কমিশন গঠনের ১৮ বছর, ঝুলে আছে ৩৫৯৫ দুর্নীতির মামলা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:৪৬ পিএম, ২০ নভেম্বর,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:১৭ পিএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা প্রায় সাড়ে তিন হাজার মামলা ঝুলে আছে বিচারের অপেক্ষায়। শুনানি হয়, সাক্ষ্য গ্রহণও হয় কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি আর হয় না। বছরের পর বছর এসব মামলা নিম্ন ও উচ্চ আদালতে বিচারাধীন বা স্থগিত অবস্থায় আছে। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার মধ্যে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগেই বিচারাধীন আছে তিন হাজার ২৩৫টি। উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত আছে আরও ৩৬০টি মামলার কার্যক্রম। ১৮ বছর আগে ২০০৪ সালে বিলুপ্ত হওয়া দুর্নীতি দমন ব্যুরোর আমলে দায়ের করা ৪১৭টি মামলার নিষ্পত্তিও হয়নি এখনও। এরমধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ব্যুরো আমলের মামলা স্থগিত রয়েছে ১৮৬টি। কবে নাগাদ এসব মামলার নিষ্পত্তি হবে সেটা সংশ্লিষ্ট কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেননি।
দুদক ও আদালত সূত্রে জানা যায়, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন, আয়কর ফাঁকি ও দুর্নীতি লুকাতে সম্পদের তথ্যে গরমিল, ঘুষ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব মামলা করে। মামলা দায়েরের পর বিবাদী পক্ষ আইনি প্রতিকার পেতে বিচারিক আদালতসহ উচ্চ আদালতে যান। মামলার ওপর স্থগিতাদেশের জন্যও অনেকে উচ্চ আদালতে যান। কোনো ব্যক্তির সম্পদের হিসাব চাইলে তিনি উচ্চ আদালতে দুদকের সংশ্লিষ্ট নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটও করেন। তখন সেই রিট নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দুদক তার কার্যক্রম চালাতে পারে না। যে কারণে দুদকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বাড়ছে। মামলা পরিচালনায় দুদকের নিজস্ব আইনজীবী প্যানেলও রয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাইকোর্ট বিভাগে দুদকের চলমান মামলা বিচারাধীন রয়েছে ২ হাজার ৭৬২টি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন আছে ৪৭৩টি মামলা। সব মিলিয়ে উচ্চ আদালতেই বিচারাধীন আছে ৩ হাজার ২৩৫টি মামলা। স্থগিতাদেশ আছে আরও ৩৬০টি মামলার ওপর। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিচারিক আদালতে দুদকের মামলার পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে, ২ হাজার ৯৪২টি মামলা বিচারাধীন আছে। যারমধ্যে উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত আছে ২৪০টি মামলার কার্যক্রম। ১৫২টি মামলায় সাজা ও ৬৬ মামলায় খালাস দেয়া হয় আসামিদের। অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয়েছে ২৮টি মামলার। বিচারিক আদালতে বিলুপ্ত ব্যুরোর ৪১৭টি মামলা বিচারাধীন আছে। এরমধ্যে স্থগিত আছে ১৮৬টি মামলা। ১১টি মামলায় সাজা ও ৯টি মামলায় খালাস দেয়া হয় আসামিদের। অন্যান্যভাবে নিষ্পত্তি করা হয় আরও ১১টি মামলা। দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে উচ্চ আদালতে দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, বিচারিক ও উচ্চ আদালতে দুর্নীতির মামলা নিয়মমাফিক চলছে। এখানে দুদকের কিছু করার নেই। দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। অনেক মামলাই তালিকায় আছে। এগুলো ধারাবাহিকভাবে আইন ও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হবে। একই বিষয়ে দুদকের আরেক সিনিয়র আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, দুদকের হোক আর যার হোক, মামলা যখন ফাইল হয়ে যায়, তখন এগুলো কোর্টের মামলা হয়ে যায়। কোর্ট মামলাগুলো নিষ্পত্তি করে তার একটা নিজস্ব পদ্ধতিতে। এখানে সাক্ষী আসতে হবে। সাক্ষী যদি না আসে তাহলে আদালত ব্যবস্থা নিবে।
তিনি বলেন, মামলা দীর্ঘায়িত হলে বাদী-বিবাদী সবাই ভোগান্তির শিকার হয়। সবই আদালতের এখতিয়ারে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, আমাদের আইনগত প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার শিকার দুর্নীতির মামলাগুলো। মামলা পরিচালনায় দক্ষতার ঘাটতি থাকলে এবং প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণেও মামলা দীর্ঘায়িত হয়। এক্ষেত্রে বড় ধরণের মামলাগুলো অর্থাৎ যে দুর্নীতির কারণে জাতীয় ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বেশি, সেগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে দুদক একটা কর্মপরিকল্পনা নিলে ভালো হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষ কোনও দৃষ্টি দেয়া হয়নি। সক্ষমতা অনুযায়ী তারা কী ধরনের মামলা প্রাধান্য দিবে, যে সক্ষমতা আছে সেটা কোথায় প্রয়োগ করবে, সে বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কোনও পরিকল্পনা নিতে পারেনি। নিতে পারলে কিছুটা সমাধান পাওয়া যেতো। তবে দুদকের মামলাগুলোর নিষ্পত্তি শুধুমাত্র তাদের সক্ষমতার ওপরই নির্ভর করে না। এখানে আইন প্রয়োগের প্রক্রিয়ার মধ্যে বিচারিক প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য পক্ষ আছে। দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে তাদেরও সহায়তার দরকার আছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, কমিশনের মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টি বিজ্ঞ আদালতের নজরে আনা হবে। আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবো সাক্ষ্য ও তথ্য-উপাত্ত যথাসময়ে উপস্থাপনের জন্য। দুদক এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তাছাড়া মামলা দীর্ঘায়িত হবার জন্য সাক্ষী না যাওয়াসহ কিছু বিষয় ও কারণ তো আছেই।