হাইকোর্টের রিমান্ডে হত্যা মামলা : মৃত্যুদন্ডের রায় পুনর্বিচারে কৃষ্ণা রানীর যাবজ্জীবন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:৫২ পিএম, ১১ আগস্ট,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:২৫ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
কক্সবাজারে ২৪ বছর আগের এক হত্যাকান্ডের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় পরপর দুই বার বিচার হয়েছে। একই বিচারিক আদালতে ভিন্ন ভিন্ন রায় হয়েছে ওই মামলার আসামি কৃষ্ণা রানী পালের বিরুদ্ধে। প্রথমে মৃত্যুদন্ড পরে হাইকোর্টের রিমান্ডে পুনর্বিচারে যাবজ্জীবন সাজা হয় তার। আপাতদৃষ্টিতে আশ্চর্য মনে হলেও ঘটনাটি সত্যি ও নিয়ম মেনেই এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। প্রথমবার রায় ঘোষণার পর ডেথ রেফারেন্স উচ্চ আদালতে আসার পরে আসামির করা আপিল আবেদনের শুনানির সময় হাইকোর্টের দেয়া নির্দেশনার আলোকে দ্বিতীয়বার একই আদালতে আবারো বিচারকাজ হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রথমে ১৯৯৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালত কক্সবাজারের বিচারিক আদালতের রায়ে হত্যা মামলার আসামি কৃষ্ণা রানী পালকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়বার সাক্ষ্যগ্রহণসহ মামলায় সব বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বিচার শেষে প্রায় দুই যুগ পর কক্সবাজারের একই আদালতে ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর ঘোষিত রায়ে এসে একই হত্যাকান্ডের ঘটনায় পরবর্তী রায়ে ওই একই আসামির যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। পরের রায়ে যাবজ্জীবন হলেও এতে ফৌজদারি আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি এবং নিয়ম অনুযায়ী আইন মেনেই বিচারকাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে মূল্যায়ন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা। নিয়ম অনুযায়ী এখন আসামি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলেও জানান তারা। রায়ে হাইকোর্টের রিমান্ড বা পুনঃবিচারের নিয়ম ও প্রক্রিয়া কি তার বর্ণনা ও বিশ্লেষণ দিয়েছেন আইনজীবীরা। তারা বলেছেন, নিয়ম অনুযায়ী একটি মামলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত ও বিচারিক (নিম্ন) আদালতের রায়ের বিষয়ে যদি কোনো ভুল-ত্রুটি উচ্চ আদালতের কাছে ধরা পড়ে তাহলে সেটি আবার রিট্রায়ালের জন্য পাঠাতে পারেন উচ্চ আদালত। সেখানে মামলার প্রয়োজনে আবার তদন্ত করা, সাক্ষীর জবানবন্দি, জেরা ও যুক্তিতর্ক শেষে আবারো রায় ঘোষণা করতে হবে। তাতে বিচারিক আদালতের রায়ে আসামির দন্ড কমতে বা বাড়তেও পারে। সেটা এখানে বিবেচ্য বিষয় না। এই প্রক্রিয়াকে তথা একই বিচারিক আদালতের রায় ওই আদালতে আবার বিচারের জন্যে পাঠনোকে হাইকোর্টের পক্ষ থেকে বিচারিক আদালতের রায়কে রিমান্ডে পাঠানো বলে। আবার যদি দীর্ঘদিনের পুরোনো মামলা হয়, আর উচ্চ আদালত যদি মনে করেন যে সঠিক বিচার হয়নি। তাহলে তা সংশোধন করে সঠিক জাস্টিজ শেষে রায় দিতে পারেন বলে মতামত দিয়েছেন আইনজ্ঞরা। এখন দন্ড যাই হোক না কেন আসামি আবার উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবেন। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, বিচারিক আদালতের কোনো মামলায় রায় ঘোষণার পরে সেটি যদি আপিলে আসে। আর উচ্চ আদালত সেই রায় দেখে যদি মনে করেন সেটি সঠিক হয়নি। তা হলে মামলাটি রিট্রায়ালে বা রিমান্ডে পাঠাতে পারেন। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এসএম মনিরুজ্জামান মনির এ বিষয়ে বলেন, মামলা রিমান্ডে নেয়া এটাতো কেইস টু কেইস ভেরি করে। যদিও মামলাটি কেন রিমান্ডে নেয়া হয়েছে কারণটি আমার জানা নেই। তবে, প্রক্রিয়া হচ্ছে যে কোনো বিষয়ে যদি মিসটেক থাকে তখন সেটি হাইকোর্ট পাঠিয়ে দেন নিচের কোর্টে (বিচারিক আদালতে) সেগুলো ঠিক করার জন্য। এ জন্যই রিমান্ডে পাঠায়। এতে মামলা দীর্ঘায়িত হয় কি-না জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের এই সিনিয়র আইনজীবী বলেন, এটা মামলা দীর্ঘায়িত হওয়ার বিষয় না। এটাতো বিচারিক প্রক্রিয়া। কারণ এটা আইনে আছে বলেই, মামলার রায়টি রিমান্ডে পাঠায়।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রধান আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার ড. মোহাম্মদ ইয়াসিন খান বলেন, হাইকোর্ট যে কোনো মামলায় রিমান্ডে দেয়ার সময় কিছু কিছু বিষয়গুলোর ওপর জোর দেন। আদালত মনে করেন এই এই বিষয়গুলোর ওপরে সঠিকভাবে সাক্ষ্য আসে নাই বা তদন্তেও আসে নাই। তখন স্বাভাবিকভাবে ট্রায়ালে যে জিনিসগুলোও ঠিক ঠিকভাবে আসেনি এরকম অস্পষ্ট বিষয়গুলোর ওপরে হাইকোর্ট অবজারভেশন দিয়ে সেখানে এতদিন বা এই সময় সীমার মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার জন্য ডিরেকশন দেন। ওই ডিরেকশন এর আলোকে কোর্ট ট্রায়াল করবে এবং নিষ্পত্তি করবে। এরপরে জাজমেন্টে যা হয় তা হবে, রায়ে সাজা বাড়তে পারে কমতেও পারে। এ বিষয়ে ফৌজদারি মামলা পরিচালনা করে আসা সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এসএম শাহজাহান বলেন, প্রক্রিয়াটা হলো যে কোনো মামলায় মৃত্যুদন্ড হওয়ার পরে ওই আসামি যদি আপিল ফাইল নাও করেন কিন্তু মৃত্যুদন্ড কনফারমেশনের জন্য সিআরপিসির ধারা ৩ এর (৭৩) অনুযায়ী এখানে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) কেইস স্টার্ট হবে। এখানে ডেথ রেফারেন্সটা হাইকোর্টের দুজন বিচারপতি শোনার পরে যদি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ মনে করেন বা ওনারা দেখেন যে জাজমেন্টটা ঠিক হয়নি। জাজমেন্টের ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়ে তখন রিট্রায়ালে পাঠাতে পারেন। তাদের সুপার পাওয়ার আছে জুরিসডিকশন আছে। রিমান্ডে পাঠালে পরবর্তী সময় বিচার যেটা হলো সেখানে হয়তো আসামির যাবজ্জীবন দেয়া হলো। এটা হয়তো বা পরে যিনি বিচার করছেন উনি মনে করেছেন মৃত্যুদন্ডের চেয়ে যাবজ্জীবনই এপ্রিশিয়েট হয়। তার এগেইনস্টে এই যে আপিল আবেদন করা হবে এই আপিলটি এখন শুনানি হবে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) এর চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, হাইকোর্টে তো বিচার করবে যে পেপারস আছে সেই পেপারস এর ওপরে। পেপারসের বাইরে করার সুযোগ নেই। এখানে যদি দেখা যায় যে, আসলে এই ঘটনা প্রমাণ করার জন্যে যে উপাদানটি দরকার ছিল ওই জিনিসটি আসেনি। কিন্তু সেটা হলে পরে বিচারটি নিশ্চিত করা যেতো তখনই মাত্র হাইকোর্ট এই মামলা রিমান্ডে পাঠান। মামলার বিবরণে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার কৃষ্ণা রানী পাল নামের এক নারীর বাসায় ভাড়া থেকে ইট ভাঙার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন লায়লা বেগম (২৫)। এক মাস কাজ করার পরে তাকে (লায়লা বেগম) কক্সবাজারে হোটেলে নিয়ে অসামাজিক কাজের জন্যে কু-প্রস্তাব দিয়ে চাপ প্রয়োগ করা হয়। লায়লা তাতে রাজি না হয়ে সকালে বাসা থেকে বের হয়ে যাবেন বলে জানান। ১৯৯৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাতে লায়লার ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দেন কৃষ্ণা রানী পাল। যদিও ওই ঘরের মধ্য দিয়ে কৃষ্ণা রানী পালের ঘর থেকে ঢোকার মতো একটি রাস্তা ছিল। এরপর ঘরে ঢুকে ঘুমন্ত অবস্থায় লায়লার গায়ে ফুটন্ত পানি ঢেলে দেন কৃষ্ণা। তাতে লায়লা বেগমের মাথা, মুখে ও দেহে গুরুতর জখম হয়। গায়ে গরম পানি অনুভব করে লায়লা চিৎকার দিয়ে উঠে দেখে কৃষ্ণা রানী পাল হাতে একটি দা নিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে, আর বলছে চিৎকার দিলে মেরে ফেলবে। প্রতিবেশীরা লায়লাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এরপরে তার জীবন বিপন্ন হতে পারে এই আশঙ্কায় কৃষ্ণা রানী পালকে অভিযুক্ত করে ওই ঘটনায় আহত লায়লা বেগমের পক্ষে কক্সবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিয়াজ মোহাম্মদ নিজেই বাদী হয়ে ১৯৯৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মামলা (মামলা নং: ২৩) করেন। তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন (বিশেষ বিধান) আইন, ১৯৯৫ এর ৫ (খ) ও (ঙ) রুজু করেন এবং কক্সবাজারের তৎকালীন এসপির নির্দেশে নিজেই মামলার তদন্তভার গ্রহণ করেন। অভিযোগের তদন্ত চলাকালে লায়লা বেগম ওই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর মারা যান। এরপর তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ওই মামলায় মোট ২৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। যুক্তিতর্ক ও বিচার শেষে ১৯৯৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের বিচারক (তৎকালীন দায়রা জজ) মো. আব্দুল গফুর রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আসামি কৃষ্ণা রানী পালের মৃত্যুদন্ড হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (পাবলিক প্রসিকিউটর) ছিলেন নুরুল মোস্তফা। আর আসামি পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ ও মো. খোরশেদ আলম। ওই রায়ের ডেথ রেফারেন্স আসে হাইকোর্টে। একইসঙ্গে আপিল আবেদন করেন আসামি। শুনানি শেষে ২০০২ সালের ২৬ জুন হাইকর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রায়টি কক্সবাজার আদালতে পুনরায় বিচারের জন্যে রিমান্ডে পাঠান। এরপরে ওই মামলায় নতুন করে চার্জশিট দাখিল করা হয় ২০০৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। এরপর প্রয়োজনীয় সাক্ষী নিয়ে ২০২১ সালের ২২ নভেম্বর রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে একই আদালত আসামি কৃষ্ণা রানী পালকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন। আসামি কৃষ্ণা রানী পাল হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে কারাগারের বাইরে আছেন বলে নিশ্চিত করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট বুলবুল রাবেয়া। তিনি কৃষ্ণা রানী পালের আইনজীবী হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইডের পক্ষে ওই রায়ের বিষয়ে আপিল আবেদনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।