সিলেটে ২০০৪ সালের বন্যাকে স্মরণ করিয়ে দিল এবারের বন্যা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৫:১৭ পিএম, ২২ মে,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৪৪ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সিলেটে এবারের বন্যা পরিস্থিতি মনে করিয়ে দিল সেই স্মৃতি। গত ১৮ বছর আগে ২০০৪ সালে এমন পানি হয়েছিল। ১৮ বছরের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বড় বন্যা হয়েছে। কয়েক দিন উজানের ঢলে বিপর্যস্ত সিলেট।
উজানে বৃষ্টি না থামলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। দিন দিন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ। পানিতে ভাসছে নগর, গ্রামগঞ্জের বাসা-বাড়ি, হাট-বাজার। একতলা বিশিষ্ট অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরেও বন্যার পানি উঠে গেছে। এছাড়াও ডুবে গেছে ৫৩৬ কিলোমিটার সড়ক।
পাহাড়ি ঢল আর টানা ভারি বর্ষণে নগরসহ জেলার অন্তত ১০টি উপজেলার নিম্নঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারে সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পানিতে তলিয়ে যাওয়া বাসা-বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে মানুষ। সেখানে গিয়েও পানিবন্দি অবস্থায় দিন কাটছে তাদের।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, অনেক আশ্রয়কেন্দ্রের নিচতলায় পানি উঠেছে। আর একতলা আশ্রয়কেন্দ্রগুলো থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে পানিবন্দি থাকায় জরুরী প্রয়োজনে নৌকা ব্যবহার করে অন্যত্র ঝুঁকি নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হচ্ছে।
সময় যত গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে বানবাসী মানুষের সংখ্যা। বিভিন্ন উপজেলায় কয়েক লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন সড়ক ডুবে গিয়ে উপজেলা ও জেলা সদরের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাটবাজার ও সরকারি দফতরগুলোতে উঠেছে পানি। বন্যাকবলিত হয়ে পড়া সিলেট নগরের আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গ্রামীণ এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্থানীয় অনেকে জানান, গত দুই দিনে পানি বৃদ্ধি পেয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে না পারা মানুষজন ঘরেই অবস্থান করছে। ঘরের চৌকির নিচে পানি আসায় সন্তানদের নিয়ে খাটের উপরে অবস্থান করতে দেখা গেছে অনেককে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুসিকান্ত হাজং বলেন, উপজেলার ৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। মোট ৪৬ হাজার ৫০০ বানভাসি মানুষ রয়েছে এ উপজেলায়। তাদের জন্য ১২ টন চাল, ৫০০ প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। আরো দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার এবং চার লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের চিড়া ও গুড় বিতরণ করা হবে। ৪০ হাজার পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ছয়টি মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ তাহমিলুর রহমান বলেন, বন্যা পরিস্থিতির কারণে উপজেলায় ৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র করা হয়েছে। এ যাবৎ সাড়ে ৩০০ জন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। এখানে মানুষের সংখ্যা ৬৯ হাজার নির্ণয় করা হয়েছে। এসব মানুষের জন্য আগে ২৪ টন চাল ও নতুন করে আরো পাঁচ টন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। উপজেলায় মানুষের চিকিৎসায় ১০টি মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে।
জকিগঞ্জর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার (ভূমি) পল্লব হোম দাস বলেন, উপজেলায় ১৫ থেকে ২০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলায় ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ যাবৎ ১২টি পরিবার আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। অন্যরা স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। এরই মধ্যে দুর্গতদের জন্য বরাদ্দকৃত ১৮ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আর শুকনো খবার দিতে নগদ এক লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। আরো তিন হাজার প্যাকেটের চাহিদা পাঠানো হয়েছে।
