কৌশল পাল্টে ইয়াবার পথেই আসছে ‘ভয়ঙ্কর আইস’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৪ এএম, ২৫ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৩৯ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ইয়াবার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি শক্তিশালী ও ব্যয়বহুল মাদক ‘আইস’। মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে কৌশলে বাংলাদেশে আসছে ভয়ঙ্কর এই মাদক। অধিক লাভের লোভে ইয়াবা কারবারিরা সচেষ্ট হয়েছে একে মাদকসেবীদের দুয়ারে পৌঁছে দিতে। আর নতুন নেশার ঘোরে ডুবতে সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা ঝুঁকছে এ মাদকের দিকে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, ৫০০ গ্রাম আইস থেকে প্রায় এক লাখ পিস ইয়াবা তৈরি করা সম্ভব। অল্প আইসেই অধিক পরিমাণ টাকার লেনদেন ও লাভ হয়। ফলে অনেক মাদকাসেবীও আইস কারবারে জড়িয়ে পড়ছে।
রাজধানীর গুলশান, ভাটারা, কুড়িল, রমনা এলাকা হতে কোটি টাকার অধিক মূল্যের ৫৬০ গ্রাম আইস ও ১২০০ পিস ইয়াবাসহ পাঁচ মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য দিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর।
আজ শুক্রবার দুপুরে তেজগাঁওয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো-উত্তরের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা বিভাগের প্রধান ও অতিরিক্ত পরিচালক ফজলুর রহমান বলেন, ‘গত ২১ আগস্ট আমরা প্রায় আধা কেজি আইসসহ বনানী-উত্তরা কেন্দ্রিক দশ সদস্যের একটি নেটওয়ার্ককে শনাক্ত করে গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন গোয়েন্দা কৌশল ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুলশান, ভাটারা, কুড়িল, রমনা এলাকায় আইসের আরো একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ককে আমরা শনাক্ত করতে সক্ষম হই।’
এরই ধারাবাহিকতায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো কার্যালয়ের (উত্তর) উপ-পরিচালক মো. রাশেদুজ্জামানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ও সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে গুলশান, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি সার্কেলের সমন্বয়ে তিনটি টিম গঠন করা হয়। এরপর গত ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করে রমনা এলাকা হতে জাকারিয়া আহমেদ অমনকে (৩২) পাঁচ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ আইসসহ গ্রেফতার করা হয়।
জাকারিয়ার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গুলশান থানাধীন বারিধারা দূতাবাস এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে তারেক আহম্মেদকে (৫৫) পাঁচ গ্রাম আইস ও ১০০ পিস ইয়াবা এবং একটি প্রাইভেটকারসহ গ্রেফতার করা হয়।
জাকারিয়া ও তারেকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সাদ্দাম হোসেনকে (৩১) ৯০ গ্রাম আইস ও ৪০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়।
পরবর্তীতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে শহীদুল ইসলাম খানকে (৪৮) একই এলাকা হতে দুই শ গ্রাম আইস ও ৫০০ পিস ইয়াবা এবং একটি প্রাইভেটকারসহ গ্রেফতার করা হয়। ভাটারার জোয়ারসাহারা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মো. জসিম উদ্দিনকে (৫০) ২৬০ গ্রাম আইস ও ২০০ পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়।
আসামিদের কাছ থেকে মোট ৫৬০ গ্রাম আইস ও ১২০০ পিস ইয়াবা এবং দুটি প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়, যার আনুমানিক মূল্য কোটি টাকার বেশি। তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ (সংশোধিত ২০২০) অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট থানায় নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ফজলুর রহমান বলেন, গ্রেফতারদের জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি, প্রত্যেকের একে অপরের সাথে কোনো না কোনোভাবে মাদক সংশ্লিষ্ট যোগাযোগ রয়েছে।
আইস কীভাবে বাংলাদেশে আসছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইয়াবার মতোই সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে মিয়ানমার থেকে আসছে আইস। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে আসে, বাংলাদেশি কারবারিদের মাধ্যমে হাত বদলে আসছে।
ইয়াবা থেকে আইসে ঝুঁকছে মাদক ব্যবসায়ীরা :
