকে মুক্ত করা।
২০২১ সালে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করছে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখনও আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে বিশ্ব পরিমন্ডলে স্থান করে নিতে সক্ষম হয়নি। যদিও বাংলাদেশ অনেক চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে অতি সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। তাছাড়াও সময়ের পথপরিক্রমায় বর্তমান বাংলাদেশে অর্থনীতির সূচকে গড় মাথাপিছু আয়, জিডিপি’র হার, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, দৃশ্যমান শিক্ষার হার এবং মানুষের দৈনন্দিন আয় বাড়লেও প্রশাসন ও সমাজের সকলস্তরে দূর্নীতির সূচক বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ জনগণ সুফল থেকে প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছে। তাছাড়াও সামাজিক বৈষম্য, মানবাধিকার লংঘন, ধর্ষন, নারী নির্যাতন, সীমান্ত হত্যা, পরনির্ভরশীল পররাষ্ট্রনীতি, নিয়ন্ত্রিত জনপ্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থা, ভারতের আধিপত্যবাদের প্রভাবের ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ আকাঙ্খা গুলো এখনও সুদূর পরাহত। গণতন্ত্র, মানুষের রাজনৈতিক অধিকার আজ এক কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন। সামাজিক ন্যায় বিচার, সামাজিক ও ধর্মীয় এবং মানবিক মূল্যবোধ আজ প্রায় সর্বক্ষেত্রে অনুপস্থিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব চরমভাবে হুমকির সম্মুখীন। দূর্নীতি, কালোটাকা এবং মাদকের প্রভাবসমাজের প্রতিটি স্তরকে গ্রাস করেছে। বেকারত্ব এবং অদক্ষ বৃহৎ জনগোষ্ঠী আজহতাশায় নিমজ্জিত। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনসেবার চাইতে রাজনৈতিক নির্দেশ পালনকেই মুখ্য মনে করে। সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যত অকার্যকরে পরিণত হয়েছে। প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি ও নির্যাতন জনজীবনকে করেছে বিপর্যস্ত। ফলশ্রুতিতে আইনের শাসনের জায়গায় পেশী শক্তির অবারিত আস্ফালন এবং সমাজের সর্বস্তরে আতংকের পরিবেশবিরাজ করছে। দক্ষ মানব সম্পদ তৈরিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে শহীদ জিয়া’র১৯ দফা কর্মসূচি বর্তমান বাংলাদেশের বাস্তবতায় অপরিহার্য রূপে প্রতিভাত হয়।
“রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে জিয়াউর রহমানর মহান দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করে জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন। শাসন-প্রশাসনে দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রশাসকদের আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে পেশাদারিত্ব সৃষ্টিতে মনোযোগী হন। নিজে দল গঠন করেন এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত দলসমূহের পুনরুজ্জীবন ঘটান এবং মানুষের বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবর্তনসহ রাজনৈতিক অধিকার অবমুক্ত করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল জাতীয়, দলীয় নয়। তাঁর পথ ছিল সর্বব্যাপক, সংকীর্ণতার গুহায় আবদ্ধ নয়। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। অতীতের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ভবিষ্যৎমুখী হয়েই তিনি পথ চলেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে প্রভাব বা বৈভবের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ না করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যম হিসেবে দেখতে থাকেন। তিনিই সর্বপ্রথম অনুধাবন করেন যে, মাটি আর মানুষই হল দেশ। কিছু সংখ্যক নগর-শহরে বসবাসকারী জনসমষ্টির উন্নতি বিধানই যথেষ্ট নয়। জাতীয় অগ্র্রগতির জন্য প্রয়োজন শহর-গ্রামাঞ্চলের সুষম উন্নয়ন” (আহমদ, ২০০৪)।
এই লক্ষ্যে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। জানতে চেয়েছেন গ্রামের সমস্যা সম্পর্কে,গ্রামীণ জনগণের দুঃখ কষ্ট-বঞ্চনার কথা। তাঁর গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা, বিশেষ করে কৃষিকে প্রযুক্তির মাধ্যমে গতিশীল করার চিন্তা-ভাবনা, খাল খনন ও বয়স্ক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন এদিক থেকে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাঁর মতে দেশের অগ্রগতির অর্থ হলো মানব সম্পদের উন্নয়ন এবং মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে তাকে অধিক ফলনশীল করা।
