ঈশ্বরদীর লিচু বাগান থেকে ৩০ টন মধু সংগ্রহের সম্ভাবনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৫৯ পিএম, ১৭ মার্চ,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ১০:৩৪ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
সবুজ পাতার মধ্যে স্বর্ণালী লিচুর মুকুলে ভরে উঠেছে লিচুর রাজধানী খ্যাত পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লিচু গাছগুলো। চারিদিকে লিচুর ফুল আর মুকুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর লিচু গাছে ফুল ও মুকুলের পরিমাণ অনেক বেশি। লিচুর মুকুল যেন ঝড়ে না পড়ে, মুকুল টেকাতে পরিচর্যায় কোনো ঘাটতি রাখছেন না চাষিরা।
এদিকে লিচু বাগানগুলো জুড়ে স্থাপিত হয়েছে হাজারো মৌ বাক্স। সারি সারি সাজানো ঘর আকৃতির কাঠের তৈরি ছোট ছোট বাক্স। লিচু ফুল থেকে মধু আহরণের পর মৌমাছি ছুঁটছে আপন নীড়ে। মৌয়ালরা, এক সপ্তাহ পর শুধুমাত্র ঈশ্বরদী উপজেলায় লিচু ফুল থেকে ২৬ হাজার কেজি (২৬০ কুইন্টাল-এক কুইন্টালে ১০০ কেজি, এখানে কেজি হিসেবে বিক্রি হয়) মধু বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে সংগ্রহ করে মৌয়ালরা।
চৈত্রের শুরুতে লিচুর গুটি আসা শুরু না হওয়া পর্যন্ত লিচু ফুল থেকে মৌমাছির মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করবেন মৌয়ালরা। এই মধু যাবে সারা দেশে। ঈশ্বরদী উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের লিচু বাগানগুলো ঘুরে এ তথ্যই জানা গেছে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ঈশ্বরদী পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নর বিভিন্ন গ্রামে ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচু বাগান রয়েছে ১১ হাজার ২৫৮টি। মধু সংগ্রহের জন্য মৌয়ালরা মৌ বাক্স স্থাপন করেছেন ৬ হাজার ৫০০টি। ঈশ্বরদী উপজেলায় বর্তমানে তিন প্রজাতির লিচুর ফলন হচ্ছে। মোজাফ্ফর বা দেশি এবং বোম্বাই আর লিচু চায়না-৩। এ বছর ঈশ্বরদী উপজেলায় মধু সংগ্রহ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৬ হাজার কেজি।
কয়েকটি বাগান ঘুরে দেখা গেছে, বসন্তের শেষ সময়ে ঈশ্বরদী উপজেলা বিভিন্ন ইউনিয়নে যতদূর চোখ যায়, মাঠের পর মাঠ, সবুজ পাতার মধ্যে সোনারঙা ফুল আর মুকুলে ছেয়ে গেছে লিচু বাগানগুলো। লিচু গাছের নিচে থরে থরে মৌ বাক্স সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রতিটি মৌ বাক্সে হাজারো মৌমাছির গুঞ্জন। কৃষকের পরিচর্যার সাথে মৌয়ালদের ব্যবস্তা বেড়েছে। ফাল্গুনের শুরুতে লিচু গাছের মুকুল আসতে শুরু হয়েছে। চৈত্রের শুরুতে লিচুর মুকুল গুটিতে পরিণত হবে। গুটি আসার আগ পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করবেন মৌয়ালরা (বাণিজ্যিকভাবে মৌমাছি দিয়ে মধু সংগ্রহকারী)। প্রতিটি লিচু বাগানে দেড়শ’টি করে বাক্স রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে আসা মৌয়ালরা একটি বাক্স থেকে কমপক্ষে পাঁচ কেজি মধু সংগ্রহ করে। প্রতি কেজি মধু ৩০০ টাকা দরে পাইকারি বিক্রি করেন তারা।
টাঙ্গাইলের থেকে মধু সংগ্রহ করতে ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী ইউনিয়নের রূপপুর গ্রামে আসা হাফিজুল ইসলাম হাফিজ বলেন, আমরা ফাল্গুন মাসের শেষে আসি, চৈত্র মাসের শুরুতে আবার মধু সংগ্রহ করে চলে যাই। একটি লিচু বাগানে দুইশ’ বাক্স রেখেছি। মৌমাছিরা ঝাঁক বেঁধে লিচুর মুকুল থেকে মধু সংগ্রহ করে নিজ নিজ বাক্সের ভেতরে এসে মধু জমা করে।
ময়মনসিংহ থেকে আসা আব্দুল হাই বলেন, প্রতিবছর আমরা মধু সংগ্রহ করতে আসি। সেরা বাগান থেকে আমরা মধু সংগ্রহ করি। যে বাগানে ফুল বেশি, তেমন বাগানে বাক্স বসাই। মৌমাছির চাকগুলোর বাক্স প্রথমে বাগানে রেখে দেওয়া হয়। প্রতিটি লিচুর বাগানে দেড়শ’ বাক্স রাখা রয়েছে। লিচুর ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করার পর মৌমাছিরা বাক্সের ভেতরে চাকে মধু জমা করে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি বাক্সে পাঁচ কেজি মধু জমা হয়। চাক থেকে মধু সংগ্রহ করে আমরা বিভিন্ন কোম্পানির কাছে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করি।
রূপপুর গ্রামের লিচু চাষি পলাশ আহম্মেদ জানান, ফাল্গুনের শুরুতে গাছে লিচুর মুকুল আসতে শুরু করে। চৈত্রের শুরুতে মুকুল থেকে মটরদানার মতো গুটি বের হয়। গুটি বের হলে ভালো ফলনের জন্য কীটনাশক স্প্রে করতে হয়। তবে লিচুর মুকুল থেকে মৌমাছিরা যদি মধু সংগ্রহ করে, তাতে পরাগায়ন হলে লিচুর ভালো ফলন হয়। ফলে কীটনাশক তেমন দরকার হয়। তাই বিনামূল্যেই মৌয়ালদের মৌমাছির বাক্স বসাতে দিই বাগানে।
ঈশ্বরদী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, কৃষিবিদ মিতা সরকার জানান, ফাল্গুনের শেষ সময়ে লিচু ফুল থেকে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করেন। লিচু ফুল ও মুকুলে মৌমাছি বসলে পরাগায়ন ভালো হয়, রোগবালাইও অনেকটা কম হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক বাগানে গুটি আসার পর কীটনাশক দরকার হয় না। এতে ওই লিচুর বাগানে বাম্পার ফলন হওয়ার অনেক সম্ভাবনা থাকে। এতে লিচুর যেমন বাম্পার ফলন হয়, তেমনি মধুও উৎপাদন হয় ভালো।
কৃষিবিদ মিতা সরকার বলেন, এ মৌসুমে ঈশ্বরদী উপজেলায় ৩ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ করছেন চাষিরা। লিচু বাগানে সাড়ে ৬ হাজার মৌবাক্স স্থাপন করেছেন মৌয়ালরা। তারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এসে মধু সংগ্রহ করছেন। প্রতিটি বাক্সের ১০টি ফ্রেমে অর্ধলক্ষাধিক মৌমাছির উপস্থিতি রয়েছে। সপ্তাহে প্রতিটি বাক্স থেকে গড়ে চার কেজি করে মধু সংগ্রহের চেষ্টা করছেন মৌয়ালরা। আশা করছি,এতে এবার ২ হাজার ৬০০ কেজি মধু পাওয়া যাবে।