বাংলাদেশ ভারত সাম্প্রতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ০৩:১৪ পিএম, ১৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪ | আপডেট: ১২:১১ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বাংলাদেশ ভারত সাম্প্রতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি আমাদের মনে যথেষ্ট দুর্ভাবনা সৃষ্টি করছে বললে মোটেও অত্যুক্তি হবেনা। তবে যে কোন দুটো রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের উত্থান-পতনের বিষয়টি মোটেও অস্বাভাবিক নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় যে, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বিরাজমান থাকার ধারাটি ইতিহাসের প্রবাহে বরং বেশীই দেখা গিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নিরাবেগ পরিবেশ-প্রতিবেশে জাতীয় স্বার্থই মুখ্য। ভাবাবেগ নির্ভর ইউটোপিয়ান পরিস্থিতি কখনই টেকসই হয়না।
আন্ত-রাষ্ট্রিক সম্পর্কের আবহ বহুমাত্রিক এবং তা বিভিন্ন উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করলেও সনাতন নিরাপত্তা (Traditional Security) আর রাজনৈতিক-অর্থনীতি মূলত এ ধরণের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান প্রভাব বিস্তারকারী। তবে রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কে মতাদর্শিক, ধর্মীয় এমনকি সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো কম-বেশী ভূমিকা রাখতে পারে। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিবেচনা করার ক্ষেত্রেও উল্লিখিত উপাদানগুলোকে আমলে নিতে হবে।
ভারতের রাষ্ট্রনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে তাদের কীর্তিমান তত্ত্ববিদ চাণক্যের গভীর প্রভাব লক্ষণীয়। আবার সাম্প্রতিক বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশিভাগ প্রধান ও প্রাসঙ্গিক রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক সম্পর্কের উপর অত্যন্ত গভীর প্রভাব রাখছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের বিভিন্ন বিষয়। বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক সম্পর্ক ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তাই এসব নির্ধারক উপাদানকে কষ্টিপাথর হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির দর্শন ও দিকনির্দেশনার সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ব্যক্তিত্ব চাণক্যের নামেই ভারতীয় এ সম্পর্কিত দপ্তরটির নামকরণ করা হয়েছে চাণক্য-পুরি। সে কারণে প্রথমত চাণক্যবাদের দর্পণেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়গুলো দেখা যেতে পারে। কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা ও প্রভাব বিস্তারে চাণক্যের কত গুলো সমন্বিত ও ধারাবাহিক নীতি ছিলো সেগুলো হচ্ছে সম, দাম, দণ্ড ও ভেদ নীতি। এগুলো চাণক্যের চতুর্পন্থা (Fourfold Policy) হিসেবেও পরিচিত।
চাণক্যের সম, দাম, দণ্ড ও ভেদ নীতিগুলো সম্পর্কে খুব ছোট করে বললে বলা যায় যে, ‘সম নীতি’ হচ্ছে সমঝোতা বা আলোচনার ছলে প্রভাব বিস্তার করা; ‘দাম নীতি’ হচ্ছে অর্থ বা উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে প্রলুব্ধকরণ; ‘দণ্ড নীতি’ হচ্ছে দণ্ড, শাস্তি বা সমস্যা সৃষ্টির মাধ্যমে কোন দেশকে কোন কাজ করতে বাধ্য করা এবং ‘ভেদ নীতি’ হচ্ছে প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রের বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর মধ্যে বিভেদ-অনৈক্য সৃষ্টি করে তার ক্ষমতা হ্রাস বা বিপদগ্রস্ত করে ঐ প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে নতি স্বীকারে বাধ্য করা।
