১২ বছরেও শেষ হয়নি প্রকল্প, ঈদযাত্রা হবে ভোগান্তির
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৫ এএম, ১৯ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৩৬ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
চার বছরের প্রকল্প শেষ হয়নি ১২ বছরেও। দফায় দফায় বেড়েছে সময়। খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ। তবু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার আশঙ্কা করছেন র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের পরিচালক। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত সড়কের কাজ শেষ করতে আরও কত সময় লাগবে তাও নিশ্চিত করতে পারছেন না তিনি। এ অবস্থায় বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত যানজট লেগেছে থাকছে। এর মধ্যে টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কের যানজট অসহনীয়। কোথাও একমুখী যানবাহন চলাচল করছে, কোথাও সড়ক বন্ধ করে রাস্তার কাজ চলছে। হাজার হাজার পরিবহনের চাপে সড়কের বিভিন্ন স্থানে যানজট এখন নিত্যসঙ্গী। ঈদের সময় এই যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করে ঘরমুখী মানুষকে চরম ভোগান্তিতে ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়ক। আব্দুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক। সড়কের এই অংশগুলো অতিক্রম করতে সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ যানজট না থাকলে এক ঘণ্টায় বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর যাওয়া যেতো।
যাত্রী, গাড়িচালক ও স্থানীয়রা বলছেন, এখন ঢাকা থেকে গাজীপুর বাসে যেতে সময় লাগে প্রায় ছয় ঘণ্টা। এর মধ্যে টঙ্গী সেতুতে পৌঁছাতেই দুই ঘণ্টা লেগে যায়। বাকি সময় টঙ্গী সেতু থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে লাগে। সড়কের এমন বেহাল দশা আরও কোথাও নেই। বিআরটি’র প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় গত ১০ বছর ধরে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ চরম ভোগান্তি নিয়ে এই পথে যাতায়াত করছেন। ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবে ঘরমুখী মানুষের দুর্ভোগ কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনার (এসটিপি) আওতায় ঢাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সহজ যোগাযোগের জন্য ২০০৫ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। প্রকল্পের অধীনে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার সড়কে বাসের আলাদা লেন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। যার নাম দেয়া হয়েছে বিআরটি। প্রকল্পটি ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর একনেকে অনুমোদন পায়। দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করে বিআরটিতে বাস নামানোর কথা ছিল। পরে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর করা হয় এবং ব্যয় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ ১৪ টাকা। দুই দফায় প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বাড়িয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নতুন করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারবেন। তবে কিছু সমস্যা এখনও রয়েছে। সমস্যাগুলো থাকলে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা অনিশ্চিত।
বিআরটি সূত্রে জানা গেছে, সময় ও ব্যয় বাড়ানোর মূল কারণ সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া। সময় ও নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়ায় ৭২৩ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। সেই সঙ্গে পরামর্শকদের বাড়তি সময়ের বেতন-ভাতাও যোগ হয়েছে। এর বাইরে কিছু কাজ যোগ করা এবং বাড়তি জমি অধিগ্রহণের কারণে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বেড়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, টঙ্গীর স্টেশন রোড থেকে মিলগেট পার হয়ে চেরাগআলী মার্কেটের আগ পর্যন্ত রাস্তায় নির্মাণ করা হচ্ছে উড়াল সেতুর পিলার। উড়াল সেতু এবং নিচে কার্পেটিং এখনও অনেক জায়গায় শেষ হয়নি। ফলে সড়কের কোথাও তিন কোথাও দুই লেনে যানবাহন চলছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় কাটছে মানুষের। সড়কের কিছু স্থানে উড়াল সেতুর সø্যাব বসানো, কোথাও সড়ক মেরামত আবার কোথাও চলছে খুঁটি স্থাপনের কাজ। এরই মধ্যে প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কমছে না যানজট। টঙ্গীর মিলগেট এলাকার পরিবহনের পার্টস বিক্রেতা আব্দুল কাইউম বলেন, গত ১০ বছর ধরে ধুলাবালু, যানজট আর নানা দুর্ভোগের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে আমাদের। এই কর্মযজ্ঞ কেন শেষ হয় না বুঝি না। গাজীপুরের অ্যাম্বুলেন্সচালক মিলন শেখ বলেন, আব্দুল্লাহপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়ক আসতে তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগছে। ধীরগতিতে চলছে প্রকল্পের কাজ। একেকদিন একেক লেন বন্ধ করে দেয়া হয়। এই অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। দেখারও কেউ নেই। গাজীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি সুলতান আহমদ সরকার বলেন, হাজার হাজার যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক, লরি প্রতিদিন সড়কটি দিয়ে