শহীদ জিয়া উপলব্ধি করেছিলেন, একশ বছর পরে বাংলাদেশ অগ্রগতির কোন স্তরে উপনীত হবে; রোগ-ব্যধি-শিক্ষা-কুসংস্কার দারিদ্রের ওপর বাংলাদেশ কতটুকু বিজয় অর্জন করবে ওশিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে উন্নতির স্পর্শ কতটুকু লাভ করবে- এ সম্পর্কে অধিকাংশ রাজনীতিকরা এতটুকু ভাবেননি। বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তিকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে রূপান্তরের কোন চিন্তা-ভাবনা করেননি। দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত, প্রান্তিক বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি অগ্রগামী রাষ্ট্র হিসেবে কিভাবে দেখতে চান-এ বিষয়েও তাদের তেমন কোন ভিশন ও প্রস্তুতি ছিল না। প্রস্তুতি ছিল না আগামী শতাব্দীতে বাংলাদেশ পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তর পরিসরে কিভাবে সংশ্লিষ্ট হবে সে সম্পর্কেও। জিয়াউর রহমানের চিন্তা-ভাবনা এই পেক্ষাপটে ছিল ঐতিহাসিক। অপচয়প্রবণ, দূর্নীতি পরায়ণ, লুটেরা অর্থনীতিতে তাই তিনি বেসরকারী ব্যক্তি উদ্যোগ সংযোজন করে তাকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে গ্রহণ করেন যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ। শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এবং সামগ্রিক দিক থেকে বিধস্ত বাংলাদেশকে একটি নির্দিষ্ট বলয়ে আবদ্ধ রেখে বৈদেশিক সম্পর্ক স্থাপন করলে উন্নত এবং সমৃদ্ধ দেশ গড়া সম্ভব নয়। তাই তিনি সফলতার সাথে বিশ্বের সকল দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ইন্দো-সোভিয়েতবলয় থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন। পূর্ব এশিয়ায় চীনের সঙ্গে সখ্যভাব স্থাপন করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন নতুন বন্ধু সংগ্রহ করে, অর্থনৈতিক পরাশক্তি জাপানের সঙ্গে হৃদ্যতা স্থাপন করে সৃষ্টি করেন নতুন অধ্যায়। ইঙ্গ-মার্কিন অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশর অর্থনীতিকে সংশ্লিষ্ট করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে তৈরী পোষাক শিল্প প্রবেশ করিয়ে এবং রেমিট্যান্স উপার্জনে মধ্যপ্রাচ্যেদক্ষ জনশক্তি রপ্তানীর মাধ্যমে মুসলিম বিশে^র সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি অনুভব করেন, আঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতার সূত্র বিস্তৃত না হলে জাতীয় অগ্রগতি প্রতিনিয়ত ব্যাহত হতে থাকবে। তাই ভারত ও পাকিস্তান যেক্ষেত্রে চুপচাপ থেকেছে সেক্ষেত্রে জিয়ার নেতৃত্বে সৃজনশীল বাংলাদেশ অগ্রসর হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে।
সুতরাং স্বাধীনতার ৫০ বৎসর পূর্তিতে বাংলাদেশে এখনো অসুস্থ রাজনৈতিক চর্চা ধারাবাহিকভাবে জাতিকে বিভক্ত করে চলেছে। জাতি আজ বিরক্ত। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে বীরত্ব গাঁথা ভূমিকার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় ‘খেতাব’ও আজ অসহায়। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে এ বিভাজন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রায় প্রতিটিক্ষেত্রে তা পরিব্যাপ্ত হয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গন ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, শ্রমিক সংগঠনে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এর দীর্ঘ ছায়া সবকিছুকে মলিন করে তুলছে। এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় শুধু জাতীয় ঐক্য নয়, জাতীয় অগ্রগতির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শহীদ জিয়া বিশ্বাস করতেন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া বাংলাদেশকে অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তাই তিনি তাঁর মেধা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও প্রজ্ঞাদিয়ে ভাষা, ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শহীদ জিয়া কখনও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থে এমনকি পারিবারিক স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালনা করেননি বরং জনকল্যাণমূলক কর্মসূচী এবং জনগণের স্বার্থই ছিল মুখ্য ভূমিকায়। এটি তাঁর শ্রেষ্টতম অবদান যা আজও বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বরণ করে। আজকের বাংলাদেশকে অনগ্রসরতার অন্ধকার গুহা থেকে আলোর রাজ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভিতর থেকে দেশের এই সংকটময় মুহূর্তে শহীদ জিয়া’র ১৯ দফা কর্মসূচীর আদর্শে উজ্জীবিত একজন রাষ্ট্রনায়ক (Statesman) জাতির কান্ডারী হিসেবে আর্বিভূত হবেন এটিই জাতির প্রত্যাশা।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :
১. মন্ডল, শাহাদত হোসেন (২০০৩), জিয়া বাংলাদেশের অহংকার, শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
২. মাসুম, আবদুল লতিফ (২০১২), রাষ্ট্রনায়ক জিয়া, শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
৩. আহমদ, এমাজ উদ্দীন (২০০৪), রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান এবং আজকের বাংলাদেশ, শ্যালেন প্রিন্টার্স লিমিটেড, কমলাপুর ঢাকা।
৪. উল্লাহ, মাহফুজ (২০১৬), প্রেসিডেন্ট জিয়ার রাজনৈতিক জীবনী, অ্যাডর্ন পাবকিলেকশন, সেগুন বাগিচা, ঢাকা।
৫. সালেহ, আবু (২০০২), ৭ নভেম্বর স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের দিন, ফারহানা বুক্স, বাংলাবাজার ঢাকা।
৬. ওয়াহেদ, শাকিল (২০১২) জাতীয়তাবাদী রাজনীতি ও চলমান প্রসঙ্গ, শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
৭. ওয়াহেদ, শাকিল, সম্পাদিত (২০১৩) জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ক্রোড়পত্র, শিকড়, বাংলাবাজার ঢাকা।
লেখক : অধ্যাপক ড. এ কে এম মতিনুর রহমান, লোক প্রশাসন বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।