নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে ফাঁসাতে নিরপরাধ নারীকে খুন
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮:৫০ পিএম, ২৭ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৩৬ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাঠ থেকে সরাতে একটি লাশ ফেলার পরিকল্পনা করেছিলেন হালিম হাওলাদার (৫২) নামের এক ব্যক্তি। এজন্য এক হিন্দু নারীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনি। সেটা সফল না হলে কোনো রিকশাচালক বা অন্য কোনো নারীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরে পরিকল্পনা মোতাবেক একজন ভাড়াটে খুনিও ঠিক করেন তিনি। সেই খুনিই প্রেমের ফাঁদে ফেলে ‘স্বামী-স্ত্রী’ পরিচয়ে ভাড়া বাসায় নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এক নারীকে খুন করেন। পরে সেই নারীর পাশে প্রতিপক্ষের এনআইডি কার্ড রেখে পালিয়ে যান।
বাগেরহাটের মোংলা থানার চিলা ইউনিয়নে প্রতিপক্ষ মেম্বার প্রার্থী বিল্লাল সরদারকে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঠ থেকে সরাতে হালিম হাওলাদার এমন পরিকল্পনা করেছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
আজ সোমবার (২৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ধানমন্ডির পিবিআই সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এসব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি ক্লুলেস হত্যাকাণ্ড হওয়ায় পিবিআই ঢাকা জেলা স্ব-উদ্যোগে মামলাটির তদন্ত অধিগ্রহণ করে। মামলাটি তদন্তকালে এনআইডি কার্ডের সূত্র ধরে মামলার ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত মূল ঘাতক মো. জামাল হাওলাদার ওরফে সামাদুজ্জামানকে (৫০) গত ২২ সেপ্টেম্বর রাতে ও পরদিন হত্যা পরিকল্পনার সহযোগী দর্জি মাস্টার মশিউর রহমান ওরফে মিলন কবিরাজ (৪৬) মিরপুর দারুস সালাম এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা দুজন আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি প্রদান করেছেন।’
সর্বশেষ গতকাল রোববার হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হালিম হাওলাদারকে (৫২) বাগেরহাট জেলার মোংলা থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানান বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আসামি হালিম হাওলাদারের বাড়ি বাগেরহাট মোংলার পশ্চিম মচিলা। বাবার নাম হামিদ হাওলাদার। তিনি মোংলা থানার ৬নং চিলা ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের মেম্বার প্রার্থী বিল্লাল সরদারকে একটি হত্যাকাণ্ডে ঘটিয়ে ফাঁসানোর পরিকল্পনা করেন।’
‘পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাকাণ্ডের আনুমানিক ২০ দিন আগে হালিম মেম্বার ঘাতক জামালের সঙ্গে মোংলায় দেখা করেন। ৩০ হাজার টাকায় একটি লাশ ফেলার চুক্তি হয়। অগ্রিম দেওয়া হয় ৫ হাজার। শর্ত থাকে যে, প্রতিপক্ষ মেম্বারপ্রার্থী বিল্লাল সরদারের এনআইডির ফটোকপি ফেলে যেতে হবে হত্যাকাণ্ডের স্থানে। সেজন্য হালিম নিজেই বিল্লালের এনআইডি কপি সংগ্রহ করে খুনি জামালের হাতে দেন,’ যোগ করেন পিবিআই প্রধান।
তিনি আরও বলেন, ‘ঘাতক জামাল তার বন্ধু দর্জি মাস্টার মশিউর রহমান ওরফে মিলন কবিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তার কথা মতো পূর্বপরিচিত ও কথিত বান্ধবী পারুল বেগমকে টার্গেট করেন জামাল। পারুল বেগম বাচ্চাদের জামাকাপড় তৈরি করে নিজেই ফেরি করে বিক্রি করতেন। ঘাতক জামাল পারুল বেগমের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে তাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে সাভারের বক্তারপুরে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিতে প্রলুব্ধ করেন।’
‘তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাভারের বক্তারপুর নামা বাজার এলাকায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে ওঠেন। পরিকল্পনা মতো, ওই রাতেই পারুল বেগমকে ভাড়াটে খুনি জামাল হাওলাদার গলায় জলপাই রঙের ওড়না দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেন। পরে লাশের পাশে বিল্লাল সরদারের এনআইডি কার্ডের ফটোকপি ফেলে রেখে যান,’ যোগ করেন বনজ কুমার মজুমদার।
তিনি বলেন, ‘এনআইডি’র সূত্র ধরে পিবিআই’র তদন্ত দল বিল্লাল সরদারকে খুঁজে পায় এবং তার ব্যাপারে তদন্ত করে নিশ্চিত হয় যে, তিনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন। তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তদন্ত দল জানতে চায় তার কোনো শত্রু রয়েছে কি না, যে তাকে হত্যা মামলায় ফাঁসাতে পারে? তখন তিনি তার প্রতিপক্ষ মেম্বারপ্রার্থী হালিম হাওলাদারসহ কয়েকজনের নাম জানান।’
পিআইবি প্রধান বলেন, ‘তদন্ত দল জানতে পারে এ হত্যাকাণ্ডের আগে-পরে হালিম হাওলাদারের সঙ্গে ঢাকায় অবস্থানরত একজন সন্দিগ্ধ ব্যক্তির খুব ঘন ঘন যোগাযোগ হয়। সন্দিগ্ধ ওই ব্যক্তির ব্যাপারে অনুসন্ধান করে ঘাতক জামাল হাওলাদার ওরফে সামাদুজ্জামানের পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার জামালের ছবি সাভারে ভাড়া বাসার কেয়ারটেকারকে দেখালে তিনি জামালকে শনাক্ত করেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জামাল জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন এবং এ পরিকল্পনায় জড়িত হালিম মেম্বারসহ সকলের নাম প্রকাশ করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন। গ্রেপ্তার অপর সহযোগী পরিকল্পনাকারী দর্জি মাস্টার মিলন কবিরাজও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছেন। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই নিশ্চিত হয়ে মূল পরিকল্পনাকারী বাগেরহাটের মোংলা থানার চিলা ইউনিয়নের মেম্বার প্রার্থী হালিম হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করে।’
এক প্রশ্নের জবাবে বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘খুনি জানতেন না কাকে খুন করতে হবে। খুনের শিকার নারী জানতেন না কেন তাকে খুন করা হলো। শুধুমাত্র প্রভাব বিস্তার, ইউপি নির্বাচনে জেতার জন্য পারুলকে খুনের শিকার হতে হলো।’ তিনি বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় খুবই স্পষ্ট। খুনির পরিকল্পনা ছিল এমন একজনকে খুন করা হবে যে হবে নিম্ন আয়ের মানুষ। তাতে খুনের তদন্ত হলে বিল্লাল ফেঁসে যেতে পারে, তবে নিহত নারীর পরিবারের পক্ষ থেকে ‘ঝামেলা’ থাকবে না।’