চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের পাড়ে পলিথিনের ঘরই অরুনের ঠিকানা
নেই শীতের কষ্ট আর পোকা মাকড়ের ভয়
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:২০ পিএম, ১ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:৫৪ এএম, ১৫ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
মমতাময়ী মায়ের হাত ধরেই চৌগাছায় আসা, সে প্রায় দেড়যুগ আগের কথা, ভিক্ষাবৃত্তি করে চলত দিন। ৮ বছর আগে মায়ের মৃত্যু হলে বড় একা হয়ে যায় সে। মায়ের মৃত্যুর বছরই নারকেল গাছ থেকে পড়ে মেরুদন্ডের হাড় ভাঙ্গে তার, দু’পা অচল মাটিতে হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলতে হয়। এভাবে সারাদিন যা রোজগার করে তা নিয়ে ফেরে চৌগাছার কপোতাক্ষ নদের পশ্চিম পাশে পলিথিন দিয়ে কোন রকমে মুড়িয়ে রাখ অস্থায়ী ঘরে। দিন যাই রাত আসে আবার দিন এভাবেই কেটে গেছে কয়েক বছর কিন্তু ভাগ্যের নুন্যতম উন্নতি হয়নি অরুনের।
মিজানুর রহমান ওরফে অরুন (৪৫), পিতা গিয়াস উদ্দিন মোল্লা আর মাতা মৃত সাজেদা বেগম ওরফে সাজু পাশ্ববর্তী ঝিনাইদাহ জেলার মহেশপুর উপজেলার হাবাসপুর গ্রামের বাসিন্দা হলেও দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে চৌগাছায় তার ঘুরাফেরা। ভিক্ষা করে যা রোজগার করে মুলত সেই টাকায় চলে জীবন। কপোতাক্ষ নদের ব্রিজের নিচে এক সময় রাত যাপন করলেও বর্তমানে সে ব্রিজ ছেড়ে ২শ গজ দুরে নদের পাড়ে একটি পলিথিন ঝুলিয়ে তার নিচেই রাত কাটায়। প্রচন্ড শীত আর ঘন কুয়াশার মধ্যে অরুন পলিথিনের নিচে ময়লা, দূগন্ধযুক্ত গরম কাপড় মুড়ি দিয়ে রাত কাটায়, নেই কোন পোকা মাকড়ের ভয়।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজিনে যেয়ে দেখা যায়, ঝুপড়ি ঘরের মধ্যে বসে শরীরে তেল মালিশ করছে। কপোতক্ষ নদের কিনারে বসে গোসল করবে, প্রায় ৩ দিন গোসল করা হয়নি। পলিথিন মোড়ানো ঘরের মধ্যে নানা ধরনের বোতল, ছেড়া কাগজ, বস্তা আর কাঠের গুড়া। এর উপরই সে একটি বিছানা দিয়ে শুয়ে থাকে। কথা হয় মিজানুর ওরফে অরুনের সাথে।
সে জানায়, ১৯৮৮ সালের বন্যায় সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় অরুনের পিতা গিয়াস উদ্দিন। অভাব অনাটনের সংসারে নানা সমস্যা দেখা দিলে সে তার মায়ের হাত ধরে চলে আসে চৌগাছায়। দিনে ভিক্ষাবৃত্তি করে যা রোজগার করে তাতেই চলত মা আর ছেলের জীবন। রাতে কোন দোকানের সামনে বা স্কুলের বারান্দায় ঘুমাতো তারা। প্রায় ৮ বছর আগে তার মায়ের মৃত্যু হলে সে একা হয়ে যায়। একদিন নিজ জন্মস্থান হাবাসপুর গ্রামে যেয়ে একটি নারিকেল কাছে উঠে ডাব পাড়তে। গাছ থেকে পড়ে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যায় অরুনের। মহেশপুর হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসা গ্রহন করলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরতে পারেনি। দু’পায়ে কোন শক্তি নেই তাই হেঁচড়ে হেঁচড়ে চলে গোটা বাজার এলাকায়। চলার পথে কাগজ, বোতল, বস্তা যাই পাবে সেটি কুড়িয়ে নিবে সে। রাতে কপোতাক্ষের পাড়ে ওই ঝুপড়ি ঘরে অনেক কষ্ট করেই ফেরে। মেইন রাস্তা হতে তার ঘরে যাওয়ার সময় অসম্ভব কষ্ট সহ্য করতে হয় তার। ঘরে ফিরে অন্ধকারের মধ্যেই খুজতে থাকে লম্প (কুপি)। কুপিতে আগুন দিয়ে ময়লা শরীরেই অস্থায়ী ভাবে নির্মান করা চুলায় ভাত রান্না করে কোন রকমে খেয়ে ঘুমিয়ে যায় পলিথিনের ঘরে। রাতে প্রচন্ড শীতে কষ্ট হলেও কোন কিছুই যে তার করার নেই। একজন ব্যক্তির দান করা একটি লেপ ও কিছু পুরানো শীতের পোষাকই তার স্বম্বল।
অরুন বলেন, অসুস্থ্যতার কারনে গোসল করতে, মাথার চুল কাটাতে কিছুই ঠিক মত করতে পারিনা। এ কারনে অনেকেই তাকে পাগল মনে করে। ভাল চিকিৎসা পেলে সে সুস্থ্য হয়ে উঠবে বলে বিশ্বাস। কিন্তু টাকা কোথায়, কে দিবে তাকে টাকা এ ধরনের নানা প্রশ্ন তার মনে। ২ ভাই আর ২ বোনের মধ্যে সে সবার বড়। ছোট ভাই কালাচাঁদ গ্রামে থাকে পরের ক্ষেতে জোন দেয়, বাবাও অন্যের জমিতে কাজ করে।
পারবাজারের ব্যবসায়ী চঞ্চল হোসেন, কান্ত কুমার বলেন, শারীরীক অসুস্থ্য অরুন বছরের পর বছর এখানে রাত যাপন করে আসছে। কখনও ব্রিজের নিচে কখনও নদের পাড়ে ওই খালি স্থানে সে থাকে। পা দুটো অচল হওয়ায় তাকে বেশ কষ্ট করেই মেইন সড়কে উঠা ও নদের পাড়ে বসবাসের স্থানে যেতে হয়। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, অরুনের খারাপ অভ্যাস হচ্ছে গাজা সেবনকরা। তার মা যখন বেঁচে ছিল তখনও মা ও ছেলেকে অনেকেই এক সাথে নেশা করতে দেখেছে। নেশার জগত থেকে সরাতে পারলে হয়ত সে অনেকটাই সুস্থ্য হত ধারনা অনেকের।