অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান
৭ নভেম্বর ও জিয়াউর রহমান : একজন রাষ্ট্রনায়কের ঐতিহাসিক অভ্যুদয় ও রাজনৈতিক অমরত্ব
প্রকাশ: ০৮:০০ পিএম, ৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৩৪ এএম, ৩ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব শুধু মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা নয়, এ দেশে আধিপত্যবাদবিরোধী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অভ্যুদয়ের সূচনা। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ একটি অভ্যুত্থান ঘটান। এই অভ্যুত্থানের নেতারা তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের সাথে আলোচনা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত ১৫ জন সেনাকর্মকর্তাকে নিরাপদে ব্যাংককে পৌঁছে দেন।
এ সময় ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেই মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে প্রধান বিচারপতি সায়েমকে প্রেসিডেন্ট পদে বসান। খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পর অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং ভারতের সংবাদমাধ্যম এই অভ্যুত্থানের সমর্থনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এবং আনন্দের সাথে সমর্থন প্রকাশ করে।
৪ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের মা এবং তার ভাই অল্প কিছুসংখ্যক মস্কোপন্থী নেতাকে সাথে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে শেখ মুজিবের ধানমন্ডি বাসভবন পর্যন্ত মিছিল নিয়ে যায়। শিগগিরই গুজব ছড়িয়ে পড়ে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পেছনে ভারত-রাশিয়ার সমর্থন আছে। সাধারণ মানুষের মনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়, বাংলাদেশ আবারো দিল্লি-মস্কো অক্ষে চলে যাচ্ছে। এর ফলে ঢাকায় বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
ইতোমধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ ও সাম্যবাদী দল ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের মধ্যে ব্যাপক লিফলেট বিলি করে। এসব লিফলেটে খালেদ মোশাররফকে ভারত সরকারের বেতনভূক্ত এজেন্ট হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। এসব লিফলেট খালেদ মোশাররফের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে সৈনিকদের উত্তেজিত করে তোলে। জাসদ ইতঃপূর্বে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নামে সেনাবাহিনীর মধ্যে সেল গঠন করে। নভেম্বরের ৬ তারিখ রাতে এই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা খালেদ মোশাররফ ও তার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। এই বিদ্রোহের মাঝে খালেদ মোশাররফ যখন ক্যান্টনমেন্ট থেকে পলায়নের চেষ্টা করেন তখন তাকে হত্যা করা হয়।
খালেদ মোশাররফের এই হত্যাকান্ডের সাথে জিয়াউর রহমানের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না, যেমন ছিল না ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে। খালেদ মোশাররফকে হত্যা করেছে জাসদ সমর্থিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সৈনিকেরা, আর ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত সেনাকর্মকর্তাদের
দেশত্যাগের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। বিদ্রোহী সৈনিকেরা এরপর জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে। তারা ট্যাংক, ট্রাক, জিপে করে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বেরিয়ে এসে উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে। তাদের সাথে সাধারণ মানুষও যোগ দেয়। শ্লোগান দেয় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ, সিপাহি-জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ। ঢাকার রাজপথে সৈনিকদের সাথে একাকার হয়ে সাধারণ মানুষের এই উৎসবকে দেখা হয় ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিজয় হিসেবে। নভেম্বরের ৭ তারিখ এই বিপ্লব সাংগঠনিক রূপ পরিগ্রহ করে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন।
সাবেক প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক এক বেতার বক্তৃতায় এই অভূতপূর্ব সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশংসা করেন। তিনি বিচারপতি সায়েমকে অরাজনৈতিক ও নির্দলীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে থেকে যাওয়ার কথা বলেন। প্রেসিডেন্ট সায়েম প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও তিন বাহিনী প্রধানকে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। এভাবে সাধারণ সৈনিক এবং দেশের সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আবির্ভূত হন। নেতৃত্বের গুণাবলির কারণে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। যেহেতু সিপাহি-জনতার বিপ্লবে জাসদ বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে তাই তিনি মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রবসহ কারাবন্দী জাসদ নেতাদের মুক্তি দেন। জাসদ নেতারা তখন তাদের তথাকথিত বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ের কথা বলতে শুরু করেন।
তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জিয়ার কাছে ১২ দফা দাবি পেশ করেন। এই দাবিগুলোর মধ্যে ছিল সেনাবাহিনীর বিদ্যমান কাঠামো বদলে ফেলে শ্রেণিবিহীন সেনাবাহিনী গড়ে তোলা। তারা সেনাকমকর্তা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল এবং ক্যাডেট কলেজ থেকে সেনাকর্মকর্তা নিয়োগ বন্ধের দাবি জানান। এসব দাবির সমর্থনে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে জাসদের তৎপরতা ও লিফলেট বিতরণ উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা ও রংপুরে ৪০ জন সেনাকর্মকর্তা নিহত হন। জাসদের এ ধরনের তৎপরতার ফলে সেনাবাহিনী ধ্বংসের মুখে পড়ে। সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে জিয়াউর রহমান তখন বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেন।
সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনীর ক্ষমতা লাভ ছিল একটি অনন্য ধরনের বিপ্লব। জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দুকের নল ধরে ক্ষমতায় এসেছেন এ কথা মোটেও সত্য নয়। সেনাবাহিনী ও সর্বস্তরের জনগণের সার্বিক সমর্থনের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। এই বিপ্লবের রূপ ছিল তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের সম্পূর্ণ বিপরীত। ষড়যন্ত্র এই বিপ্লবের মূল উপাদান ছিল না। এই বিপ্লবের মূল চরিত্র ছিল জিয়াউর রহমানের প্রতি সেনাবাহিনী এবং জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। জাসদ দাবি করে জিয়াউর রহমানকে তারাই ক্ষমতায় বসায় এবং জিয়াউর রহমান তাদের সাথে শর্ত ভঙ্গ করে। তাদের এই দাবি তাদের তথাকথিত সশস্ত্র বিপ্লবের তত্ত্বের অসারতা প্রমাণ করে। কারণ কোনো সশস্ত্র বিপ্লবী গ্রুপ ক্ষমতা গ্রহণ করে অন্য কাউকে ক্ষমতা দিয়ে দেয় এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। বিপ্লব করতে হলে জনগণের বিপুল সমর্থন দরকার। স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে এবং একজন নিষ্কলুষ সাহসী সৈনিক হিসেবে জিয়াউর রহমানের প্রতি জনগণের ও সামরিক বাহিনীর ব্যাপক সমর্থন ছিল। এই সমর্থনের কারণে জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বর বিপ্লবের মহানায়কে পরিণত হন, জাসদের অনুকম্পায় নয়। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের আধিপত্যবিরোধী মনোভাবই শুধু প্রকাশ হয়নি, এই বিপ্লব-পরবর্তী জিয়াউর রহমানের নানা পদক্ষেপের ফলে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সেনাবাহিনী একটি পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠে। ৭ নভেম্বরের বিপ্লব শুধু দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেনি সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিকতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আধিপত্যবাদবিরোধী চেতনার জন্ম দেয়।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর স্বাধীনতার ঘোষক মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে নেতৃত্ব দানকারী অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে অভ্যূদয় দিবস। দিনটি বিশেষ গুরুত্বের সাথে ”জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’’ হিসেবে পালিত হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে নিজেই সেনাপ্রধান হন। সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় সেইদিনই বঙ্গভবনে অবস্থানরত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের নিরাপদে দেশ ত্যাগ করার সুযোগ দেওয়া হয়। খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দোহাই দিলেও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী রাখায় সৈনিক ও জনতার মাঝে তীব্র সংশয় ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
৩ নভেম্বর অভ্যূত্থানের কারণে সৃষ্ট গণঅসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক পরিকল্পনা চরিতার্থ করার জন্য জাসদ ও গণবাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে। দেশপ্রেমিক জনসাধারণের মাঝে সর্বত্র এই আলোচনা হচ্ছিল যে যদি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা না যায় তাহলে দেশ তথাকথিত 'বিপ্লবীদের' নিয়ন্ত্রনে চলে যাবে অথবা অনাকাঙ্খিত সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্ঠি হবে। অতএব জিয়্উার রহমানকে মুক্ত করতেই হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ নভেম্বর তারিখে রাজপথে নেমে আসে সিপাহী-জনতা। গৃহবন্দীদশা থেকে মুক্ত হন তুমুল জনপ্রিয় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। তিনি প্রতিশোধ পরায়ন ছিলেন না, ছিলেন মানবিক গুনে উদ্ভাসিত এক বিচক্ষণ অভিভাবক। বহুবার বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হয়েও শত্রু চিহ্নিত করে নির্মুল করার পথে না হেঁটে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার নিমিত্তে জিয়াউর রহমান সর্বস্তরের জ্ঞাণী-গুনী ও দক্ষ মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছেন।