সিলেট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, জেলায় ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮টিতে মানুষ অবস্থান করছে। এছাড়া বন্যার্তদের জন্য এ যাবৎ ১৪৯ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর সাথে এক হাজার বস্তা শুকনো খাবারও বরাদ্দ করা হয়েছে।
ডুবে গেছে ৫৩৬ কিলোমিটার সড়ক, পানিতে ভাসছে নগর থেকে গ্রামগঞ্জের বাড়ি-ঘর, হাটবাজার। রাস্তাঘাট ডুবে গিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। অনেক এলাকার সাথে জেলা ও উপজেলা সদরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সিলেটের সড়ক ও জনপথ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের প্রায় ৫৩৬ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে সিলেট সিটি করপোরেশন এলাকায় প্রায় আড়াই শ' কিলোমিটার, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের ২৩০ কিলোমিটার এবং সড়ক ও জনপথের (সওজ) আওতাধীন আটটি সড়কে ৫৫ কিলোমিটার বন্যা প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে অনেক সড়কে যানবাহন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) প্রধান প্রকৌশলী মোঃ নুর আজিজুর রহমান বলেন, সিসিক এলাকার ৫০০ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে ২৭টি ওয়ার্ডের ১৪টি ওয়ার্ডে প্রায় আড়াই শ' কিলোমিটার সড়কে বন্যার পানি উঠে গেছে। এসব সড়কের অনেক স্থানে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের আওতাধীন সিলেট জেলার ১০টি উপজেলার ৬৬টি সড়কে ২৩০ কিলোমিটার পানিতে তলিয়ে জেলা ও উপজেলা সড়কের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে।
অধিদফতরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ এনামুল কবীর এই তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, টাকার অংকে পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরিমাণ ১৭২ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
তিনি বলেন, বন্যা কবলিত জেলার গোয়াইনঘাটে ২৭টি সড়কে ৮২ দশমিক ১৩ কিলোমিটার, কানাইঘাটে ১৫টি সড়কে ৩০ দশমিক ৫ কিলোমিটার, জৈন্তাপুর উপজেলার ১১টি সড়কের ৩২ দশমিক ০১ কিলোমিটার, সিলেট সদরের ১২টি সড়কে ২১ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার, গোলাপগঞ্জে ১০টি সড়কে ২২ দশমিক ০৩ কিলোমিটার, কোম্পানীগঞ্জে চারটি সড়কে ৩৪ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার, দক্ষিণ সুরমার চারটি সড়কে সাড়ে তিন কিলোমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জে একটি সড়কের দেড় কিলোমিটার, ওসমানীনগর উপজেলায় একটি সড়কের প্রায় দেড় কিলোমিটার, বালাগঞ্জে একটি সড়কে দেড় কিলোমিটার।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মুস্তফিকুর রহমান বলেন, সারি-গোয়াইনঘাট দুই থেকে ১৬ কিলোমিটার পর্যন্ত ১২ দশমিক ৪০০ কিলোমিটার সড়ক এক থেকে সাড়ে চার ফুট উচ্চতায় পানির নিচে তলিয়ে যানবাহন চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। সিলেট-তামাবিল-জাফলং সড়ক এক দশমিক ২০ কিলোমিটার এক থেকে তিন ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। কানাইঘাটের দরবস্ত-কানাইঘাট-শাহবাগ সড়ক সাত থেকে ২৪ কিলোমিটার পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এক থেকে চার ফুট পানিতে তলিয়ে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক তিন থেকে পাঁচ এবং থেকে ১৩ কিলোমিটার পর্যন্ত ছয় দশমিক ৫০ কিলোমিটারে এক থেকে দুই ফুট পানি উঠেছে। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রশিদপুর-লামাকাজি সড়ক ১৫ থেকে ১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত দুই দশমিক ৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত দুই থেকে তিন ফুট পানির নিচে তলিয়েছে। কোম্পানীগঞ্জ-ছাতক সড়ক এক থেকে ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত ১০ দশমিক ২৫ পর্যন্ত ১০ দশমিক ২৫ কিলোমিটারে এক থেকে পাঁচ ফুট উচ্চতায় পানিতে তলিয়ে গিয়ে যান চলাবল বন্ধ রয়েছে। শেওলা সুতারকান্দি সড়কে এক থেকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে দুই দশমিক ২৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পাঁচ থেকে এক ফুট পর্যন্ত পানি উঠে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিমানবন্দর-বাদাঘাট-কুমারগাঁও (টুকেরবাজার) সড়কে পাঁচ থেকে নয়, ১১ ও ১২ কিলোমিটারের মধ্যে এক থেকে সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত পানি উঠে যান চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে।