ডা. ওয়াজেদ খান
সাদেক হোসেন খোকা স্মরণে
‘ডেড বডি ইজ সামবডি’
প্রকাশ: ০৬:৩৮ পিএম, ৪ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০২:৩২ এএম, ২০ নভেম্বর, বুধবার,২০২৪
মানুষ মরণশীল। তারপরও মৃত্যু মানুষকে কাঁদায়। মৃত্যুর রূপ নাকি বীভৎস। যদিও এটা ধারণা প্রসূত। মৃত্যুর অভিজ্ঞতা নেই কারো। মৃত্যুর কোনো কাল নেই। অকাল মৃত্যু বলে নেই কিছু। মানুষ তার জীবনকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। পৃথিবীর মায়া। সংসার-স্বজনের প্রতি গভীর মমত্ববোধ। তাই সবকিছুর বিনিময়ে মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। খড়-কুটো ধরে ভাসতে চায় অথৈই সমুদ্রে। আবার মানুষই তার নিজ হাতে সংহার করে প্রিয় জীবন। বেছে নেয় আত্মহননের পথ। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই চুকে যায় মানুষের জীবনের সকল হিসেব-নিকেশ। চাওয়া-পাওয়া, লোভ-লালসা। মূল্যহীন হয়ে পড়ে অর্থ-বৈভব, প্রতিপত্তি।
মৃত ব্যক্তির প্রতি সব ধর্মের মানুষ ও সমাজ সম্মান দেখায়, হয় সহানুভূতিশীল। ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে মৃত ব্যক্তির সবকিছু। প্রয়োজনে রাষ্ট্রও সম্প্রসারিত করে সহযোগিতার হাত। কিন্তু সেই রাষ্ট্র যখন তার জীবিত নাগরিকের প্রতি বিমুখ হয়। কেড়ে নেয় তার জন্মগত অধিকার। তখন স্বভাবতই জনমনে প্রশ্নের উদ্রেক করে। যেমনটি ঘটেছিলো বীরমুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। খোকা দেশে ফিরবেন। খোকা দেশে ফিরবেন কিনা। এ নিয়ে আমার একটি লেখাও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকার পাসপোর্ট ২০১৭ সালে নবায়নের জন্য নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটে জমা দেয়া হয়। নবায়ন না করে তার পাসপোর্ট আটকে দেয় সরকার। বন্ধ হয়ে যায় অবিভক্ত ঢাকার সাবেক নগরপিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পথ।
পরিবারের সদস্য ছাড়াও সাধারণ মানুষের মাঝে দেখা দেয় উৎকণ্ঠা। জীবিতাবস্থায় না হোক। মৃত্যুর পর পাসপোর্ট ছাড়া তার লাশ দেশে পাঠানো যাবে কিনা, তা নিয়ে। মৃত্যুর পর তার লাশ দেশে পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত হতে চেয়েছেন খোকা ভাই নিজেও। এ বিষয়ে বার বার তিনি আমাকে বলেছেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একদিন পর ১৮ অক্টোবর দেখতে যাই তাকে। শারীরিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ। তারপরও তিনি একান্তে বললেন-এবার আর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরা হবে না। তার লাশ যেন দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। আমি তাকে অভয় দিলাম। পরদিন যোগাযোগ করলাম কনস্যুলেটে। একজন কর্মকর্তা জানালেন, তার পাসপোর্টের কোনো অগ্রগতি নেই। জীবিতাবস্থায় ফিরতে হলে প্রয়োজন পাসপোর্ট অথবা ট্রাভেল পারমিট। সে সময় ও সুযোগ আর নেই। তিনি বললেন, মৃত ব্যক্তির জন্য পাসপোর্টের কোনো প্রয়োজন নেই। ডেথ সার্টিফিকেট ও ফিউনারেল হোমের কাগজপত্রই যথেষ্ট। এসব হলেই লাশ দেশে পাঠানো যায়। কূটনৈতিক পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডেড বডি ইজ নো বডি’। সেই প্রথায় মৃত্যুর পর সাদেক হোসেন খোকার লাশ দেশে পাঠাতে কোনো বাধা নেই। তার স্ত্রীর পাসপোর্টও আটকে দিয়েছে সরকার। তিনি যদি দেশে ফিরতে চান, কনস্যুলেট থেকে ট্রাভেল পারমিট সংগ্রহ করতে হবে তার স্ত্রীকে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের কার্পণ্য করা হবে না বলে আশ্বাস দেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এর প্রায় দু’সপ্তাহ পর মৃত্যু হয় সাদেক হোসেন খোকার।
পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস কোনোকিছুর বালাই নেই মৃত ব্যক্তির ভ্রমণে। স্বদেশে ফিরেছেন সাদেক হোসেন খোকা। নিথর দেহে কফিনবন্দী হয়ে। তার স্বদেশ যাত্রা রুখতে পারেনি কেউ। ম্যানহাটানের মেমোরিয়াল স্নোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতালের ৫১১ নম্বর কক্ষ থেকে ঢাকার জুরাইন কবরস্থানে। বাবা-মায়ের কবরের পাশে শায়িত খোকার সাধ মিটেছে। পূর্ণতা পেয়েছে তার অন্তিম ইচ্ছা। ৭ নভেম্বর সকালে শাহজালাল বিমানবন্দরের শিশির ভেজা রানওয়ে স্পর্শ করে খোকাকে বহনকারী বিমান। মুহূর্তে ঠুকরে কেঁদে উঠে তার স্বপ্নের মহানগরী ঢাকা। দলমত ধর্ম নির্বিশেষে লাখো মানুষ দাঁড়িয়ে যায় তার কফিনের পাশে। ঢাকায় অর্ধডজন জানাজায় মানুষের ঢল। বিমানবন্দর থেকে জুরাইন কবরস্থান পর্যন্ত জনতার স্রোত। খোকার প্রতি সাধারণ মানুষের নিখাদ ভালোবাসা ও বিনম্র শ্রদ্ধার সংমিশ্রণ। যা ছিলো অতুলনীয়, অভাবনীয়। নজিরবিহীন এ দৃশ্য দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল। কথা ছিলো রাজনীতিক খোকা একটি বারের জন্য হলেও লাখো জনতার মিছিলের অগ্রভাগে হাঁটবেন। গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এর বিকল্প নেই। এমন মন্তব্য শুনেছি তার কাছ থেকে। শেষ মিছিলের অগ্রভাগে তিনি ঠিকই ছিলেন তবে কফিনবন্দী হয়ে।
বিলম্বে হলেও সরকার অসীম সাহসী এ গেরিলা যোদ্ধার প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শন করেছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়েছে তাকে। এরমধ্য দিয়ে রাষ্ট্র কিছুটা হলেও হয়েছে দায়মুক্ত। কুলখানিতে ভেঙে পড়েছে ঢাকাবাসী। সবার সাথে নির্বিরোধ সম্পর্ক তাকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয় করে তোলে। মৃত্যুর দিনই নিউইয়র্ক নগরীর জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় তার প্রথম জানাজা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয় তাতে। স্থানীয় কনস্যুলেটের সরকারি কর্মকর্তাও অংশ নেন জানাজায়। অসুখ মানেই সুখ নেই। সুখের অভাব। আর ক্যানসার হলেতো কথাই নেই। বড় বেশি নচ্ছার, বজ্জাত রোগ ক্যানসার। একবার কারো দেহে বাসা বাঁধলে বটবৃক্ষের মূলের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে তাকে। খোকা ভাইকেও পেয়ে বসেছিলো ঘাতক এই ব্যাধিটি। নিউইয়র্কের বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল স্নোয়ান ক্যাটারিং হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা চলছিলো। তারপরও