লকডাউনে নিরন্ন-বুভুক্ষু মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে - বিএনপি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৫০ এএম, ৭ জুলাই,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ১২:০৬ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার পথে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দলের কেন্দ্রীয় দফতরের দায়িত্বে থাকা সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স এই অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, সরকারের অপরিকল্পিত চলমান লকডাউনে বাংলাদেশের জনপদে নিরন্ন ও বুভুক্ষু মানুষের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দিনমজুর ও নিম্ন আয়ের মানুষ। লকডাউনে কাজ না থাকায় ছেলেমেয়েদের মুখে ভাত তুলে না দিতে পেরে মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তর মুক্তারপুর এলাকায় নিজ বাড়িতে দিনমজুর দ্বীন ইসলাম আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। নির্মম ও বেদনাদায়ক এই ঘটনাটি ঘটেছে গত ৪ জুলাই দুপুরে। অথচ সরকারের মন্ত্রী-কর্মকর্তারা হরহামেশাই বলে যাচ্ছেনÑ তারা পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করেছেন, কেউ না খেয়ে নেই, না খেয়ে মারা যাবে না কেউ, ইত্যাদি ইত্যাদি। মুক্তারপুরে দ্বীন ইসলামের মতো দেশের অগণিত মানুষ এ ধরনের নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখী। এই দায় কার? অবশ্যই এর দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।
শুধু তাই নয়, সরকারের অব্যবস্থাপনা, ভ্রান্তনীতি ও অবহেলা-উদাসীনতায় করোনা চিকিৎসায় যে সংকট দেখা দিয়েছে, অক্সিজেনের অভাবে প্রতিদিনই মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, এই মৃত্যুর দায়ও সরকারকেই নিতে হবে।
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, বর্তমান ভোটারবিহীন সরকারের চরম ব্যর্থতায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা আগের দিনের রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে। জ্যামিতিক হারে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধির এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জনগণ এখন দিশেহারা হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। একদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি, অপরদিকে সরকারের অপরিকল্পিত, অমানবিক ও নিষ্ঠুর লকডাউনে জনগণ এখন বেগতিক অবস্থার মধ্যে পড়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑ বিএনপির পক্ষ থেকে দলের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরামÑ জাতীয় স্থায়ী কমিটি এবং বিএনপি গঠিত ‘করোনার ভ্যাকসিন সংগ্রহ-বিতরণ পর্যবেক্ষণ কমিটি’ এসব বিষয়ে বিস্তারিত বক্তব্য জাতির সামনে তুলে ধরেছে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিএনপি বারবার বলেছে, করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে গণটিকা ছাড়া এই মহামারি মোকাবিলা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে লাভবান করার জন্য একটি মাত্র উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশকে বিপাকে ফেলেছে, জনগণের জীবন-জীবিকাকে বিপন্ন করে তুলেছে। সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভুল সিদ্ধান্ত, সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ না নেয়া, অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে অক্ষমতা এবং সার্বিক অদক্ষতা ও অযোগ্যতার জন্য পরিস্থিতি গতকাল লেজে-গোবরে তথা হ য ব র ল অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছে। আমরা আগেই বলেছি, এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সরকার বারবার সাধারণ ছুটি, বিধিনিষেধ, কঠোর বিধিনিষেধ, লকডাউন, সীমিত লকডাউন, কঠিন লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে এসব পদক্ষেপ কার্যকর হচ্ছে না, বরং জনগণের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। আমরা বারবার এও বলেছি যে, রাজনৈতিক ও সামাজিক তথা জনগণকে সম্পৃক্ত করা ছাড়া কোনো পদক্ষেপই সফল হয় না। লকডাউনে সমাজের যে অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়Ñ অর্থাৎ নিম্ন আয়ের দিন আনে দিন খায় মানুষ, বেকার-কর্মহীন মানুষের দু মুঠো ভাতের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া এসব পদক্ষেপ কার্যকর হয় না। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব তো হচ্ছেই না, বরং জনগণের জীবন বিপন্ন হচ্ছে, মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। সরকারের ব্যর্থতায় প্রতিদিন মানুষ কাজ হারাচ্ছে, দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হচ্ছে, এমনকি মধ্যবিত্তরাও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতায় তাদের আয় সংকুচিত হচ্ছে। এবারও লকডাউনের আগে আমরা সরকারকে বলেছিলামÑ এই শ্রেণির মানুষের হাতে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা পৌঁছে দিতে। সরকার তা করে নাই। ফলে পরিবহন শ্রমিক, দিনমজুর, নিম্ন আয় এবং কর্মহীন-বেকার মানুষের জীবনধারণ এখন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। মানুষ পরিস্থিতির শিকার হয়ে নিদারুণ কষ্ট করছে। অর্ধাহারে-অনাহারে থেকে মানবেতর অবস্থায় দিনযাপন করছে। খাদ্য ও অর্থাভাবে ক্ষুধার তাড়নায় লকডাউনে মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে, অন্যদিকে রাস্তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হচ্ছে এবং জরিমানার শিকার হচ্ছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আমরা এক হীরক রাজার দেশে বসবাস করছি।
