পোর্ট কানেকটিং রোডে সিটি করর্পোরেশনের গাফিলতির মাশুল ২৬ কোটি টাকা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৪৭ পিএম, ৩১ জুলাই,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৫৪ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
চট্টগ্রাম মহানগরীর পোর্ট কানেকটিং (পিসি) রোডের অলংকার থেকে নিমতলা পর্যন্ত অংশের দৈর্ঘ্য পাঁচ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চারটি প্যাকেজে ছয় লেনের সড়কটির সংস্কার কাজ শুরু করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। তিন বছর আট মাস শেষে তিনটি প্যাকেজে কাজের গড় অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৫৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ অবস্থায় অসামপ্ত কাজ শেষ করতে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে চসিক। এতে ব্যয় বেড়েছে ২৬ কোটি টাকা। অতিরিক্ত এ খরচকে সংশ্লিষ্টদের গাফেলতির মাশুল হিসেবেই দেখছেন নগরবাসী।
এদিকে দীর্ঘদিনেও সংস্কার কাজ শেষ না হওয়ায় দুর্ভোগ বেড়েছে স্থানীয়দের। সড়কটির বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সামপ্রতিক বর্ষণের পানি জমে তা অনেকটা পুকুরে পরিণত হয়েছে। এতে যান চলাচল তো দূরের কথা; পায়ে হেঁটে যেতেও বেগ পেতে হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্দর থেকে প্রতিদিন পণ্য বা কন্টেনারবাহী পরিবহন ঢাকাসহ দেশের নানাপ্রান্তে যাতায়াত করে এ সড়ক দিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে সড়কটির বেহাল অবস্থার কারণে পণ্য পরিবহনে দুর্ভোগ এবং হয়রানি পোহাতে হচ্ছে।
সড়কটির এক নম্বর প্যাকেজে তাসফিয়া আনন্দিপুর গেট থেকে সাগরিকা মাজার পর্যন্ত, দুই নম্বর প্যাকেজে বড়পোল থেকে তাশফিয়া আনন্দিপুর গেট পর্যন্ত, তিন নম্বর প্যাকেজে নিমতলা বিমান চত্বর থেকে বড়পোল ব্রিজ পর্যন্ত এবং চতুর্থ প্যাকেজে সাগরিকা মাজার থেকে অলংকার পর্যন্ত অংশ রয়েছে।
দুই নম্বর প্যাকেজে এক দশমিক ৬৭৫ কিলোমিটার সড়কের জন্য ৫০ কোটি ৫৮ লাখ ৬৩ হাজার ৩৩৯ টাকা এবং তিন নম্বর প্যাকেজের জন্য এক দশমিক ৬৮২ কিলোমিটার সড়কের জন্য ৫০ কোটি ৮২ লাখ ৭০ হাজার ৩৩৮ টাকায় ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় ২০১৭ সালের ৫ ডিসেম্বর। দুই অংশেরই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘রানা বিল্ডার্স’। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর থেকে কাজ বন্ধ করে পালিয়ে যায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দুটি। কাজ শেষ করতে তাদের বারবার তাগাদা দেয় চসিক। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে তাদের কার্যাদেশ বাতিল করে চসিক।
এছাড়া এক নম্বর প্যাকেজে ৪০ কোটি ৮৬ লাখ ৪২ হাজার ২৬৩ টাকায় ১ দশমিক ৫৪ কিলোমিটার সড়কের জন্য ২০১৯ সালের ১৪ জুুলাই ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। গত ৩০ এপ্রিল কার্যাদেশের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এ অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এয়াকুব-ম্যাক-এম অনন্ত বিকাশ (জেভি)। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যাদেশও বাতিল করা হয়।
সর্বশেষ চলতি মাসে দুই ও তিন নম্বর প্যাকেজে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছে চসিক। এর মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগের আগে দুই নম্বর প্যাকেজে কাজ বাকি ছিল প্রায় ২০ কোটি টাকার। অথচ নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করতে হয়েছে ২৭ কোটি টাকায়। অর্থাৎ অতিরিক্ত সাত কোটি টাকা ব্যয় হবে। একইভাবে তিন নম্বর প্যাকেজে কাজ বাকি ছিল প্রায় ১৬ কোটি টাকার। তবে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে ২১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।
এছাড়া এক নম্বর প্যাকেজর জন্যও ৪২ কোটি টাকায় ঠিকাদার চূড়ান্ত করা হয়েছে। যদিও প্যাজেকটিতে প্রায় ২৮ কোটি টাকার কাজ বাকি ছিল। অর্থাৎ অতিরিক্ত ব্যয় হবে ১৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার মাশুল হিসেবে তিনটি প্যাকেজে অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ২৬ কোটি টাকা।