মাঝে মধ্যেই নানা ধরনের নতুন নতুন উপসর্গও জটিলতা দেখা দিতো তার দেহে। মৃত্যুর প্রায় মাস তিনেক পূর্বে এক সন্ধ্যায় ফোন পেয়ে তার বাসায় গেলাম। বরাবরের মতো সেদিনও সোফায় পাশে বসে অসুস্থতার কথা শুনছিলাম। স্পাইনাল কর্ড পর্যন্ত বিস্তৃতি ঘটেছে ক্যানসারের। পৃষ্ঠদেশে প্রচণ্ড প্রদাহ। চিকিৎসক ঔষুধ পাল্টে দিলে নানাবিধ উপসর্গ দেখা দেয়। তেজোদীপ্ত মানুষটির চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠে অসহায়ত্বের ছাপ।
পৃথিবীতে মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় যে জিনিসটি সেই জীবন ও বেঁচে থাকার প্রতি আকুতি লক্ষ্য করি তার মাঝে। একসময় হঠাৎ করেই তিনি বললেন ‘ওয়াজেদ ভাই, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। কখন কী হয়, কোনো কিছু ঘটলে আমার লাশটা দেশে পাঠাবেন, যেভাবেই হোক।’ আমার প্রতি তার বিশেষ আস্থা ছিলো। আমি তাকে অভয় দিলাম। বললাম সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। বারণ করলাম অলক্ষুণে এসব কথা মুখে না আনতে। এরপর মাঝে বেশ কিছুদিন শরীরটা বেশ ভালোই ছিলো। আবার শরীর খারাপ হলে হাসপাতালে ভর্তি হোন ১৮ অক্টোবর। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ দিন পর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ২০১৯ সালের ৪ নভেম্বর ভোর রাতে।
এর আগে ২০১৬ সালের ৯ জুন থেকে ২৯ জুন কোমরের হাড়ে অপারেশনের পর একই হাসপাতালে টানা ২০ দিন ভর্তি ছিলেন খোকা ভাই। সে যাত্রায় ভালোভাবেই বাসায় ফিরেন। এবার ভর্তির ৯ দিন পর তার ফুসফুসে অপারেশন করা হলে দ্রুত অবনতি ঘটে তার স্বাস্থ্যের। তিনি ভেঙে পড়েন মানসিকভাবে। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অহমিকা বোধ বিবর্জিত এমন একজন মানুষের সাথে আমার পরিচয় দু’যুগ পূর্বে। ১৯৯৯ সালের শীতার্ত এক সকালে বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার ফোন পেলাম। বিনয়ের অবতার মান্নান ভাই জানালেন, সাদেক হোসেন খোকা নিউইয়র্ক যাচ্ছেন। তার যেন খোঁজ-খবর নেই। এর আগের বছর তার বোন ও ভগ্নিপতি ইমিগ্র্যান্ট হয়ে নিউইয়র্ক এসেছেন। তাদের আগমনের পূর্বেও মান্নান ভাই ফোন করেছিলেন। খোকা ভাই এসে নিউইয়র্কে তার বোনের বাসায় উঠেছিলেন। সেখানেই আমার সাথে প্রথম পরিচয়। সেসময় তিনি জ্যামাইকাস্থ সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকা অফিসে বেশ ক’বার এসেছেন। জ্যাকসন হাইটসের আজকের যে কাবাব কিং রেস্টুরেন্ট সেখানে স্থানীয় মিডিয়ার সাথে মতবিনিময়ের আয়োজন করি। এরপর তিনি যতবার নিউইয়র্ক এসেছেন দেখা হয়েছে। আমরা সময় কাটিয়েছি। দেশে গেলেও তিনি কীভাবে যেন খবর পেয়ে যেতেন। সময়ের স্বল্পতার জন্য একবার তার সাথে দেখা না করেই ফিরতে চেয়েছিলাম। সম্ভব হয়নি।