ভারতের প্রতি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির অনুসারী সরকারগুলোর সাথে ভারত সমঝোতা বা ছদ্ম-সমঝোতার মাধ্যমে তার আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠা করে এসেছে। এক্ষেত্রে চাণক্যের প্রাসঙ্গিক একটি শ্লোক উল্লেখ করা যেতে পারে; সেটি হচ্ছে “বলবান হীনেন বিগৃহ্নীয়াত” অর্থাৎ শক্তিশালী রাজ্যের উচিৎ দুর্বল রাজ্যের সাথে যুদ্ধ করা। এ নীতির অনুসারী ভারত তার প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রগুলোর উপর কিভাবে দমনমূলক আধিপত্যবাদ চাপিয়ে দিচ্ছে তা নিশ্চয়ই আমাদের অজানা নেই। একই ধরণের ক্ষেত্রে দাম নীতি ব্যবহার করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অর্থ উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করাকেও ভারত একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে প্রয়োগ করে এসেছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের বৈদেশিক সম্পর্ক চর্চায় এ বৈশিষ্ট্য আমরা গত ২০০৭ থেকে ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবের আগে পর্যন্ত দেখে এসেছি। কিন্তু যেসব দেশের সরকারগুলো ভারতের আধিপত্যমূলক প্রভাবকে মেনে না নিয়ে বরং বিশ্বের আদর্শ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারা অনুযায়ী সমমর্যাদার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক বজায় রাখার নীতিতে বিশ্বাসী সেসব রাষ্ট্রের সাথে ভারত প্রয়োগ করে দণ্ড ও ভেদ নীতি। সে ক্ষেত্রে দণ্ড হিসেবে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি, শুল্ক বৃদ্ধি, অপপ্রচার, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা এমন কি ছোটখাটো ও স্বল্প সময়ের সামরিক হস্তক্ষেপও করা হয়েছে। ভেদ নীতি দ্বারা ভারত তার লক্ষ্যবস্তু রাষ্ট্রটির বিভিন্ন গোষ্ঠী, দল বা পক্ষগুলোর মধ্যে বিভেদ বা অনৈক্যের সৃষ্টি করে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে চাপ তৈরি করে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাপক চাপ তৈরি করে বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ভারত তার অনৈতিক দাবি মানতে বাধ্য করে থাকে। জুলাই বিল্পবের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সমমর্যাদার ভিত্তিতে ও নিজ স্বার্থ নিশ্চিত করে বৈদেশিক সম্পর্ক বজার রাখা। এক্ষেত্রে কোন রাষ্ট্রের অবৈধ, ক্ষতিকর স্বার্থান্বেষী ও আধিপত্যমূলক দাবিগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে আধিপত্যবাদি ভারত এমন ক্ষেত্রে তার দণ্ড নীতি ও ভেদ নীতির বিভিন্ন প্রয়োগ করছে। যা আমরা প্রতিনিয়তই উপলব্ধি করছি।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পারস্পরিক সমস্যা ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের বিষয়টি বহুল ব্যবহৃত একটি পন্থা। ভারত এ পন্থায় অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও সফল হিসেবে ইতোমধ্যেই নিজেকে প্রমাণ করেছে। যদিও ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধে ভারতের মনস্তাত্ত্বিক কৌশলে হিতে বিপরীত হয়। ভারতের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ কৌশলের ক্ষেত্রেও চাণক্যের গভীর প্রভাব রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ৩০০ অব্দে আলেকজান্ডার কর্তৃক ভারত আক্রমণের সময়ও গ্রীক সৈন্যদের কাছে ভারতের শক্তি অনেক বাড়িয়ে দেখানো, অতিপ্রাকৃত প্রতিকূলতা, দৈব আক্রোশ, দুর্ভাগ্য, অশুভ শক্তির উৎপাত, অনিশ্চয়তা, উৎকণ্ঠা ইত্যাদির ভীতি সৃষ্টি, এমন কি প্রতিশোধ-পরায়ণ ভুতের ভয় দেখিয়ে গ্রীক সৈন্যদের মানসিক শক্তি ও মনোবল অত্যন্ত দুর্বল করে দেয়া হয়। যার ফলে গ্রীকরা সমস্ত ভারত জয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বলা-বাহুল্য যে, এ কৌশলের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন চাণক্য। এ ছাড়াও চাণক্যের আরও অনেক কার্যকরী মনস্তাত্ত্বিক পন্থা ছিলো; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – গুজব ছড়ানো, গুপ্তচরবৃত্তি, ছলনা, অনিশ্চয়তা সৃষ্টি, প্রতিপক্ষের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা তৈরি, কূটনৈতিক বিচ্ছিন্নতা তৈরি, প্রতিপক্ষের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি, নিজ শক্তি বহুগুণ বাড়িয়ে দেখানো ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমরা যদি একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো যে, ভারতীয় বিভিন্ন ধরণের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ গোষ্ঠী এবং ভারতীয় আর একই সাথে বিভিন্ন দেশে তাদের তাবেদার মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়াগুলো মিলে বাংলাদেশ বিরোধী উদ্দেশ্যমূলক যেসব কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে – মিথ্যা বানোয়াট তথ্য প্রচার, গুজব ছড়ানো, অযথা উদ্বেগ তৈরি, বাংলাদেশের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ও স্বদেশভক্ত শক্তিগুলোর নেতৃত্বের উপর অনাস্থা তৈরি, এদেশের জনগণের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দ্রব্য প্রাপ্তিতে বাধা দেয়া, ছোট-বড় বিভিন্ন হস্তক্ষেপসহ এমন কি সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি ইত্যাদি। ফলে সহজভাবেই আমরা বুঝতে পারি যে, ভারতের নেয়া সাম্প্রতিক এসব কৌশল আসলে চাণক্যবাদেরই প্রয়োগ; যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের উপর প্রচণ্ড মনস্তাত্ত্বিক চাপ প্রয়োগ করে বিগত সময়ে অন্যায়ভাবে পেয়ে আসা সুযোগ ও প্রতিষ্ঠিত আধিপত্যবাদ বজায় রাখা এবং আরও কোন বখরা আদায় করা যায় কিনা তার চেষ্টা করা।
প্রসঙ্গত খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় উল্লেখ করতেই হবে যা হচ্ছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের প্রেক্ষাপট। স্নায়ু-যুদ্ধোত্তর কালের নতুন বাস্তবতা হচ্ছে পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ও তার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের উৎকণ্ঠা; আর এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব শক্তি হবার ‘মেইড ইন ইন্ডিয়া’ স্বপ্নে বিভোর ভারতের তোরজোড়। এসবের ফলে সাম্প্রতিক বিশ্ব পেয়েছে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশলের মতো এক জটিল বাস্তবতা। এমন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কোয়াড অংশীদার ভারত হয়তো আঞ্চলিক ক্ষেত্রে কম-বেশী কর্তৃত্ব অর্জন করেছে; তবে তার স্থায়িত্ব ও গভীরতা বেশ কিছু নিয়ামকের সাথে জড়িত। যেমন ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক এবং চীন-রাশিয়া সম্পর্কের ভরকেন্দ্রের স্থানান্তর; যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ভারতের সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে। আবার যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বোঝাপড়া অথবা ঐসব পারস্পরিক সম্পর্কে যেকোনো পরিবর্তন এমনকি নতুনত্ব ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নিবিড়তা বা দূরত্বকে স্পষ্ট করবে। এছাড়াও আবেগ বর্জিত জাতীয়-স্বার্থ নির্ভর পশ্চিমা বিশ্ব চতুর্দিকের সমস্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে বৈরী করে তোলা ভারতকে একতরফা প্রাধান্য দিয়ে ভারতের ঐ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে কতটুকু দূরত্ব তৈরি করবে সেটিও ভাববার বিষয়। এসব জটিল প্রেক্ষাপটে ভারতের শক্তি অর্জন আর আধিপত্য বিস্তারের সম্পর্ক সমানুপাতিক হলেও বাংলাদেশসহ ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে আদর্শ অবস্থা নিশ্চিৎ করার যে সম্পর্ক সেটি আপাততঃ ব্যস্তানুপাতিক।
নিজ রাষ্ট্রকে নিরাপদ করতে হলে আসলে নিজেরা একতাবদ্ধ হয়ে জাতীর সার্বিক উন্নতি নিশ্চিত করে দৃঢ় শক্তি অর্জনের মাধ্যমেই তা করতে হবে; অন্যের উপর নির্ভরশীলতা এক্ষেত্রে নির্বুদ্ধিতা। একতাবদ্ধ দৃঢ় একক প্রচেষ্টা কত শক্তিশালী হতে পারে তাতো অমিত প্রেরণাদায়ক জুলাই-২০২৪ বিপ্লবেই আমরা দেখতে পেয়েছি। পরিশেষে বাংলাদেশের করণীয় একটি বিষয়ে গুরু চাণক্যের একটি শ্লোক বেশ খানিকটা পথ দেখাতে পারে, সেটি হচ্ছে “সকৃত দুষ্টঞ্চ মিত্রং যঃ পুনঃ সন্ধাতুমিচ্ছতি। স মৃত্যুমুপগৃহ্নাতি গর্ভমশ্বতরী যথা।“-এর সহজ অর্থ হচ্ছে বিশ্বাস ভঙ্গের পরও দুষ্টু বন্ধুর সাথে যে আবার সদ্ভাব স্থাপন করে সে আসলে নিজের মৃত্যু ডেকে আনে।
লেখক: আহসান সাদ, গবেষক।