নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যেবাহী বোস কেবিন ১০২ বছরে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৫৪ পিএম, ১১ মার্চ,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৫৮ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী বোস কেবিন ১০২ বছরে পা দিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) ১০১ বছর পূর্ণ হয়েছে বোস কেবিনের। প্রাচ্যের বিখ্যাত এ দোকানের ইতিহাস অনেক পুরনো।
প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জ, রাজধানীর পাশের জেলা শহর। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের এই নারায়ণগঞ্জ শহরের বন্দরে আসতো কত শত নেতাকর্মী। স্বদেশী আন্দোলনের নেতারা, স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতারা এই শহরে এলে চা খেতে আসতেন সনাতন পাল লেনে। রেল লাইনের পাশে ছোট্ট একটা ঘর। সেই ঘরে তিনটে টেবিল পাতা। প্রতিটিতে ছয়টি করে চেয়ার। আর এই চেয়ারে বসেই সবাই হাঁক ছাড়েন, ‘এক কাপ চা!’
নগরজীবনে অফিসের কাজের ফাঁকে সহকর্মীর সঙ্গে লাঞ্চ ব্রেকে যেমন গল্প জমে, তেমনি এই গল্পই আবার আড্ডা নামের শিল্পরূপ পায় কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিক, খেলোয়াড়, কলেজ-ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সান্নিধ্যে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেন আড্ডার ম্যারাথন চলে তখন। আর আড্ডা আরো জমে ওঠে যখন, তাতে যোগ হয় এক কাপ চা বা হালকা একটু নাশতা। আর আড্ডা জমানোর সেই কাজটিই দীর্ঘদিন ধরে করে আসছে নারায়ণগঞ্জের ‘বোস কেবিন’।
বোসের কেবিনের ভেতরে জায়গা খুব বেশি নেই। প্রথম কেবিনের পর আরেকটি কেবিন। প্রথম কেবিনে সবমিলিয়ে ২৪ জনের বসার স্থান। দ্বিতীয় কেবিনেও তাই। অনেকেই এসে দাঁড়িয়ে আছেন। সিট খালি হওয়ার অপেক্ষায়। তবে এখানে এমনি ক্রেতা কম আসেন। নিয়মিত আর একটি শ্রেণির নারায়ণগঞ্জবাসীই এই বোস কেবিনের ভোক্তা।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে আজ থেকে প্রায় ১০১ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় আজকের এই বিখ্যাত বোস কেবিন। এলাকার আড্ডাবাজেরা যে যেখানেই থাকুক, নির্দিষ্ট সময়ে তারা এসে একে একে জড়ো হয়ে মেতে উঠবে জস্পেশ আড্ডায়। শুধু কি এলাকার লোকজন, এই বোস কেবিনে চা খেতে আসেন নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন এলাকার মানুষও।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ এমনকি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বোস কেবিনের অবদান স্মরণীয় হয়ে আছে। নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো অনেক নেতা এই বোস কেবিনের চা পানে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছেন। এমনকি সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হকও এখানে এসেছিলেন বলে জানালেন বোস কেবিনের ম্যানেজার রতন বোস।
নারায়ণগঞ্জ জেলার ১ ও ২ নম্বর রেলগেটের মাঝামাঝি ফলপট্টির কাছাকাছি রেললাইনের পাশেই বোস কেবিনের অবস্থান। একটি টংঘরের মধ্য দিয়ে এই বোস কেবিনের যাত্রা শুরু ১৯২১ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নৃপেণ চন্দ্র বসু। তবে তিনি এলাকায় ভুলুবাবু নামেই অধিক পরিচিত। তার আদি নিবাস ছিল বিক্রমপুরের ষোলঘরে।