ঢাকায় আমার অবস্থানের খবর পাওয়ার সাথে সাথেই ফোন করলেন পরদিন দুপুরে তার গুলশানের বাসায় যেতে। দুপুরে তার বাসায় গেলাম, সঙ্গে আমার একজন আত্মীয় ছিলেন। ভাবি সে সময়টায় ছিলেন লন্ডনে। এলাহী কাণ্ড। টেবিল জুড়ে দেশীয় খাবারের সমাহার। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। অতিশয় সাদামাটা ব্যক্তি। মনে হলো মাওলানা ভাসানীর সত্যিকারের একজন অনুসারী। খোকা ভাইয়ের সাথে এক টেবিলে আমার শেষ নৈশ ভোজ ছিলো ২৮ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে বারোটায়। ইস্ট এলমহার্স্টের বাসায়। এর আগে রাত ১২টা পর্যন্ত আড্ডা চলে। এ সময় তার শারীরিক অবস্থা ছিলো অনেকটাই উন্নত। সে রাতে আড্ডায় ছিলেন বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, আব্দুস সালাম, ফ্লোরিডা বিএনপির সভাপতি মো. দিনাজ খান, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি নেতা জসীম ভূঁইয়া। অতিথি পরায়ণ ও বন্ধু-বাৎসল এ মানুষটির সঙ্গে আমার শেষ কথা হয় মৃত্যুর তিনদিন আগে। ৩১ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় তার হাসপাতালের ৫১১ নম্বর কক্ষে। তখনকার অবস্থা ছিলো অনেকটাই মুমূর্ষু। প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। এসময় আমার সঙ্গে ছিলেন পরিচয় পত্রিকার সম্পাদক নাজমুল আহসান, মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদ খন্দকার ও বাংলাভিশনের নীহার সিদ্দিকী। খোকা ভাই তাদেরকে ইশারায় বাইরে যেতে বললেন। আমার সঙ্গে কিছু কথা বলে ভারমুক্ত করতে চাইলেন নিজেকে। সেদিনও তিনি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন তার লাশ দেশে পাঠানো হচ্ছে কিনা। এরপর আর তার সঙ্গে কোনো কথা হয়নি। পরের তিনদিন তিনি কথা বলতে পারেননি। শুক্রবার, শনিবার শুধু চোখ মেলেছেন। রোববার রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ হাসপাতাল থেকে বের হই তাকে দেখে। বাসায় ফিরি প্রায় রাত ১টার দিকে। রাত দেড়টায় বিছানায় যাই। ভোর রাত সোয়া ৩টার দিকে সাংবাদিক মনির হায়দারের ফোন আসে খোকা ভাই নেই। ২টা-৫০মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
তিনটায় ডাক্তার ঘোষণা দেন মৃত্যুর। সাথে সাথে কয়েকজনকে ফোনে দু’সংবাদটি পৌঁছে দেই। জ্যামাইকা থেকে চলি ম্যানহাটানের দিকে। পথিমধ্যে জ্যাকসন হাইটস থেকে ইন্ডিপেডেন্ট টিভির সোলায়মানকে তুলে নিয়ে যাই। সে রাতে শুল্কপক্ষের চাঁদ ডুবে গেছে প্রথম প্রহরেই। হাসপাতালের প্রায় গাঁ ঘেঁষে প্রবাহিত ইস্ট রিভারে তখন ভাটার টান। রাস্তা কিছুতেই ফুরোচ্ছিলো না। বিশ্বের দীর্ঘতম সেতু মনে হচ্ছিলো কুইন্স ব্রিজকে। নির্ঘুম রাত কাটে যার সেই নিউ ইয়র্ক মহানগরীও সে রাতে ছিলো নিদ্রামগ্ন। ধল প্রহরের তখনও অনেক বাকি। সিটির মসজিদগুলোতে ধ্বনিত হয়নি মুয়াজ্জিনের আজান। জ্বলজ্বলে ইয়র্ক এভিন্যুকেও তখন মনে হচ্ছিলো মৃত কোন সরীসৃপ। পড়ে আছে সটান হয়ে। চারটা নাগাদ পৌঁছে যাই হাসপাতালে। সে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বাইরের হিমশীতল হাওয়ার চেয়ে তখনও উষ্ণ ছিলো খোকার ভাইয়ের দেহ। দেখলাম আসলেই ছোট্ট খোকার মত ঘুমিয়ে আছেন তিনি। আজ আর আমাকে দেখে তার চেহারায় কোন পরিবর্তন আসেনি। খোকা ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে দৃষ্টি। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত। মৃত্যুর দু’দিন আগে হাসপাতালে দৃষ্টি আমাকে বসতে বললো খোকা ভাইয়ের শয্যা পাশে। দৃষ্টি বললো, অংকেল, আব্বা আপনাকে খুব পছন্দ করতেন। আপনি সামনে এলে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।’ দৃষ্টির এমন মন্তব্যকালে তার চোখের কোণায় পানি জমে উঠে। আমিও হয়ে উঠি আবেগাপ্লুত।
