পুলিশী হেফাজতে বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যার বিচার চাইলেন স্বজনেরা
মেহেদী হাসান রিয়াদ, দিনকাল
প্রকাশ: ০৪:১০ পিএম, ২৪ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২৪ | আপডেট: ১১:৫১ পিএম, ১১ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
গত ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পুলিশী হেফাজতে মারা যাওয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেছেন, ‘শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদী সরকারবিরোধী রাজনীতি করার কারণেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে তাদের স্বজনদের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী ও গুমের শিকার নেতাদের পরিবার তাদের স্বজনদের মৃত্যুর বিচারও দাবি করেছেন।’
আজ বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ‘ভয়েস অব ভিকটিম ফ্যামিলি’র ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে স্বজনরা এ দাবি জানান। মানববন্ধনে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা ‘উই ওয়ান্ট ইন্টারন্যাশনাল ইনকোয়ারি’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ইত্যাদি লেখা প্ল্যাকার্ড বহন করেন।
পরে মৃত্যুবরণকারী ও গুমের শিকার নেতাদের পরিবারের পক্ষ থেকে কারা হেফাজতে রিমান্ডকালীন এবং অন্যান্য সময়ে হত্যায় জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিচারের দাবীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব:) বরাবর একটি স্মারক লিপি জমা দেন ‘ভয়েস অব ভিকটিম ফ্যামিলি’র সমন্বয়ক মেহেদী হাসান।
স্মারক লিপিতে ৫টি দাবি জানানো হয়। দাবি গুলো হলো : (ক) আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তার, অতঃপর নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত করতে হবে। (খ) বিচারের জন্য স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করতে হবে। (গ) সংশ্লিষ্ট থানার তৎকালীন অফিসারদের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। (ঘ) ভিক্টিম পরিবারের সদস্যদের চাকুরি ও আর্থিক ক্ষতিপূরন দিতে হবে। (ঙ) সংশ্লিষ্ট অফিসারদের অনতিবিলম্বে গ্রেপ্তার করে বিচার কার্যক্রম শুরু করতে হবে এবং তাদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করতে হবে।
এসময় বক্তারা বলেন, আমাদের পরিবারের সদস্যরা গত ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর বিচার বহির্ভূত ও কারা হেফাজতে হত্যার শিকার হয়েছে। হাসিনা সরকারের পোষ্য বাহিনী বিভিন্ন সময়ে বিএনপিসহ গণতন্ত্রকামী জনতার প্রায় অর্ধ শতাধিক ব্যক্তিকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডের নামে অত্যাচার করে কারাগারেই খুন করেছে। এমন কি গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে অত্যচারের কারণে পরবর্তীতে গুরুতর অসুস্থ হলেও বিনা চিকিৎসায় তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা আমাদের আপনজনদের হারিয়ে এখন নিঃস্ব ও ভীতসন্ত্রস্ত। কারা হেফাজতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে হত্যার সঠিক বিচার চাই।
ঢাকার লালবাগের একটি ওয়ার্ডের বিএনপি নেতা আনোয়ার হোসেনের ছেলে আনান হোসেন অশ্রুসজল চোখে বলেন, ‘আমার বাবাকে ধরে নিয়ে লালবাগ থানায় অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এরপর তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে। নির্যাতনের কারণে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, চোখ খুলতে পারতেন না তিনি।’ ‘আনোয়ার হোসেন ভালো চিকিৎসা পায়নি’ অভিযোগ করে আনান বলেন, ‘বাবা ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। বাবা আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন না। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।’
পিরোজপুর জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান বাবর শেখকে পুলিশ নির্যাতন করে মেরে ফেলেছে বলে অভিযোগ করেছেন তার স্ত্রী ডালিয়া বেগম।
তিনি বলেন, ‘সে বিএনপি করে-এটাই তার একমাত্র অপরাধ। যদি বিএনপি করা অপরাধ হয়, তাহলে দেশে কেন দুই দল? এক দল থাকাই তো দরকার।’
গত ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের ওয়াদুদ খন্দকারকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলা হয় বলে অভিযোগ করেন তার ভাই জাহিদ খন্দকার। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই একটি দোকান চালাতেন এবং বিএনপির সমর্থক ছিলেন।’
বরিশালের বাসিন্দা মো. ইউনূসের ছেলে রেজাউল করিম ছিলেন শিক্ষানবিশ আইনজীবী। ইউনূস অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশ আমার ছেলেকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে অত্যাচার করে মেরে ফেলেছে। অসুস্থ হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে সে মারা যায়। মামলা করলেও বিচার পাইনি। আমার কোল যারা খালি করেছে, আল্লাহ তাদের কোল খালি করবে। সারাবিশ্বের কাছে আমার ছেলের হত্যার বিচার আমি চাই।’ এসময় কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তিনি।
ছাত্রদল নেতা মাহবুবুর রহমানের (বাপ্পি) বোন ঝুমুর জানান, ‘২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি পুলিশ আমার ভাইকে ধরে নির্যাতন করে। নির্যাতনে আহত হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পুলিশ তার ওপর নির্যাতন করে। শুধু তাই নয়, পুলিশ আমাদের পরিবারের সকল সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। আমাকেও ১০দিন রিমান্ডে রাখা হয়। বিএনপির রাজনীতি করার অপরাধে আমার ভাইকে নির্যাতন করে মেরে ফেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। বিএনপি করা কি আমার ভাইয়ের দোষ ছিলো।’
এ সময় কারা হেফাজতে মৃত্যুবরণ করা- আনোয়ার হোসেন মাহবুব (লালবাগ), মাহবুবুর রহমান বাপ্পি (নিউ মার্কেট), রফিকুল ইসলাম (শাহবাগ), ওয়াদুদ খন্দকার (নারায়নগঞ্জ), রেজাউল করমি রেজা (বরিশাল), বদিউর রহমান বদি (যশোর), নজরুল ইসলাম শান্তি (যশোর), উজ্জ্বল (যশোর), আসাদুজ্জামান বাবর শেখ (পিরোজপুর), আমিরুল ইসলাম মিন্টু (ঢাকা), ফকির আহমেদ (মিরেরসরাই), মিজানর (খুলনা), এরশাদ আলী লাডলা (বংশাল), আসাদুজজামান হিরা (গাজীপুর), মোঃ ইদ্রিস (ঢাকা), আলী হোসেন, এবং গুম হওয়া মোঃ কাওসার, চঞ্চল, সোহেল, তরিকুল ইসলাম তারা, জহিরুল ইসলাম এর পরিবারের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
দিনকাল/এমএইচআর