অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় খালেদা জিয়ার কারামুক্তি ও বিদ্যমান সংকট নিরসনে দেশবাসীর করণীয়
প্রকাশ: ০৬:৪০ পিএম, ১৫ আগস্ট,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৪০ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
১৯৬০ সালের আগষ্ট মাসে মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে বেগম খালেদা খানম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ৫ বছর পর ১৯৬৫ সালে স্বামীর পশ্চিম পাকিস্তানে পোষ্টিং হলে বেগম খালেদা জিয়া স্বামীর সাথে সেখানে চলে যান। কিছু দিনের মধ্যেই পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। জিয়াউর রহমান ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন ”আলফা কোম্পানির” কমান্ডার হিসেবে ‘খেমকারন’ রণাঙ্গনে বেদীয়ান-এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সংসার জীবনের সাধারণ হিসাব নিকাশের বাইরে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবিচল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া নিজে দেশের প্রয়োজনে ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-শান্তি বিসর্জন দেবার পালা প্রথমবারের মত এরই মাধ্যমে শুরু করেন। যুদ্ধ চলাকালীন তাদের খবর নেয়ার জন্য ঢাকা থেকে ফোন করা হলে ছোট বেলা থেকেই দৃঢ়মনের অধিকারীনী খালেদা জিয়া জবাবে বলতেন, ‘তোমরা অযথা ভেবোনা’। অথচ সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানে খালেদা জিয়া উৎকন্ঠা নিয়ে বীর যোদ্ধা স্বামীর জন্য প্রতীক্ষার কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ন হয়ে বহু বিনিদ্র রজনী পার করেছেন।
১৯৬৯ সালে স্বামী মেজর জিয়ার পোষ্টিং-এর সুবাদে তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন। মেজর জিয়া ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের ফলে বেগম খালেদা জিয়া দুই পুত্র সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে চট্টগ্রামের ষোল শহর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করেছেন। বছর পার হতেই পরিস্থিতি বিষ্ফোরোন্মুখ হয়ে উঠতে লাগলো। ২৫ মার্চ ১৯৭১-এ চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টের প্রশাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক রদবদল ঘটে। শুরু হয় ২৫ মার্চের কালো রাত। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়া চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে যান এবং স্বাধীনতার ঐতিহাসিক সেই ঘোষণা দেন। বেগম খালেদা জিয়া ও দুই শিশু সন্তানকে চট্টগ্রামে অরক্ষিত অবস্থায় রেখেই মেজর জিয়া স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
এভাবে পুনরায় শুরু হলো বীর যোদ্ধা মেজর জিয়ার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সংগ্রামী জীবনের ২য় অধ্যায়। মেজর জিয়া মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ায় বেগম খালেদা জিয়া দুই শিশুপুত্র নিয়ে চট্টগ্রামে চাচার বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। শুরুর দিকে কিছুদিন যোগাযোগ থাকলেও এক পর্যায়ে তাঁরা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। চাচার বাসায় আত্মগোপনে থাকা খালেদা জিয়া ও তার দুই সন্তানের জন্য চট্টগ্রাম নিরাপদ ছিল না বিধায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই অবুঝ শিশুকে বুকে আগলে ধরে ছদ্মবেশে নৌপথে নারায়নগঞ্জ হয়ে বেগম জিয়া ঢাকায় আসেন এবং এক আত্মীয়ের ঢাকার বাসায় গিয়ে আত্মগোপন করেন। পাক সেনারা তাঁকে খুঁজে পেয়ে যায় ২ জুলাই ১৯৭১-এ এবং সেই দিনই গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে আর্মি অফিসার্স মেসে নিয়ে যায়। চরম নিরাপত্তাহীনতায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট একটি কামরায় দুই শিশু সন্তান নিয়ে দেশমাতৃকা কবে স্বাধীন হবে এই আশায় নির্ঘুম প্রহর গুনতে থাকেন বেগম জিয়া।
একদিন বোমা বিষ্ফোরণে, যে কক্ষে তাঁরা বাস করতেন তার এক অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তাঁরা। প্রায় ছয় মাস দুই সন্তানসহ বন্দি অবস্থায় কাটান। শ্বাসরুদ্ধকর এই অবস্থার অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে, লাখো মা বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। মেজর জিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ না নিলেও বেগম জিয়া দুই অবুঝ শিশুপুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কে বুকে আগলে রেখে আত্মগোপন ও বন্দি দশায় যে নিদারুন মানসিক যন্ত্রণা ও আতংকে দিন অতিবাহিত করেছেন এবং সন্তানদের রক্ষা করেছেন তার মূল্য প্রত্যক্ষ রণাঙ্গনে অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধার তুলনায় কোন অংশে কম নয়।
১৯৮১ সালের ৩০ মে চক্রান্তকারীদের হাতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনাকাঙ্খিত শাহাদত বরণের মধ্য দিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দীর্ঘ ২১ বছরের মধুর দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটে। দেশ ও জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে কোন পূর্বপরিকল্পনা না থাকা সত্ত্বেও এ ভাবেই সংসারের করিডোর অতিক্রম করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম জিয়ার আবির্ভাব ঘটে ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি দলের প্রাথমিক সদস্য হবার মাধ্যমে। ১৯৮৪ সালের ১০ মে নির্বাচনের মাধ্যমে দলের চেয়ারপার্সন হন বেগম খালেদা জিয়া। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অসমাপ্ত কাজ ও পরিকল্পনাগুলো সমাপ্ত ও কার্যকর করার জন্যই তিনি জিয়া পরিবারের ছোট পরিসরকে আরো সম্প্রসারিত করে শহীদ জিয়া বিহনে শোকগ্রস্ত লক্ষ কোটি বাংলাদেশিকে নিজ পরিবারভুক্ত করার সংকল্পবদ্ধ হন। পরম মমতায় জনগণের দায়িত্বভার গ্রহণ করা ও শহীদ জিয়ার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে কখনো রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে কখনো সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া পর্যায়ক্রমে হয়ে উঠলেন দেশনেত্রী ও জনতার আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রস্থল। ১৯৮২ সালের শুরুর দিক থেকে দীর্ঘ নয় বছর জগদ্দল পাথরের মত ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদ সরকারের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন রচনা করে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ‘আপোষহীন’ নেত্রীর খেতাব অর্জন করেন।
বেগম খালেদা জিয়া সামরিক জান্তা এরশাদের জুলুম নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট জাতির আরেক ক্রান্তি লগ্নে জনগণের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি দলের প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় বলেছেন, “শহীদ জিয়ার আদর্শ ও পথ নির্দেশনার সফল বাস্তবায়নই আমার জীবনের উদ্দেশ্য। আমি এ দেশের সকল দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর কাছে আহবান জানাচ্ছি, আসুন বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। ইনশাল্লাহ জয় আমাদের হবেই”। দলের ভিতরের ষড়যন্ত্র (অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের নায়ক ছিল এরশাদের সাথে গোপনে আঁতাতকারী ‘হুদা-মতিন’ চক্র) ও দলের বাইরের ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করে বেগম জিয়া ৭ দলীয় ঐক্যজোট তৈরি করেন। ১৯৮৩ সালের ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে গঠিত ১৫ দলীয় জোটের সাথে বৈঠক করেন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ৫ দফা ঘোষণা দেন।
১৯৮৬ সালে সামরিক জান্তা এরশাদ তার দু:শাসনকে বৈধতা দেবার এক দূরভিসন্ধিমূলক কূটচালের অংশ হিসেবে সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিলে ৭ দল ও ১৫ দল যৌথভাবে এই ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু 'আওয়ামী লীগ ধূর্ত সামরিক জান্তা এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সহ অন্য দলগুলো বিএনপির সঙ্গে এসে আন্দোলনে যোগ দেয়। নেতৃত্বের অসাধারণ দক্ষতা ও আপোষহীন মনোভাব প্রদর্শন করে বেগম খালেদা জিয়া স্বৈরাচারী এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনের নেতৃত্বের মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেন। হরতাল, সচিবালয় ঘেরাও ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি লাঠিচার্জ ও কাঁদানি গ্যাসে আহত হন। কোন নির্যাতন তাঁকে রুখতে পারেনি।
বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের জনক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসূরী বেগম খালেদা জিয়া অগণতান্ত্রিক ভাবে ক্ষমতা দখলদারীদের কোনো চাপ কিংবা ষড়যন্ত্রের কাছে মাথা নত করেন নি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেতা কর্মীদের সাহস ও অনুপ্রেরণার মধ্যমণি হয়ে সকল বাঁধা অতিক্রম করে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা এরশাদ এর কবল থেকে ১৯৯০ এর ৬ ডিসেম্বরে দেশবাসীকে মুক্ত করেছেন। এই আপোষহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি বিএনপি-কে শক্তিশালী ও মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাবার পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের প্রত্যয়দীপ্ত ছাত্রদের বিশাল এক অংশ নিয়ে গঠিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলকে আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ এবং ছাত্রদের অধিকার আদায়ে লড়াকু এক ছাত্র সংগঠনে রূপান্তরিত করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের গণ অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনে এই আত্মবিশ্বাসী লড়াকু ছাত্রদের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র সমাজের ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
১৯৯১ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে খালেদা জিয়ার আপোষহীন নেতৃত্বের প্রতিদান স্বরুপ বিএনপি বিজয় অর্জন করে। বিএনপির ঘোর সমালোচকেরাও খালেদা জিয়ার ১৯৯১-৯৬ শাসন আমল নিয়ে প্রশংসা করে। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শত প্রতিকুলতা থাকা সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখার স্বার্থে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি নির্বাচনে যায় এবং ১১৬ আসন পেয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা সক্রিয়ভাবে পালন করে। ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের জনগণ কেমন ছিল তা ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় অর্জন করে। বেগম জিয়ার বিরোধী দলীয় নেত্রীর ভূমিকা পালন এবং আওয়ামী দু:শাসনের দু:সহ যন্ত্রনা এই বিজয়ের পেছনে মূল নিয়ামক ছিল।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি কিছু সেনা কর্মকর্তাসহ সেনা প্রধান মঈনউদ্দিন ক্ষমতা দখল করে এবং ২২ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন বাতিল করে। ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে অসাংবিধানিক ভাবে সেনা সমর্থিত এক সরকার প্রতিষ্ঠা করে দেশে জরুরী অবস্থা জারী করা হয়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর পরিবার এবং বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গের বিরুদ্ধে কল্পকাহিনী প্রচার শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় যৌথবাহিনী গঠন করে ২০০৭ সালে ৭ মার্চ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে এবং ১৬ এপ্রিল আরাফাত রহমানকে গ্রেফতার করে। বেগম খালেদা জিয়াকে সন্তান, নেতাকর্মীসহ সকলের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে ৩ সেপ্টেম্বর ২০০৭-এ কারাবন্দী করা হয়। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকে ঘুষ গ্রহণের মামলায় গ্রেফতার করা হয়। আমরা সকলেই ধারণা করেছিলাম যে, এটি মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন গং এর ‘মাইনাস-টু-ফরমূলা’ বাস্তবায়নের একটি অপকৌশল ছিল। কিন্তু ঘটনার পরমপরায় এটি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠলো যে, এটি ছিল মূলত মাইনাস ওয়ান ফরমুলা অর্থাৎ উদ্দেশ্য ছিল বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনীতি ময়দান থেকে চিরতরে উৎখাত করা। প্রবল জনমতের কারণে ১১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ তারিখে বেগম খালেদা জিয়াকে সেনা সমর্থিত সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
মুক্ত হয়ে খালেদা জিয়া অসাংবিধানিক সরকারের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেন। চাপের মুখে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরুরী অবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন দেয়ার প্রস্তাব করলে বেগম খালেদা জিয়া তা প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেই স্বৈরাচারী এরশাদের ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ৭ দল ও ১৫ দলীয় জোটের সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে যে প্রক্রিয়ায় শেষ মুহূর্তে অংশগ্রহণ করেছিল ঠিক সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করলো। অজ্ঞাত কারণে আওয়ামী লীগ জরুরী অবস্থার মধ্যেই নির্বাচন করার প্রস্তাব মেনে নেয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনর্বহাল করার স্বার্থে বেগম খালেদা জিয়া মঈনউদ্দিন - ফখরুদ্দিনের সেনা সমর্থিত সরকারের (যারা জিয়া পরিবারকে ধ্বংস করার জন্য বিরতিহীনভাবে সকল প্রকার জুলুম ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছিল) অধীনে জরুরী অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে রাজী হন নি। পরবর্তীতে জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করা হলে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের মুখে পরাজয় বরণ করে। নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে।
এরপর যা ঘটে যাচ্ছে তা সবার জানা। ২০১৪ সালে ভোটার বিহীন নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ ২য় মেয়াদে সরকার গঠন করেছে। এ দীর্ঘ সময়ে বেগম জিয়াকে বাড়ী ছাড়া করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, গত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ বর্তমান সরকার তাঁকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। তিনি এখন জেলে, সেখানেও রেহাই নেই। শারিরীকভাবে অসুস্থ বেগম জিয়াকে চিকিৎসার সুবিধাটুকু দেয়া হচ্ছে না। মানুষের মৌলিক চাহিদা মধ্যে পড়ে যে চিকিৎসা-সেবা সেটি আদায় করতেও আইনী লড়াই করতে হচ্ছে। যে মিথ্যা মামলায় তিনি সাজাভোগ করছেন, সেই মামলায় তিনি জামিন পেলেও নানা অজুহাতে এবং একটির পর আরেকটি মিথ্যা মামলার কার্যক্রম চালু করে কারাগার থেকে বের হতে বাঁধা প্রদান করছে; জোরপূর্বক কারাগারে আটকে রেখেছে। এর কারণ একটাই, তিনি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চান, যা দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার মূলমন্ত্র। এই দাবী গণতন্ত্রকামী দেশবাসী সকলের প্রাণের দাবী। বেগম খালেদা জিয়া কারামুক্ত হলে জনগণ তাঁর আপোষহীন নেতৃত্বে এই প্রাণের দাবী আদায় করবে এই আতংকে সরকার বেগম জিয়ার উপর এই মিথ্যে মামলাহামলা ও জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ভিত্তিহীন ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ৫ বছরের কারাভোগ করছেন বেগম খালেদা জিয়া। তা এখন বৃদ্ধি করে ১০ বছর করা হলো। এর সাথে যুক্ত করা হলো জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাষ্ট ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় দেয়া ৭ বছর সাজা।
অথচ জনগণ জানে ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যাচ্ছে। জনগণের আমানতের অর্থ তসরুপকারীদের বিচার হচ্ছেনা। বেগম খালেদা জিয়ার ৫ বছরের সাজা আইনি লড়াই করে ১০ বছর করার জন্য প্রাণপণ লড়ে গেলো দুদকের আইনজীবিরা। অথচ ব্যাংক লুটেরাগণ অজ্ঞাত কারণে ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেল। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে অনেকগুলো দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়েছে বিগত বছরগুলোতে। বর্তমান সরকার কিংবা দুদক সেই মামলাগুলো নিয়ে লড়ছেনা। এর কারণ কি তা বুঝতে জনগণের অসুবিধা হবার কথা নয়। স্বৈরাচারী এরশাদের দলকে কতৃত্ববাদী বর্তমান সরকার পেশী শক্তি হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই অন্যায্য সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা ঘুষ ও দুর্নীতির ৩ টি মামলা রয়েছে। হাইকোর্টের দেয়া একটি রায় চুড়ান্ত করা হলেও রহস্যজনকভাবে বিচারিক আদালতে সেই রায় পৌঁছায়নি। তাই তাকে আত্মসমার্পনও করতে হচ্ছেনা। অথচ স্বাভাবিক নিয়মে তার এখন জেলে থাকার কথা। এটি অনুমান করতে কারো অসুবিধা হবার কথা নয় যে, তিনি এই সুবিধা পেয়েছেন বিএনপির বিরুদ্ধে একজন বিষোদগারকারী হিসেবে।
অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই-এ খালেদা জিয়ার আপোষহীন সংগ্রামী চরিত্র নেতা কর্মীদের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে ৯০-এর দশকেই। দেশবাসীও বেগম খালেদা জিয়াকে ভালোবাসে- এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু অসংখ্যনেতা-কর্মী যখন ‘আমার নেত্রী আমার মা, জেলে যেতে দিব না’ এমন গগণ বিদারী শ্লোগান দেন তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে এভাবে নেত্রীকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করা নেতা কর্মীদের অতি আবেগের বহি:প্রকাশ নাকি এর পেছনে কোন বাস্তবতা বা যুক্তি রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর জিয়া যখন বেগম খালেদা জিয়া ও দুই শিশুসন্তানকে রেখে দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখন বেগম খালেদা জিয়া পরম মমতায় তাঁর দুই শিশু সন্তানকে দীর্ঘ ৯ মাস কখনো আত্মগোপন, কখনো বন্দি দশায় থেকে যেভাবে আগলে রেখেছেন তা কেবল গর্ভধারিনী হলেই হয় না- তার জন্য প্রয়োজন সেরকম একজন মা যিনি শুধু জন্ম দেননা বরং জীবনের সবটুকু দিয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন। খালেদা জিয়া সেই অর্থে একজন আদর্শ গর্ভধারিনী; তিনি তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের ‘মা’।
এখন প্রশ্ন হলো তাঁকে নেতাকর্মীরা কেন ‘মা’ সম্বোধন করে আবেগে আপ্লুত হন? তিনি কি নেতাকর্মীদের মা? নেতাকর্মীদের এই ‘মা’ শ্লোগান কেবল আবেগের বহি:প্রকাশ নয় বরং এর সুনির্দিষ্ট উপযুক্ত কারণ রয়েছে।
কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ২টি হলো:
(১) ১/১১ এর সময় যখন সেনা সমর্থিত মঈনউদ্দিন-ফখরউদ্দিন সরকার তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে গ্রেপ্তার করে বলেছিল খালেদা জিয়া তার ঔরসজাত সন্তানদের নিরাপদ রাখতে চাইলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে। তখন জবাবে তিনি বলেছিলেন:- “এ দেশ ছাড়া আমার কোন ঠিকানা নেই। বাঁচতে হলে এদেশেই বাঁচব এবং মরতে হলে এদেশেই মরব। দেশের জনগণকে ফেলে আমি কোথাও যাব না”।
সেনা সমর্থিত এই সরকারের শর্ত না মানার পেছনে কারণ হলো: তিনি যদি দেশ ছেড়ে চলে যান তাহলে তাঁর দলের নেতা কর্মীদের জীবনে নেমে আসবে সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন। দেশে গণতন্ত্রের চর্চা অনির্দিষ্ট কালের জন্য রহিত হবে। নেতা কর্মীদের যদি ঔরসজাত সন্তান থেকে আলাদা ভাবতেন তাহলে তিনি তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের জীবনের ঝুঁকি না নিয়ে শর্ত মেনে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। এই শর্ত না মানার ফলস্বরূপ বেগম খালেদা জিয়ার দুই সন্তানকেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন ও নিপীড়ন করা হলো। প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা চিকিৎসা গ্রহণের জন্য বাধ্য হয়ে দেশান্তর হলেন। একজন ইতোমধ্যে না ফেরার দেশে চলে গেছেন। অন্যজন সুদূর বিলেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বৃদ্ধ বয়সে স্বামী হারা এই নেত্রী রক্তে মাংসে গড়া একজন মানুষও বটে। তাঁরও বেদনায় বক্ষ বিদীর্ন হয়েছে। তবুও তিনি অন্য সাধারণ মাতার ন্যায় আচরণ করেননি বলেই তিনি লক্ষ কোটি নেতা কর্মীর ‘মা’।
(২) মুক্তিকামী বাংলাদেশী জনগণের ভরসার নির্ভর যোগ্য উপায় হলো গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা। জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীন উপায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা যতবার ব্যাহত হয়েছে ততবারই বেগম খালেদা জিয়া একমাত্র ভরসার কান্ডারী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছেন। সকল দু:শাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার আপোষহীন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে শহীদ জিয়ার হাতে শুরু হওয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার পরিবেশ ফিরিয়ে এনেছেন বেগম খালেদা জিয়া। কোন ষড়যন্ত্র কিংবা জুলুম--নির্যাতন তাঁকে গণতন্ত্র পূনরুদ্ধারের সংগ্রাম থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আজও কোন নির্যাতন, জুলুম বা ষড়যন্ত্র তাঁকে এই ব্রত থেকে বিরত রাখতে পারবেনা। মা যেমন সন্তানের জন্য নির্ভরযোগ্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল, ইতিহাস প্রমান করে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও এর অবাধ চর্চা একই ভাবে বেগম খালেদা জিয়ার হাতেই নিরাপদ। সঙ্গতকারণে বেগম খালেদা জিয়াকে নেতা কর্মী ও দেশবাসী যখন ‘গণতন্ত্রের মা’ বলে আখ্যায়িত করেন তখন তা যথার্থ বলেই প্রতীয়মান হয়।
আমরা লক্ষ করেছি যে, বেগম জিয়া ৭১ সালে প্রথমে আত্মগোপনে ছিলেন পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে শিশু সন্তানদের রক্ষা করার জন্য। পরে বন্দি দশায় ৬ মাস কাটিয়েছেন হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরবর্তীতে তিনি সেনা সমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক কারাবন্দী ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাও কারা বন্দী ছিলেন একই বাহিনীর হাতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বেগম খালেদা জিয়া এখন কোনো বাহিনী কর্তৃক কারাবন্দী? বর্তমান সরকারের বিবেচনায় নেওয়া উচিত, নিপীড়ন নির্যাতন করে ক্ষমতায় চিরকাল টেকা যায় না। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী পারেনি, স্বৈরাচার এরশাদ পারেনি, মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অসাংবিধানিক সরকার ও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। প্রতিটি ক্ষেত্রে জুলুমবাজ বাহিনীর কিংবা সরকারের পতনের নেতৃত্ব দিয়েছেন শহীদ জিয়া এবং তাঁর আদর্শ পুষ্ট আপোষহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এবারও বর্তমান সরকারের জুলুম, নির্যাতনকে উপেক্ষা করে নব্য স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে বেগম খালেদা জিয়া দেশবাসীর ভরসার প্রতীক।
দেশনেত্রী এখন মিথ্যা মামলায় বিনা চিকিৎসায় কারাবন্দী আছেন। বহুবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে দেশনেত্রী নিজের ও সন্তানদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের লক্ষ কোটি সন্তানের নিরাপত্তা বিধানে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করেছেন। এবার বিএনপির নেতাকর্মী ও লক্ষকোটি দেশবাসীর ঋণ শোধ করার পালা। মিথ্যা মামলায় কারাবন্দী ‘মা’ বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবার দায়িত্বভার এবার দেশবাসীকে নিতে হবে।
বর্তমান সংকট নিরসনে দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন সংগ্রামী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কারামুক্তির কোন বিকল্প নেই। কারণ এই সংগ্রামে বিজয়ের জন্য প্রয়োজন আপোষহীন নেতৃত্ব। বাংলাদেশের ইতিহাস প্রমাণ করে এ ধরনের নেতৃত্বের জন্য বেগম খালেদা জিয়া তুলনাহীন। অতীতের ন্যায় তার আপোষহীন নেতৃত্বেই নির্দলীয় সরকারের দাবী আদায় করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব। আর এর মাধ্যমেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা পুর্নবহাল করা সহ দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। চলুন আমরা সবাই বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্ত করার মাধ্যমে এমন একটি স্বপ্ন পূরনের আন্দোলন ও সংগ্রামের মিছিলে মুক্তিকামী দেশবাসীর সহযাত্রী হই।
লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান, দর্শন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।