নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন, ৭ বছরেও কার্যকরি হয়নি রায়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:০৮ পিএম, ২৭ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০২:১৯ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
আজ ২৭ এপ্রিল মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ও নৃশংসতম সাত খুনের ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হলো। ২০১৪ সালে র্যাব-১১-এর কয়েকজন কর্মকর্তা দ্বারা সংঘটিত এ হত্যাকন্ত শুধু নারায়ণগঞ্জ বাসীকেই নয়, পুরো বিশ্ববাসীকেও নাড়া দিয়েছিল। কিন্তু হত্যাকান্ডের সাত বছর পূর্ণ হলেও অদ্যাবধি তার রায় বাস্তবায়িত হয়নি।
নিম্ন আদালতের পরে হাইকোর্টে দ্রুত রায় ঘোষণা করা হলেও আপিল বিভাগে রায়টি নিষ্পত্তি হতে ধীরগতির অভিযোগ করেছেন নিহতদের স্বজনরা।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের একটি আদালতে হাজিরা শেষে প্রাইভেট কারযোগে ফিরছিলেন সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন ও গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম।
একই সময়ে আদালতের কার্যক্রম শেষে অপর একটি প্রাইভেটকারে বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহীম। পথিমধ্যে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের সামনে থেকে সাদাপোশাক পরিহিত র্যাব সদস্যরা তাদের সাতজনকেই অপহরণ করেন।
এ ঘটনায় উত্তাল হয়ে ওঠে নারায়ণগঞ্জ। দফায় দফায় চলতে থাকে ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড অবরোধ।
৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীর চর ধলেশ্বরী এলাকা থেকে ছয়জনের ও ১ মে একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সাতজনকে হত্যাকান্ডের ঘটনায় একই পন্থা ও কায়দা অবলম্বন করা হয়। নিহতদের মধ্যে সবাইকে একই পদ্ধতিতে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়, যাতে লাশ ভেসে উঠতে না পারে।
পরে উদ্ধার করা লাশের সবারই হাত-পা বাঁধা ছিল, পেট ছিল ফাঁড়া। ১২টি করে ইটভর্তি সিমেন্টের বস্তার দুটি বস্তা বেঁধে দেওয়া হয় প্রতিটি লাশের সঙ্গে। সব লাশের মুখ ছিল ডাবল পলিথিন দিয়ে মোড়ানো। মামলা চলাকালে প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনাসহ নানা ঘটনায় গেল পৌনে তিন বছর ধরেই আলোচিত ছিল সাত খুনের মামলাটি।
এদিকে তদন্ত শেষে প্রায় এক বছর পর ২০১৫ সালের ৮ এপ্রিল নূর হোসেন, র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় নারায়ণগঞ্জ ডিবি পুলিশ। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুটি মামলায় নূর হোসেনসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
দুটি মামলাতেই অভিন্ন সাক্ষী হলো ১২৭ জন করে। যার মধ্যে দুটি মামলার বাদী, দুজন তদন্তকারী কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ১০৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ ও জেরা সম্পন্ন হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর থেকে শুরু হয় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুনানি ও তাদের বক্তব্য গ্রহণ কার্যক্রম। ২১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। গত ৩০ নভেম্বর শেষ হয় আলোচিত সাত খুন মামলার আইনি কার্যক্রম।
২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি সকাল ১০টা ৪ মিনিট থেকে ১০টা ৯ মিনিট পর্যন্ত তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ এনায়েত হোসেন আলোচিত সাত খুন মামলার রায় ঘোষণা করেন।
এ মামলার প্রধান আসামি নাসিকের বরখাস্তকৃত কাউন্সিলর নূর হোসেন, র্যাবের চাকরিচ্যুত অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, উপ-অধিনায়ক মেজর (অব.) আরিফ হোসেন ও ক্যাম্প ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) এম এম রানাসহ ২৬ জনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। বাকি ৯ জনের মধ্যে অপহরণ ও লাশ গুমের সঙ্গে জড়িত থাকায় এক আসামিকে ১৭ বছর, অপহরণের সঙ্গে জড়িত থাকায় ৬ জনকে ১০ বছর এবং লাশ গুমে জড়িত থাকায় ২ জনকে ৭ বছরের কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত।
হাইকোর্ট ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট ৭ খুনের মামলায় ১৫ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দেন। হাইকোর্ট নিম্ন আদালতে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া ১১ আসামির দন্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন। ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর দুই মামলায় মোট ১ হাজার ৫৬৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করেন হাইকোর্ট। পরে আসামিরা রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান। ইতিমধ্যে ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত ১০ জনসহ ১৩ জন আপিল করেছেন।
ওদিকে নিম্ন আদালতে ও হাইকোর্ট মামলাটির কার্যক্রম দ্রুত চলমান থাকলেও আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা। অন্যদিকে মামলাটির রায় দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে হত্যাকারীদের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটির রায় ঘোষণার পর হাইকোর্টেও মামলাটির রায় দ্রুত ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগে মামলাটির কার্যক্রম অত্যন্ত ধীরগতিতে চলছে। যে কারণে আমরা বর্তমানে মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় আছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের আশ্বস্ত করেছিলেন সাত খুনের রায় যাতে দ্রুত কার্যকর হয়, তিনি সেদিকে লক্ষ রাখবেন। আমরা এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
অপরদিকে মঙ্গলবার (২৭ এপ্রিল) সাত খুনের নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে প্রয়াত নজরুলের সিদ্ধিরগঞ্জের নিজ বাসায় ও স্থানীয় মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সেলিনা ইসলাম বিউটি।
সাত খুনে নিহত মনিরুজ্জামান স্বপনের ছোট ভাই মিজানুর রহমান রিপন বলেন, মামলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি। আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি। তিনি যেন ব্যবস্থা নেন, দ্রুত মামলার রায় কার্যকর হোক, সে দাবি জানাচ্ছি।