জীবিকার সন্ধানে ২০ বছর বয়সে ঢাকায় আসেন ভুলুবাবু। শুরুতে তেমন কোনো কাজ না পেয়ে একটি ছোট টংঘরে কড়া লিকারের চা, লাঠি বিস্কুট ও বাটার বিস্কুট নিয়ে বিক্রি করতে বসে যান তিনি। সে সময়ই সমাদৃত হয় তার কড়া লিকারের রং চা। তাই আস্তে আস্তে তখনই তাঁর দোকানটি জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। ধীরে ধীরে দোকানের কলেবর বাড়তে থাকে, নাম হয় ‘নিউ বোস কেবিন’।
শীতলক্ষ্যা পাড়ের হাটবাজারের কারণে এখানে জনমানুষের পদচারণা সে সময় থেকেই অত্যধিক। এছাড়া মাঝি-মাল্লা ও ব্যবসায়ীদের মুখে মুখে এই বোস কেবিনের জলখাবার আর চায়ের সুখ্যাতি ছড়াতে থাকে। তা অমলিন হয়ে রয়েছে আজ অবধি। তাই তো এখনো সারাদিনে প্রায় হাজার কাপ চা বানাতে হয় এই বোস কেবিনের প্রায় ৩০ বছরের চায়ের কারিগর মতি বোসকে। আর তার সঙ্গে এখানকার সকাল এবং বিকেলের নাস্তা তো এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অমৃত। সব মিলিয়ে শুধু আড্ডা নয়, বরং খাবারের জন্যও বিখ্যাত বোস কেবিন।
ভুলুবাবুর নাতি তারক চন্দ্র বসু বলেন, ‘১৯৩৭ সালে একবার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন। সেসময় পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে দাদা ভুলুবাবু কড়া ও হালকা লিকারের দুই কেটলি চা বানিয়ে ছুটলেন নেতাজির জন্য। সেই চা খেয়ে তখন খুবই খুশি হয়েছিলেন নেতাজি, আশীর্বাদও করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন সুযোগ পেলেও শুধু ওই একটি কথা মনে রেখেই দাদা এই ব্যবসা চালিয়ে যান।’
কথা হয় স্থানীয় প্রবীণ আজিজুর রহমানের সাথে। তিনি বলেন, এক সময় দু’আনা কাপে চা খেতাম এখানে বন্ধুদের নিয়ে। দেশের কত নামকরা মানুষ আসতেন এখানে! এখনো আসেন। তবে বর্তমানে সব ধরনের মানুষের আগমনে ইতিহাসের সাথে এটা যেন কেমন বেমানান। এখন যেন শুধু খাবারের হোটেল হয়ে গেছে এটা।
বোস কেবিনের বর্তমান মালিক তারক চন্দ্র বসু বলেন, খুব শিগগিরই নতুন করে মানোন্নয়নের কাজ হবে। কেবিনে আনা হবে আভিজাত্যের ছাপ। আজ ২০২২ সালে বোস কেবিনের ১০১ বছর পূর্তি হলো।
সৌম্যনাথ বণিক গত ৯ বছর ধরে এখানে চায়ের কারিগরের সাহায্য করছেন। তিনি বলেন, এখানে চা প্রধান। চা তৈরির স্পেশাল কিছু নেই। এটা হাতের বিষয়। পানি জ্বাল দেয়া, লিকার করা এসব এমনি এমনি একটা হিসেবে হয়ে যায়।
বোস কেবিনে বসার স্থানের চেয়ে ভেতরের রান্না ঘর, গুদাম ঘর অনেক বড় এবং বেশ পরিচ্ছন্ন।
তবে যে বোস কেবিন নিয়ে এতো মাতামাতি, তার নাম বোস কেবিন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তারক চন্দ্র বসু বলেন, আমাদের পারিবারিক টাইটেল বা পদবি হলো ‘বোস’। সে জন্যই এটা বোস কেবিন। আর এই বোস কেবিনের অন্যসব খাবারের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হলো এখানকার কড়া লিকারের রং চা। যে চায়ের খুব নামডাক। দুপুরের দুই ঘণ্টা বাদে এখানে চা পাওয়া যায় সারাদিন।
এছাড়া সকালের নাশতায় পরোটা-ভাজিসহ রয়েছে ডিমের ছয় রকম পদ। পাওয়া যাবে ডাল, হালুয়া, খাসি ও মুরগির মাংসের তরকারি। সকালে পাওয়া যাবে ডিমের স্পেশাল ওমলেট। এখানে দুপুরে ভাত বিক্রি হয় না। সকালের নাশতা শেষ হলে শুরু হয় মাংসের চপ, ডিমের চপ, কাটলেট, ভাজা মুরগি, মাংসের সঙ্গে সাদা পোলাও এবং বাটার টোস্ট বিক্রি। বোস কেবিনের কাটলেট এক কথায় অসাধারণ।
অনেকেই এখানে আসেন কেবল কাটলেটের টানে। তবে মনে রাখবেন, বোস কেবিন প্রতিদিন সকাল সাতটায় শুরু হয়ে খোলা থাকে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত। আর শুরু থেকে আজ অবধি এই নিয়মেই চলছে ঐতিহ্যের রঙমাখা বোস কেবিন।