সূর্য উঠার আগেই হদিস করি ফিউনারেল হোমের। ঘুম থেকে জাগিয়ে দেই জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারের সেক্রেটারি মঞ্জুর চৌধুরীকে। ব্রুকলীনের মুসলিম ফিউনারেল সার্ভিসের সাথে কথা হয় আমাদের। খোকা ভাইর দুই পুত্র ইশরাক, ইশফাক ও তার দীর্ঘদিনের সহচর মান্নাকে নিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করি হাসপাতালের প্রেয়ার রুমে। ইশরাক ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করলো। ফিউনারেল হোম, ডেথ সার্টিফিকেট সব কিছু সকাল ৮টার মধ্যেই ঠিক হয়ে যায়। বাদ এশা জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে খোকা ভাইয়ের জানাজায় ঢল নামে মানুষের। তাকে একনজর দেখার জন্য ভিড় জমে যায়। এখানে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধারা শেষ শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এ সেনানীর প্রতি। খোকা ভাইকে শেষ বিদায় জানাই ব্রুকলীনের মুসলিম ফিউনারেল সার্ভিসে। সেখানে তার পরিবারের ঘনিষ্টজনরা ছিলেন। আমার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা আবু জাফর মাহমুদ, মুক্তিযোদ্ধা ফরহাদ খন্দকার ও কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন। সাড়ে ৩টায় আমরা ফিউনারেল হোম ত্যাগ করার আধা ঘণ্টার মধ্যে তার কফিন বিমান বন্দরে নেয়া হয়।
খোকা ভাই বয়সে আমার বেশ অনেকটা বড়। তারপরও আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। ফোনে বা দেখা হলে আমার আগেই সালাম দিতেন তিনি। কথা বলার চেয়ে বেশি পছন্দ করতেন শুনতে। দীর্ঘ দু’দশকে তার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি বিজড়িত। বিশেষ করে ২০১৪ সালের মে মাসে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য নিউইয়র্কে আসার পর আড্ডা ও ভ্রমণে অনেক সুবর্ণ সময় কেটেছে তার সান্নিধ্যে। আমার বাসায় এসেছেন। ২০১৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমরা ফ্লোরিডা বেড়াতে যাই। লং ড্রাইভে গিয়েছি কি ওয়েস্ট পর্যন্ত। এসব স্মৃতিকথা পরে সময় করে লিখবো। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী খোকা ভাই। পুরনো ঢাকার ৪১ গোপীবাগ ১ নম্বর লেন থেকে উঠে আসা একজন জননেতা। মৃত্যুর পর দেশের মানুষ তার মূল্যায়ন করেছে।
মানুষের ভালোবাসা শ্রদ্ধায় প্রমাণিত হয়েছে জীবিত খোকার চেয়ে মৃত খোকা অনেক বেশি শক্তিশালী। সবকিছু মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে কূটনৈতিক পরিভাষা ‘ডেড বডি ইজ নো বডি’। প্রবাদটি সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কখনো কখনো ‘ডেডবডি ইজ সামবডি’। লাল সবুজের পতাকায় মোড়ানো খোকা ভাইয়ের কফিন তা প্রমাণ করেছে।
লেখক : সম্পাদক, সাপ্তাহিক বাংলাদেশ, নিউইয়র্ক।
দিনকাল/এসএস