সারাদেশে আবরার ফাহাদের শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন করলো ছাত্রদল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৩২ পিএম, ৭ অক্টোবর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৯:০৯ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ।
আজ সোমবার (৭ অক্টোবর) ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবরার ফাহাদের ৫ম শাহাদাৎ বার্ষিকী পালন করেছে ইউনিট ছাত্রদল।
এসময় তারা কালো পোশাক পড়ে ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় মৌনমিছিল, সভা-সেমিনারে অংশ নেয়।
ঢাকা কলেজ : ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের মৌন মিছিলটি ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে সাইন্সল্যাব মোড় প্রদক্ষিন করে আসে।
পরবর্তীতে শহীদ মিনারের সামনে সভা করে তারা।
এসময় বক্তব্য দেন কলেজ ছাত্রদলের সভাপতি মাসুদ, সেক্রেটারি জুলহাস, সি. সহ-সভাপতি রাসেলসহ অনেকে।
বক্তৃতায় তারা সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের অঙ্গীকার করেন। ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে নিষিদ্ধের দাবিও জানান তারা।
জবি : এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল পালন করেছে আবরার ফাহাদের ৫ম শাহাদৎ বার্ষিকী। এ উপলক্ষে মৌন মিছিল ও স্মরণসভার আয়োজন করে তারা।
এসময় শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী ও দেশদ্রোহী আক্ষা দিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি বন্ধের দাবি জানায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠালতলা থেকে শান্ত চত্ত্বর পর্যন্ত মিছিল শেষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের ব্যানারে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি আসলাম, সি. সহ-সভাপতি মিঠু, সাধারণ সম্পাদক সুজন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হিমেলসহ অনেকেই আবরার ফাহাদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বক্তব্য দেন।
তারা বলেন, ছাত্রলীগের নির্যাতনের শিকারে পরিনত হয়েছে ভিন্ন মহবালম্বী ও বাক-স্বাধীনতাকামী শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এই হক আদায়ের জন্য হলেও ছাত্রলীগের বিচার করতে হবে।
তারা আরো বলেন, অমানবিক নির্যাতনে আবরার ফাহাদের মৃত্যু হয়েছে। এই খুনীদের বিচার করতে হবে। তাদেরকে ছাত্রসমাজ বয়কট করেছে।
ফেনী : ফেনীতে আবরার ফাহাদের পঞ্চম শাহাদাৎ বার্ষিকী উপলক্ষ্যে, নিরাপদ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাসের দাবিতে ফেনী সরকারি কলেজ ছাত্রদলের উদ্যোগে মৌন মিছিল ও স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কলেজ ছাত্রদলের আহ্বায়ক আবদুল হালিম মানিকের নেতৃত্বে শুরু হওয়া মৌন মিছিলটি কলেজ ক্যাম্পাসের বকুল তলা থেকে শহরের ট্রাংক রোডস্থ দোয়েল চত্বর হয়ে পুনরায় কলেজের প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে স্মরণসভায় মিলিত হয়।
খুলনা : সরকারি ব্রজলাল কলেজ, খুলনা ক্যাম্পাসে ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে বর্বর সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনে নিহত বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী শহীদ আবরার ফাহাদ স্মরণে মৌন মিছিল ও স্মরণ সভা করে সরকারি ব্রজলাল কলেজ ছাত্রদল। মিছিলটি কলেজের দ্বিতীয় গেট থেকে শুরু হয়ে শহীদ মিনারে এসে শেষ হয় এবং আমতলায় স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
স্মরণ সভায় কলেজ ছাত্রদলের আহবায়ক ইয়াছিন গাজী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের রায় দ্রুত কার্যকরের দাবী জানান।
এসময় উপস্থিত ছিলেন দৌলতপুর থানা ছাত্রদলের আহবায়ক আলামিন লিটন, কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ফরহাদ হোসেনক প্রমুখ।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিকাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড কেন্দ্র করে পাঁচ বছর আগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবাদ বিক্ষোভে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। এটি তখন শিরোনাম হয়েছিল বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।
এর জের ধরেই তীব্র আন্দোলনের মুখে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
এবার আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী যে আন্দোলন গড়ে ওঠেছিল সেখানেও আন্দোলনকারীদের মিছিল, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার ও শ্লোগানে আবরার ফাহাদের নাম উঠে এসেছে বার বার।
আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের সময় যে কয়েকটি ঘটনায় দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছিল, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডকে তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন অনেকে।
একইসাথে আবরার হয়ে ওঠেন ‘ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী’ আন্দোলনের একটি প্রতীকে।
ওই হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তীব্র বিক্ষোভের জেরে অভিযুক্ত ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আটক করে মামলা দেয়া হয়েছিল।
পরে ওই হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড আর পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দিয়েছিল ঢাকার একটি আদালত। তবে রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল আবেদনের এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
সোমবার অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান বলেছেন, আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার আপিল দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া হবে।
সবশেষ চলতি বছর ৩ সেপ্টেম্বর আবরার ফাহাদের পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
হত্যাকাণ্ডটি যেভাবে হয়েছিল : ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর নির্মম নির্যাতনে নিহত হন আবরার ফাহাদ।
সেদিনই কুষ্টিয়ার বাড়ি থেকে বুয়েটে এসে শেরে বাংলা হলে নিজের ১০১১ কক্ষে এসেছিলেন আবরার।