চতুর্থ প্যাকেজে শূন্য দশমিক ৭৫ কিলোমিটার সড়কের জন্য ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর ২৭ কোটি ৮৪ লাখ ৭৯ হাজার ৪৩১ টাকায় ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। এ অংশের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। পুরো প্রকল্পে অর্থায়ন করছে জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ‘সিটি গভর্নেন্স প্রকল্পের’ আওতায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চসিক। ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর কাজের উদ্বোধন করেন তৎকালীন আ.জ.ম নাছির উদ্দীন।
গড় অগ্রগতি ৫৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ : এক নম্বর প্যাকেজের ঠিকাদারকে দেয়া কার্যাদেশ বাতিলের চিঠিতে বলা হয়, এ অংশে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২৮ শতাংশ। এছাড়া কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, দুই নম্বর প্যাকেজে ৬৫ শতাংশ ও তিন নম্বর প্যাকেজে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ করেছে।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ইতোমধ্যে নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। বর্ষা শেষ হলেই কাজ শুরু হবে। নভেম্বর মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা আছে। যেসব ঠিকাদার কাজ ফেলে পালিয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আপাতত জনগণের চলাচলের সুবিধার্থে ইট বিছিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছি। এজন্য তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ ইটও সংগ্রহ করা হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরেও কাজ শেষ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ‘ঠিকাদাররা সুযোগ নিয়েছিল। গৃহস্থের আন্দাজ বুঝে চোরও চুরি করে। এখানেও সে অবস্থা হয়েছে। ঠিকাদারদের অ্যাডভান্স দিয়েছে। অগ্রিম টাকা পেয়ে স্বাভাবিকভাবে তারা গাফেলতি করেছে।’
তিনি বলেন, ঠিকাদাররা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিল। এক্ষেত্রে চুক্তি হয়েছিল, সিটি কর্পোরেশন বিল হিসেবে যে চেক ইস্যু করবে তা ব্যাংকের নামে করতে হবে। কিন্তু সাইন অথরিটি চেক ইস্যু করেছে ঠিকাদারের নামে। এ সুযোগে তারা টাকা নিয়ে পালিয়েছে। আর ব্যাংক আমাদের দোষারোপ করছে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি।
উল্লেখ্য, বিলের টাকা ব্যাংকের (ইউসিবিএল, কুমিল্লা শাখা) নির্ধারিত হিসাবে জমা না দিয়ে ঠিকাদারের নামে সরাসরি ইস্যু করেছে চসিকের প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। যার পরিমাণ ২৪ কোটি ৯১ লাখ ৯৬ হাজার ৩০৭ টাকা। বিপুল অংকের এ টাকা পেয়ে মাঝপথে কাজ ফেলে পালিয়েছে দুই ও তিন নম্বর প্যাকেজের ঠিকাদার।
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, নতুন করে নিয়োগ পাওয়া ঠিকাদারদের কোরবানের আগে সাইট বুঝিয়ে দিয়েছি। কিন্তু লকডাউনের কারণে কাজ শুরু করতে পারেনি। অতিরিক্ত ব্যয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০১৭ সালে যখন ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছিল তখন রেট ছিল ওই সময়ের বাজার দর অনুযায়ী। বর্তমান বাজার দরে নতুন রেট নির্ধারণ করায় ব্যয় বেড়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, সাবেক মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন তাঁর মেয়াদকালের প্রায় অর্ধেক সময় পেলেও প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেন নি। এরপর পূর্ণ মেয়াদ পেয়েও প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি। বর্তমান মেয়রের ১০০ দিনের অগ্রাধিকার তালিকায় সড়ক সংস্কারের বিষয় থাকলেও অগ্রগতি হয়নি পিসি রোডের।
নগরবাসী বলছেন, ২০১৯ সালে নগরে শুরু হওয়া বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। অথচ একই বছর শুরু করা পিসি রোডের কাজ শেষ না করা দুঃখজনক।