গৃহবন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে জিয়াউর রহমান কঠোর হাতে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। অনেকের সংশয় ছিল যে, তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন না। কিন্তু আশংকা উড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশের গণমানুষের মনে জিয়াউর রহমান স্থায়ী আসন গড়ে তোলেন। ৭ নভেম্বরের রাজনৈতিক তাৎপর্য সূদুর প্রসারী। এই বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের হাত ধরে প্রকাশ্য রাজনীতি পূণঃপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে ফিরে দলের (আওয়ামী লীগের) হাল ধরার সুযোগ পেয়েছিলেন। পাশাপাশি পূণঃপ্রতিষ্ঠিত হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গণতান্ত্রিক ধারা।
জাতিগত পরিচয় নির্ধারণেও ৭ নভেম্বরের তাৎপর্য অতুলনীয়। জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম ও বিকাশ লাভ করে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। অনেকের প্রশ্ন ছিলো এটি কি রাজনৈতিক দল? নাকি একটা ‘প্রবনতা’। আবার অনেকে মনে করতো সরকারের মেয়াদ শেষ হলেই বোধয় বিএনপি দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাবে। সব সন্দেহ ও সমালোচনাকে ভুল প্রমাণ করে জিয়াউর রহমান সফল হয়েছিলেন। কাল পরিক্রমায় বিএনপি পর্যায়ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। রাষ্ট্র ক্ষমতাকে গণমুখী এবং গণনির্ভর করার কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। জাতির জীবনে এধরনের সাফল্য বয়ে নিয়ে আসার কারণে অনেক গবেষক জিয়াউর রহমানকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, মেক্সিকোর প্লুতার্ক এলিয়স কামেল ও লজারো কার্দেনাস এবং দক্ষিণ কোরিয়ার পার্ক চুং হি এর সাথে তুলনা করেন (Hossain, G., General Ziaur Rahman and the BNP: Political Transformation of a Military Regime, UPL, Dhaka, P.17 )|
বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোন্দল ও স্থবিরতার বিপরীতে তিনি দেশের জন্য সময় উপযোগী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ক ইশতেহার প্রণয়ন ও ঘোষনা করেন। এভাবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) একক বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। জাসদের ৭ নভেম্বরের বিপ্লব প্রয়াসকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা বিপ্লবের প্রম প্রহরেই “সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই” এই স্লোগান তোলেন এবং ১২জন অফিসারকে হত্যা করেন। ৭ নভেম্বরের ঘটনায় যেসব রাজনৈতিক নেতা বিপ্লব বাসনা বা ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা (হাসানুল হক ইনু, শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আনোয়ার হোসেন) এখন ১৪ দলের নামে আওয়ামী লীগ শিবিরেও আছেন।
জিয়াউর রহমানের দায়িত্ব গ্রহণ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠনের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন ও নতুন একটি দল পাওয়া গিয়েছে তা নয় বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে, এর দার্শনিক ভিত্তি কি হবে, সেই বিষয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গিয়েছে। বাহাত্তরের সংবিধানে আমাদের পরিচয় “বাঙালি” হিসেবে ধার্য করা হলেও রাষ্ট্রক্ষমতা অধিষ্ঠিত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান এই ধারণায় পরিবর্তন আনা জরুরী বলে মনে করেন। নাগরিক হিসেবে সকলের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় কি তা স্পষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, যদি আমরা জাতীয় পরিচয় নির্ধারনের ক্ষেত্রে “বাঙালি” পরিভাষাটি ব্যবহার করি তাহলে বাংলাদেশের ভূখন্ডে বসবাসরত অবাঙালি বাংলাদেশী নাগরিকগণ জাতীয় পরিচয়ের বলয় থেকে ছিটকে পড়বে। জিয়াউর রহমান তাই বাংলাদেশের বাঙালি ও অবাঙালিসহ সকল নাগরিকের অধিকার ও
স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যে জাতীয় পরিচয়ের মাধ্যম হিসেবে “বাঙালির” স্থলে “বাংলাদেশী” পরিভাষা চালু করেন।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ সার্বজনীন ও বৈষম্যহীন। এটি কেবলমাত্র ধারনাগত বিষয় নয় বরং এটি দেশপ্রেমের চেতনাশ্বরবাত একটি প্রণোদনা যা সকল নাগরিককে সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় সমান গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯৮১ সালে মার্কাস ফ্রান্ডাকে দেওয়া এক স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,“ এটা আমাদের দেশ, আমাদের ভূমি, ... এখন সুযোগ এসেছে ... চাষাবাদ করি এবং এর উৎপাদনশৗলতা বাড়াই, শিল্প গড়ে তুলি এবং মর্যাদার সাথে মাথা উচু করে দাঁড়াই। ... আমাদের আস্থা রাখতে হবে নিজেদের শক্তিতে ... কোনো বিদেশীবাদ নয় (Franda, Marcus (১৯৮১) ‘Ziaur Rahman and Bangladeshi Nationalism, Economic and Political Weakly’ Vol. XVI, No- 10-11-12, 1981; quoted in Hossain, p.63)| অধ্যাপক আহমদ শরীফ এই রাষ্ট্র দর্শনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদে প্রান্তিক আদিবাসিরাও গোত্র, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবাই সমমর্যাদা ও সমঅধিকারের স্বীকৃতি পায়, জিন্মি থাকে না (আহমদ শরীফের ডায়েরী, ভাব-বুদ্বুদ, পৃ.৬৪)।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি অমুসলিম বাংলাদেশী নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় নির্ধারনের আইনগত ভিত্তি রচনা করেছে। যার রূপকার জিয়াউর রহমান নিজেই। তাঁর লেখা “বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ” প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয় তেমনি আবার ধর্ম বিমুখও নয়। এই জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও নির্মোহ অকপট ভাবনার অতুলনীয় পন্ডিত আহম্মদ ছফা’র একটি উক্তিতে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ছফা বলেন “ ইসলামের সম্ভাবনা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগহীন রাজনীতির কোনো ভবিষ্যত এদেশে নেই (আহমদ ছফা, বাঙালি মুসলমানের মন, ১৯৮১)”। এ প্রসংগে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদের মন্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন: “আওয়ামীলীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদের
রাজনীতির নিষ্পত্তি হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ওই ধরনের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আবেদন একাত্তর-পরবর্তী বাস্তবতার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। বায়ান্ন, ছেষট্টি, উনসত্তরের স্মৃতি নিয়ে বসে থেকে তো আর জাতিরাষ্ট্র তৈরি করা যায় না। এ জন্য প্রয়োজন ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উনড়বয়নের পরিকল্পনা, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের প্রয়োজনে সমঝোতা ও ঐক্যের রাজনীতি এবং জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। বলা চলে, আওয়ামী লীগ সরকার দেশের বৃহত্তর নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তের আকাঙ্খার সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। ঐক্যের বদলে গোষ্ঠীতন্ত্র মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। জাতীয় ঐক্য তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রধান শক্তিটিও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
এর ফলে জাসদের মতো একটি রাজনৈতিক প্রবণতার জন্ম হয়। বাহাত্তরে প্রয়োজন ছিল নতুন রাজনীতি, নতুন কৌশল। একটি জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তার কার্যকরিতা সম্পন্ন করেছিল। আওয়ামী লীগ এরপর পুরোনো মনস্তত্ত্বের ঘেরাটোপ থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ মনে করতে শুরু করে, মুসলিম লীগের বিরোধিতা মানেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেশদ্রোহ। একাত্তরের পর আওয়ামী লীগও বিরোধীদের সমালোচনার মধ্যে সব সময় ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেতে থাকে। সরকার বিরোধিতা আর রাষ্ট্রদ্রোহ একাকার করে ফেলে। এখান থেকেই শুরু রাজনৈতিক সংকটের। এর ধারাবাহিকতা চলছে আজও (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়-অসময়, ২০১৭, পৃ-১৩৪-১৩৫)”।
বর্তমানে যা ঘটে যাচ্ছে, তাও সবার জানা। গুম-খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি অনাচার ও আতঙ্ক মানুষের নিত্যসঙ্গী। গণতন্ত্রের চর্চা নেই, আইনের শাসন নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই এবং নেই ভোটের অধিকার। রাষ্ট্রের মালিক জনগণ আজ মালিকানাহীন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে বিএনপির আপোষহীন সংগ্রাম ও নেতৃতের ধারাবাহিক একটি ঐতিহ্য রয়েছে। জিয়াউর রহমান একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করেছেন বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরশাসক এরশাদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে নিরলস সংগ্রাম করে আপোষহীন নেত্রীর উপাধি লাভ করেছেন।
আজ সময় এসেছে বিএনপি’র সংগ্রামী অতীত ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বিরতিহীন সংগ্রামে লিপ্ত হওয়া। তাই ঐতিহাসিক প্রয়োজনে গঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সর্বাত্মক সংগ্রাম গড়ে তোলাই হোক বিএনপি’র “জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের” অঙ্গিকার।
লেখকঃ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।