ফজলুর রহমান বলেন, ‘আইসকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীরা। তারা কৌশল বদলে ফেলছে। গভীর সমুদ্রেও আইসের চালান হাত বদলে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, র্যাব, পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও চেষ্টা করছে। আমরা নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করেছি।’
ইয়াবার পথেই মিয়ানমার থেকে আসছে আইস। মাঠ পর্যায়ে অভিযানের চেয়ে মূল রুটে বা সীমান্তে ইয়াবা বা আইসের চোরাচালান বন্ধে অধিদফতরের ভূমিকা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় রুটেই কাজ করি। যেমন গত জানুয়ারি মাসে আমরা এয়ারপোর্টে ১২ কেজি অ্যামফিটামিন জব্দ করেছি। কক্সবাজারে বেশ কয়েকজনকে আইসসহ আটক করা হয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকার মাদক ব্যবসায়ীরা এত বেশি দুর্ধর্ষ ও চৌকস যে, তাদের কাছ থেকে সত্য কথা বের করা কঠিন। তারা গডফাদারদের নাম বলতে চায় না। সীমান্তে বিজিবিও সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। সীমান্তে বিজিবির সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।’
কী পরিমাণ আইস ছড়িয়ে পড়ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আইস ভয়ঙ্কর মাদক। যদিও এটি এখনো সে রকম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েনি। সবার ক্রয়ক্ষমতাও নেই। আইস গ্রামপ্রতি বিক্রি হয় ৯ থেকে ১২ হাজার টাকায়। যে কারণে উচ্চবিত্ত বা সচ্ছল পরিবারের সন্তানরা ছাড়া এটি ক্রয় বা সেবন করতে পারছে না।
যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, গ্রেফতারদের মধ্যে জাকারিয়া আহমেদের বাবা আব্দুল লতিফ আহমেদ প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। জাকারিয়া বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশুনা করেছেন। তার বোনও বিদেশে থাকেন।
তারেক আহমেদ ইংল্যান্ডে বিবিএ করেছেন। তার প্রয়াত বাবা ব্যবসা করতেন। তাদের বড় আবাসিক ভবন রয়েছে। বাড়িভাড়া দেন। সাদ্দাম হোসেন নিজেও বাবার মতো সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী। শহিদুল ইসলাম খানের নিজের গাড়ি রয়েছে। সাধারণত যারা বিদেশ থেকে আসেন তাদের গাড়ির সার্ভিস দেন। বাবাও মাদারীপুরের বড় ব্যবসায়ী। জসিম উদ্দিনের নিজের বড় দুটি ছয়তলা বাড়ি রয়েছে। রয়েছে রেস্টুরেন্ট ব্যবসাও। এর পাশাপাশি তিনি আইস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
যেভাবে আইসে জড়িয়েছেন তারা :
জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে ফজলুর রহমান বলেন, ‘প্রত্যেকেই সচ্ছল পরিবারের সন্তান। প্রাথমিকভাবে আমরা জেনেছি বন্ধু-বান্ধবদের মাধ্যমে তারা আইসে জড়িয়েছে।’
শহিদুল ইসলাম বলেন, হোটেল ব্যবসায় জড়িত একজনের সাথে পরিচয় সূত্রে আইস ব্যবসার অফার পায়। মোটা অঙ্কের টাকা লাভবানের প্রলোভনে প্রথমে ইয়াবা সেবন, পরে আইস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
জসিম উদ্দিন জানান, হোটেলে পরিচয় সূত্রে একজনের মাধ্যমে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখান। একটি আইসের চালান গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারলে গাড়ির মালিক হয়ে যাবেন। শুধুমাত্র টাকার প্রলোভনে পড়ে জড়িয়েছে সবাই।
আইসসেবীরা হিংস্র মানসিকতার হয় :
ক্রিস্টাল মেথ বা আইস একটি ভয়ঙ্কর মাদক, যা ইয়াবার থেকে বহুগুণ শক্তিশালী। এটি মানব মস্তিষ্কের নিউরনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এটি একটি ‘ক’ শ্রেণির মাদকদ্রব্য। আইস উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও মাত্রাতিরিক্ত নেশা সৃষ্টিকারী মাদক। এটা সেবনের ফলে মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়। হিংস্র মানসিকতা তৈরি হয়। কেউ আত্মহত্যা করতে, কেউ অন্যকে হত্যা করতে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। কিডনি ড্যামেজ হতে পারে। দৃষ্টিশক্তি কমে যায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। মাত্র ৫০০ গ্রাম আইস থেকে প্রায় এক লাখ পিস ইয়াবা তৈরি করা সম্ভব। ইয়াবার চেয়ে আইস ১৮ থেকে ২০ গুণ বেশি শক্তিশালী।
জনবল-প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বেড়েছে অধিদফতরের :
কয়েক বছরে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরে নতুন কিছু জনবল নিয়োগ হয়েছে, নতুন যন্ত্রপাতিও এসেছে। অধিদফতরের অভিযানের সংখ্যা বেড়েছে, সক্ষমতা বেড়েছে। মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে কৌশল বদলে ফেলেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। ইতিমধ্যে মাদক ব্যবসায়ীদের নতুন একটি তালিকা তৈরি করেছে। তাদের গ্রেফতারে অধিদফতরের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা ও সোর্স কাজ করছে।