চলাচল করে। লম্বা ছুটি থাকায় এবার ঈদে সাধারণ মানুষ ঘরমুখী হবে। গণপরিবহনের চাপ বাড়বে। কিন্তু এখনও বিআরটির প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। শেষ হবে হবে বলে ১০ বছর কেটে গেলো। কবে শেষ হবে কে জানে। এভাবে চললে ঈদযাত্রা ভোগান্তির হবে। বিআরটির সেতু অংশের প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম বলেন, সার্বিকভাবে প্রকল্পের ৭৩ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সেতু অংশের কাজ ৬৫ ভাগ শেষ হয়েছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে। প্রতিবন্ধকতা না থাকলে নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, কিছু সমস্যা নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের দুই পাশ দখল করে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ময়লার ভাগাড় তৈরি করেছে। টঙ্গী আহসানউল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতুর ওপর বিদ্যুৎ বিভাগের ক্যাবল টানানো রয়েছে। ক্যাবল সরানোর জন্য প্রচুর অর্থ খরচ হবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
মহিরুল ইসলাম বলেন, মহাসড়কের টঙ্গীর মিলগেটসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় কাভার্ডভ্যান দাঁড় করে রাখা হয়েছে। অল্প সময়ের জন্য বলা হলেও একটার পর একটা কাভার্ডভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এখন সেখানে স্ট্যান্ড হয়ে গেছে। অথচ জায়গা হলো মহাসড়কের। অনেক জায়গায় ব্যক্তি মালিকানাধীন দোকানপাট নির্মাণ হয়েছে। এগুলো সরানোর কাজতো সড়ক বিভাগ করবে না। যারা করবেন তাদের বারবার বলা হচ্ছে। কিন্তু সরাচ্ছি, সরানো হবে বলে সময়ক্ষেপণ করছে তারা। এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করার সময় হঠাৎ করে পুলিশ বলছে, এখন কাজ বন্ধ রাখতে হবে। ভিআইপি আসবেন, রাতে কাজ করতে হবে। ঠিকাদারকে তো সময় দিতে হবে। এসব কারণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধকতার জন্য বহুবার আমাদের চিঠি দিয়েছে। আমাদের জায়গায় নির্মাণ করা স্থাপনাগুলো সরিয়ে নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছি। তবু সরানো হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘হাউজ বিল্ডিংয়ের কাছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সড়কের জায়গায় ময়লার ভাগাড় তৈরি করে রেখেছে। এ পর্যন্ত ১৪ বার চিঠি দিয়ে সিটি করপোরেশনকে জায়গাটি পরিষ্কার করে দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু কোনও সাড়া মিলছে না। এমন হলে কাজ শেষ হবে কীভাবে? এরকম হলে নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প শেষ হবে কিনা তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বর্জ্য ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ) এস এম শফিকুর রহমান বলেন, ১৪টি চিঠি আমি পাইনি। গত বছর থেকে তারা বিভিন্ন সময় এ বিষয়ে কথা বলেছেন। আমি দুটি চিঠি পেয়েছি। ভাগাড় ছাড়াও আর্থকোয়াকের একটি প্রকল্প সেখানে চালু রয়েছে। আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে ভাগাড়টি সরিয়ে ফেলবো আমরা। বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক এ এসএম ইলিয়াস শাহ বলেন, প্রকল্পের কাজের ৭৩ শতাংশ শেষ হয়েছে। এখন ঈদযাত্রাকে প্রাধান্য দিয়ে কাজের গতি বাড়ানো হয়েছে। ঈদের আগে সড়কের নিচের যে অংশে কার্পেটিং বাকি সেগুলো শেষ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আশা করি, ঈদযাত্রার আগেই সড়কটি পুরোপুরি চলাচলের উপযোগী করে তোলা হবে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এক জরিপে দেখা গেছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ৬০ হাজার যানবাহন চলাচল করে। বিআরটি কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, যেখানে আপাতত একাধিক লেনের আংশিক কাজ শেষ হয়েছে সেখানে রোড ডিভাইডার দিয়ে যেন সড়ক খুলে দেওয়া হয়। স্টপেজ এলাকাগুলোতে যাত্রী উঠানামা করার জন্য দুটি লেন ব্যবহার করা হবে। করোনার কারণে গত বছর যাত্রীর চাপ কিছুটা কম থাকলেও এবার বেশি থাকবে। আমরা বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছি। বিআরটি, জেলা প্রশাসন, গাজীপুর এবং ময়মনসিংহ শ্রমিক-পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ইনহাউজ এবং অন গ্রাউন্ডে একাধিক মিটিং করেছি। এ সংক্রান্ত আরও মিটিং হবে। আগামী ২৩ এপ্রিল থেকে বিআরটি কিছুদিনের জন্য কিছু এলাকার সড়ক খুলে দিলে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট খুব সহজ হবে। টঙ্গীর মিলগেটসহ কয়েকটি এলাকায় সড়কের পাশে কাভার্ডভ্যানের স্ট্যান্ড গড়ে উঠার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, স্থায়ী কোনও স্ট্যান্ড সড়কের পাশে নেই। লিরা পাইপ ইন্ডাস্ট্রিজসহ দু’একটি প্রতিষ্ঠান রাতে পণ্য লোড-আনলোড করে। সড়কের দুই পাশের ভেতরের অংশে শত শত শিল্প প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কম্পাউন্ডে পরিবহন রেখে লোড-আনলোড করে। বিআরটি সড়ক বন্ধ করে কাজ শুরুর সময় ট্রাফিক বিভাগকে জানালে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করলে যানজট কিছুটা কমবে। এবার ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘœ করতে শতাধিক ট্রাফিক পুলিশ সড়কে নিয়োজিত থাকবে। আমরা চেষ্টা করবো, ঈদযাত্রা যাতে নির্বিঘœ হয়, মানুষের দুর্ভোগ কম হয়।