বিএনপির এই নেতা বলেন, সরকার করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে সহায়তার নামে যে বরাদ্দ দিয়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা জনগণের সাথে তামাশা করা ছাড়া কিছুই নয়। ২০২০ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে ক’বার বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা কোনো সময় মাথাপিছু ১১ পয়সা, কিংবা ১৪ গ্রাম চাল। বর্তমানেও চলমান লকডাউনে যে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে তা মাথাপিছু ৭ দিনের হিসাবে ১৩ টাকারও কম। এখন বলা হচ্ছে, ঈদের আগে দশ কেজি করে চাল দেয়া হবে, তাহলে ঈদের আগ পর্যন্ত এই লকডাউনে মানুষ কি খেয়ে বাঁচবে। প্রকৃত অর্থে, এই বরাদ্দও এখন পর্যন্ত ছাড় হয়নি এবং তা জনগণের হাতে পৌঁছে নাই। তাহলে কি এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, গেরস্থের গরু কেতাবেই আছে, গোয়ালে নেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গরিবের হক নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা লুটের মহৌৎসব চালাচ্ছে, যা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত নয় বলেই তারা জনগণের দুর্দিনে জনগণের পাশে না দাঁড়িয়ে মিথ্যাচার এবং লুটপাট ও দুর্নীতিতে ব্যস্ত।
তিনি আরো বলেন, সরকারের মন্ত্রীরা তাদের ব্যর্থতা আড়াল করতে প্রতিদিনই বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন। তারা নাকি দুরবিন দিয়ে বিএনপি-কে খুঁজে পাচ্ছেন না, বিএনপি নাকি মিথ্যাচার করছে। এসব কথা বলে তারা দেশের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তা থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নদিকে নিতে ব্যর্থ অপচেষ্টা করছেন, এসব অযৌক্তিক ও অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ সময়ে জনগণের জীবন নিয়ে চিন্তা না করে মশকরা করছেন, তাদের বডি ল্যাংগুয়েজ ও মাউথ ল্যাংগুয়েজে সেটাই ফুটে উঠছে। সরকার দেশের ৬৪টি জেলায় করোনার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণকল্পে যাদের দায়িত্ব প্রদান করেছিল এখনও পর্যন্ত তাদের কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। সরকারের বাগপটু মন্ত্রীদের উদ্দেশে বলতে চাইÑ বিএনপি-কে দুরবিন দিয়ে খোঁজার প্রয়োজন নেই, বিএনপি জনগণের প্রয়োজনে পাশে আছে, বিএনপি-কে না খুঁজে পরিহাস বন্ধ করে জনগণকে বাঁচানোর জন্য টিকা, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, খাদ্য, অর্থ নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়ান। তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করুন। আপনাদের ব্যর্থতায় মানুষ প্রতিদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এই মৃত্যুর দায় মাথায় নিয়ে জনগণের কাঠগড়ায় আপনাদের দাঁড়াতেই হবে। আর মিথ্যাচার বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ করছে। সবচেয়ে বড় মিথ্যা ২০১৮ সালে ৩০ ডিসেম্বরে। রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাস চালিয়ে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে অনুগত ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসনের এক অংশের সহায়তায় দিনের ভোট রাতে করে নির্বাচনকে ব্যর্থ করে দিয়ে যারা জোরপূর্বক ক্ষমতায় আছে, তারাই চরম মিথ্যা ও দুর্নীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে বিএনপির বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ শোভা পায় না। বরং আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদের মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে ইতিহাস বিকৃতি এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে চলেছে অবিরাম গতিতে। তারা ইতিহাস ও সত্যকে ভয় পায় বলেই শহীদ জিয়া, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতে যারপরনাই মিথ্যাচার করছেন। তবে জনগণ সত্য ইতিহাস জানে। আপনাদের মনগড়া ইতিহাস জনগণ বিশ্বাস করে না। লাগামহীন মিথ্যাচার ও জনগণের ভোটের অধিকার খর্বের জন্য আপনারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন। জনগণের এই চরম দুঃসময়ে বিএনপি জনগণের পক্ষে কথা বলার কারণে সরকারের লিপ সার্ভিস দেয়া মন্ত্রীরা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আবার জেলে নেয়ার হুমকি দিচ্ছেন। জনগণকে রক্ষা না করে, সারাদিন বিএনপির বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা, অসত্য বয়ান আর জেল-জুলুমের হুমকি দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা আড়াল করার হীন প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে তারা। বেগম খালেদা জিয়া এখনও মুক্ত নন, তিনি কার্যত এখনও বন্দি। বিভিন্ন শর্তের বেড়াজালে তাঁর সুচিকিৎসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বারবার জেল- জুলুমের ভয় দেখিয়ে বিএনপি-কে জনগণের পক্ষে কথা বলা থেকে বিরত রাখা যাবে না। এই চরম দুর্দিনেও সরকার বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। ময়মনসিংহ, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে হয়রানি করা হচ্ছে।
সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, বিএনপি অবিলম্বে অপরিকল্পিত ও সমন্বয়হীন লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহন শ্রমিক, হকার, দোকান কর্মচারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুরসহ নিম্ন আয় ও কর্মহীন মানুষের কাছে পর্যাপ্ত খাদ্য ও অর্থ সহায়তা পৌঁছে দেয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে। একই সাথে অতিদ্রুত সকলকে করোনা টিকা প্রদানসহ বিরাজমান করোনা চিকিৎসা সংকট নিরসনকল্পে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন, হাইফ্লো ক্যানোলা নজেল, ভেন্টিলেটর, আইসিউ বেড স্থাপন এবং চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগসহ সরকারি খরচে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসাব্যবস্থা করার আহ্বান জানাচ্ছে।