ফেসবুকে ভারতবিরোধী একটি পোস্টের জের ধরে রাত ৮টার দিকে তাকে ডেকে নিয়ে যায় বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। পরে রাত ৩টার দিকে জানা যায় যে আবরারকে হত্যা করে একতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝামাঝি ফেলে রাখা হয়েছে।
পরে জানা যায় আবরারকে দুই দফায় দু’টি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয় এবং পরে বুয়েট মেডিক্যালের ডাক্তার এসে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
এর মধ্যে খবর পেয়ে রাত ২টার দিকে টহল পুলিশের একটি দল হল গেইটে গেলে তাদের হলে ঢুকতে দেয়া হয়নি।
পরে ৪টার দিকে পুলিশ আবার হলে যায়। এরপর ডাক্তার মৃত ঘোষণার পর তারা লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয় যে আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
পরে ঘটনাটির তদন্ত শেষে তখনকার কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সে সময় সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন যে আবরার ফাহাদকে শিবির হিসেবে সন্দেহ করার বিষয়টি হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল। কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়।
“অভিযুক্তদের সমীহ করে সালাম না দেয়ার বিষয়টিও আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পেছনে অন্যতম কারণ। তারা র্যাগিং এর নামে আতঙ্ক তৈরি করেছে। হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তরা আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে অন্যদের মাঝেও আতঙ্ক তৈরি করতে চেয়েছিল, যাতে করে অন্য শিক্ষার্থীরাও তাদের সমীহ করে এবং সালাম দেয়। অভিযুক্তরা বুয়েটে ‘ভয়ের রাজত্ব’ কায়েম করার ধারাবাহিকতায় আবরার ফাহাদের ওপর হামলা করে,” বলেছিলেন মনিরুল ইসলাম।
পরে মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছিল যে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের সাথে ১১ জন সরাসরি সম্পৃক্ত এবং বাকিরা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আটজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মামলার এজাহারে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ প্রথমে ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তবে তদন্তের পরে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ জনে।
অন্যদিকে ছাত্রলীগের তখনকার সভাপতি আল নাহিয়ান জয় তখন বলেছিলেন, ‘অনেক সময় অতিউৎসাহী কিছু নেতা-কর্মী ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য এ ধরনের কার্যক্রমে লিপ্ত হন। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এ ধরনের কার্যক্রম কোনোভাবে সমর্থন করা হবে না।’
ভারতীয় আগ্রাসন প্রসঙ্গ : হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে ৫ অক্টোবর ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন আবরার ফাহাদ, যার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক।
তিনি লিখেছিলেন- ১. ৪৭ এ দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর ছিল না। তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারতের কাছে অনুরোধ করল। কিন্তু দাদারা নিজেদের রাস্তা নিজেদের মাপার পরামর্শ দিছিলো। বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ ইন্ডিয়াকে সে মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য হাত পাততে হচ্ছে।
২. কাবেরি নদীর পানি ছাড়াছাড়ি নিয়ে কানাড়ি আর তামিলদের কামড়াকামড়ি কয়েকবছর আগে শিরোনাম হয়েছিল। যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চাই না সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়া দিনে দেড় লাখ কিউবিক মিটার পানি দিব।
৩. কয়েকবছর আগে নিজেদের সম্পদ রক্ষার দোহাই দিয়ে উত্তরভারত কয়লা-পাথর রফতানি বন্ধ করেছে অথচ আমরা তাদের গ্যাস দিব। যেখানে গ্যাসের অভাবে নিজেদের কারখানা বন্ধ করা লাগে সেখানে নিজের সম্পদ দিয়ে বন্ধুর বাতি জ্বালাব’।
তার হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটের শিক্ষার্থীদের অনেকেই দাবি করেন যে মূলত এই পোস্টের কারণেই আবরার ফাহাদকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে।
পরে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনও ‘ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতাকারী’ হিসেবে আবরার ফাহাদকে উল্লেখ করেন।
বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আবরার হত্যাকাণ্ড : আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার খবর জাতীয় সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও উঠে আসে। কয়েকটি গণমাধ্যমে ঘটনার পর যে তুমুল ছাত্রবিক্ষোভ হচ্ছিলো তার খবরও নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে।
বিবিসি এ বিষয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ করেছিল। বিবিসি নিউজে ২০১৯ সালের ৯ অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছিল যে চার ঘণ্টা ধরে পিটিয়ে হত্যা করা হয় আবরার ফাহাদকে।
তখন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছিলো ‘ভারতের সাথে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের পানি চুক্তির সমালোচনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়’।
ওই রিপোর্টে ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবির বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ পায়।
আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনার প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের খবর প্রকাশ করেছিল গালফ নিউজ। আর গার্ডিয়ানে আবরারের বাবার বক্তব্য ও ঘটনার প্রতিবাদে বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হয়।
ওয়াশিংটন পোস্ট ও নিউইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাগুলোতেও আবরার হত্যা ও এর পরের ছাত্র বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
কয়েকটি সংবাদমাধ্যমে ঘটনার পর এই হত্যার সাথে জড়িতদের বিচার করা হবে বলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী যে আশ্বাস দিয়েছিলেন সেই খবরও প্রকাশ করা হয়।
দিনকাল/এসএস