চট্টগ্রামে ধরা পড়লো ভয়ঙ্কর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৩২ পিএম, ২৯ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:১০ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
চট্টগ্রামে প্রথমবারের মতো বিরল ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে এক নারী আক্রান্ত হয়েছেন। করোনা আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হবার পর ষাটোর্ধ্ব ওই নারীর শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস শনাক্তের বিষয়টি নিশ্চিত হয় গতকাল বুধবার।
প্রথম দিকে চিকিৎসকরা তা স্বীকার না করলেও রোগীর চিকিৎসায় যে ওষুধ দেওয়া হয়েছে তা একমাত্র ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আক্রান্ত রোগীকেই দেওয়া হয়। এছাড়া রোগীর ছেলে ও চমেক হাসপাতালের পরিচালক এই রোগী ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত বলে জানিয়েছেন।
জানা যায়, গত মাসের ২৫ তারিখ থেকে জ্বরে আক্রান্ত হন পটিয়া উপজেলার বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব গৃহিণী ফেরদৌস বেগম। চলতি মাসের ৩ তারিখ তিনি কোভিড টেস্টে পজেটিভ হন। ১৫ জুলাই কোভিড নেগেটিভ হলেও উনার নানা শারিরীক অসুবিধা দেখা দেয়। পরে স্বজনরা তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান।
সেখানে চিকিৎসকরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে এই রোগীর শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। গত চারদিন ধরে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তবে হাসপাতালে রাখা হলেও প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকটের কারণে চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক ও পরিবারের লোকজন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা সুযত পাল বলেন, ‘রোগীর অবস্থা দেখে ধারণা করা হচ্ছে এটি "মিউকরমাইকোসিস" রোগে আক্রান্ত। এটি ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কি না, তা এখনো নিশ্চিত নই। রিপোর্ট আসলে বলা যাবে।’
মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার না করলেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরে আজকেই আমরা নিশ্চিত হয়েছি তিনি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত। আমাদের চিকিৎসকদের অধীনে চিকিৎসা চলছে। তাকে আমাদের চিকিৎসকরা আগামীকাল পর্যন্ত দেখবে। এরপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে রোগীকে ঢাকায় পাঠানো হবে কি না।’
এই নারীর চিকিৎসায় এমপোটেরিসিন-বি ইনজেকশন প্রতিদিন ৫ ভায়াল করে মোট ১৪ দিন প্রয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। মাকে বাঁচাতে ব্যয়বহুল এই ওষুধ এখন হন্যে হয়ে খুঁজছেন সন্তানরা। কিন্তু তা এখনও পাওয়া যায়নি। আক্রান্ত এই নারীর স্বামী পাঁচদিন আগে করোনা পজেটিভ হয়ে মারা গেছেন। এখন তাঁর সন্তানেরা চোখের জলে ছুঁটোছুটি করছেন ওষুধের জন্য।
রোগীর ছেলে মো. বেলাল হোসাইন বলেন, ‘পাঁচদিন আগে আমি আব্বাকে হারিয়েছি। এখন আমার মা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার জন্য এমপোটেরিসিন-বি ইনজেকশনটি খুঁজছি। কিন্তু তা পাওয়া যাচ্ছেনা। প্লিজ আপনারা এই ওষুধের সন্ধান দিন। যত টাকা লাগে আমরা দিব। আমার মাকে বাঁচাতে চাই।’
বিরল এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই হাতেগোনা। তাই সরকারিভাবে আপাতত এই পরামর্শ মতো ইনজেকশন যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। তবে রোগী বাড়লে সরকারি নির্দেশনা আসতে পারে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।
এই ইনজেকশনটির বিষয়ে চট্টগ্রামে সিভিল সার্জন ডা.সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘এই রোগে যে ইনজেকশন প্রয়োজন তা এখনও দেশে নেই। ঢাকায় এক রোগীকে যে ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়েছিল তা কার্যকর প্রমাণিত হয়নি।’
চিকিৎসকরা বলছেন, খুব কাছাকাছি দীর্ঘ সময় ধরে সংস্পর্শে না গেলে এই রোগ সংক্রমনের ঝুঁকি কম। মূলত, কোভিড আক্রান্তদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় এই রোগে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা বেশি। তবে শুরু থেকেই এই রোগে চিকিৎসা করা জরুরী।
এরআগে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে চলতি বছরের গত ৮ মে ৪৫ বছর বয়সী এক রোগীর শরীরে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপর গত ২৩ মে ৬০ বছর বয়সী আরেক জনের শরীরেও ছাত্রাকজনিত রোগটি শনাক্ত হয়। তারা দুজনেই করোনা আক্রান্ত ছিলেন। পরে করোনা মুক্ত হন তারা।
রোগটির বিষয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, বিরল এ সংক্রমণে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশের মতো। বাঁচার জন্য অনেককে চোখও ফেলে দিতে হয়। কোভিড থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার ১২-১৮ দিনের মাথায় এ রোগে আঘাত হানার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে মিউকরমাইকোসিসে ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি বলেও মনে করা হচ্ছে। মূলত করোনা আক্রান্ত রোগীকে মাত্রা না বুঝে স্টেরয়েড দিলে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। যার ফলে রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) মতে, বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এই ছত্রাক ক্ষতিকর নয়। যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে তাদের শরীরে মিউকরমাইসিটিসের স্পোর প্রবেশ করলে ফুসফুস ও সাইনাস আক্রান্ত হতে পারে। যা পরে শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে।
সিডিসি’র মতে, এই বিরল ছত্রাকে আক্রান্তদের মৃত্যুহার ৫০ শতাংশ। কোভিড-১৯ ও ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগী, যারা স্টেরয়েড নিচ্ছেন, ক্যান্সার আক্রান্ত অথবা যারা অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছেন, তারা সবচেয়ে বেশি ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।