চলনবিলে চলছে এখন শুঁটকি তৈরির ধুম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:২৪ পিএম, ১১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:২৫ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
চলনবিলে চলছে এখন শুঁটকি তৈরির ধুম। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শুঁটকি মাছের চালাতগুলোতে চলছে মাছ কাটা, মাছ বাছাই করা, মাছ রোদে শুকানো আর প্যাকেটজাত করার কর্মযজ্ঞ। চলবে অগ্রহায়ন মাস পর্যন্ত। কারন,চলনবিলের পানিতে এখন ভাটিরটান। ধরা পড়ছে ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ। পেশাদার-অপেশাদার জেলেরা জালদিয়ে ফাঁদপেতে মাছ শিকার করছে। এসব মাছ তারা বিভিন্ন হাট-বাজারে অপেক্ষাকৃত কমদামে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। ধরাপড়া এসব মাছ বাছাই করে বড় সাইজের ভাল মাছগুলো চলে যায় দেশের বিভিন্ন মোকামে। আর ছোট ছোট মাছগুলো রোদে শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুটকি।
মৎস বিভাগের হিসাব মতে, ৯২৫বর্গ মাইলের এই চলনবিলের মাছকে ঘিরে কম বেশী প্রায় দুই শতাধিক শুটকি মাছের চাতাল বসে। চলনবিলের এসব দেশীয় প্রজাতির মিঠা পানির মাছ টেংরা, পুঁটি, খলসে, বাতাসী, চেলা, মলা, ঢেলা, টাকি, গুচি, বাইম,শোল, বোয়াল, গজার, কই, মাগুর, সিং সহ নানা সু-স্বাদু মাছ ধরা শুরু হয়। এই মাছকে ঘিরেই বিলের অপেক্ষাকৃত উঁচুএলাকায় বসানো হতো শুঁটকি মাছের চাতাল। শুটকি ব্যবসায়িদের ভাষ্যমতে,নানা কারনে চলনবিল সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বছর জুড়ে পানি না থাকায় নষ্ট হয়ে গেছে মাছের অভায়শ্রম। একারনে আগের মত পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায়না। ফলে শুটকির চাতালও গেছে কমে। এখন ২০-৩০টি পয়েন্টে ৪০-৫০টি শুটকির চাতাল রয়েছে বলে জানালেন।
বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক ঘেঁষে তাড়াশের মহিষলুটিতে গিয়ে দেখায়ায় শুটকির চাতাল। শুটকি চাতাল ঘুরে দেখা গেছে, চাতাল গুলোতে ট্যাংরা, পুঁটি, চান্দা আর বাইল্যা মাছ শুকানো হচ্ছে। আকারে একদম ছোট। বক্কারের চাতালে টং বসানো টংযের উপরে এসব মাছ শুকানো হচ্ছে। নান্নুর চাতালেও টংযের উপর কম বেশি মাছ শুকানো হচ্ছে। নারী শ্রমিকরা এসব মাছ শুকানোতে ব্যস্ত। কেউ কেউ শুকানো মাছগুলো প্রক্রিয়া জাত করছেন।
শুটকি মাছ শুকানো শ্রমিক চায়না (৩৫) লতা (৩০) ও সবিতা জানান, তারা ২০০ টাকা মজুরিতে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাজ করেন। মাছ প্রক্রিয়াজাত করে শুকানো এবং প্যাকেটজাত করা হচ্ছে তাদের কাজ। বর্ষায় বিকল্প কাজ না থাকায় তারা এত কম মজুরিতে কাজ করছেন।
চাতাল মালিক সিদ্দিক জানান,-প্রতি ৩ কেজি মাছে প্রায় ১ কেজি শুটকি হয়ে থাকে। প্রকার ও মানভেদে এসব শুটকি মাছ ৪৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়ে থাকে। অবশ্য শহরাঞ্চলে এর দাম আর একটু বেশী। শুটকির সিংহ ভাগই সৈয়দপুর, রংপুর, দিনাজপুর, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ এমনকি বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়ে থাকে। তাদের ভাষ্যমতে, শুটকি ব্যবসায় লাভ রয়েছে। তা ছাড়া চলনবিলের দেশীয় প্রজাতির মাছের শুঁটকির চাহিদা ব্যাপক। তবে আগের মত পর্যাপ্ত মাছ পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তার দাম অনেক বেশী। একারনে দিনদিন শুঁটকির চাতালের সংখ্য কমছে। সেই সাথে কমছে লাভ। এতে করে কমেছে শ্রমিকদের মজুরি।
গুরুদাসপুর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আলমগীর কবির ও তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মজগুল আজাদ জানান, চলনবিলে মাছের সেই সমারহ আর নেই। মাছের অভায়শ্রম নষ্ট হয়ে গেছে। প্রজনন মৌসুমের শুরুতেই পোনা নিধন চলায় পর্যাপ্ত মাছের দেখা মেলেনা। তার পরও যেসব মাছ ধরা পড়ে তার সিংহভাগ মাছ স্থানীয় চাহিদা মেটানোর পর দেশের বিভিন্ন মোকামে চলে যায়। কেবল ছোট ছোট মাছগুলো শুকানো হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের ড.মোঃ রেদওয়ানুর রহমানের লেখা ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে চলনবিলের জীববৈচিত্র ও জীবন-জীবিকা ওপর বিরুপ প্রভাব’ প্রবন্ধ মতে,১৯৮২ সালে মৎস আহরন হয়েছিল ২৬হাজার ৯৯০ মে.টন। যা ধারাবাহিক ভাবে কমতে কমতে ২০১৬ সালে দাঁড়িয়েছে ১২হাজার ২১৭ মে.টন। এভাবে কমতে থাকলে এক সময় হয়তো চলনবিল মাছ শূন্য হয়ে পড়বে। চলনবিলের ৩৮দশমিক ৮৯% মাছ আজ বিলুপ্তির পথে।