মুসাকে দিয়ে স্ত্রী মিতুকে হত্যা করান এসপি বাবুল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৪ পিএম, ২৪ অক্টোবর,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:৫৪ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের নির্দেশেই তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল। মিতুকে হত্যা না করলে না করলে কামরুল শিকদার ওরফে মুছাকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার ভয় দেখান বাবুল আক্তার। মিতুকে হত্যা করার জন্য মুছাকে টাকাও দিয়েছিলেন বাবুল আক্তার।
গতকাল শনিবার (২৩ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানান মিতু হত্যা মামলার আসামি এহতেশামুল হক ভোলা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. শফি উদ্দিনের আদালতে তিনি বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জবানবন্দি দেন।
চট্টগ্রামের পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘গ্রেফতারের পর ভোলাকে আদালতে তোলা হলে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এরপর আদালত তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন।’ বেনাপোল থেকে ভোলাকে গ্রেফতার করে শনিবার চট্টগ্রাম নিয়ে আসা হয়।
মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পিবিআইয়ের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘মিতু হত্যার ঘটনায় তার বাবার দায়ের করা মামলার অন্যতম আসামি ভোলা। তাকে শুক্রবার রাতে বেনাপোল এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দীতে ভোলা জানিয়েছেন যে তিনি রাজাখালী এলাকায় বালু, মুরগির খাবার, চালকল, লাকড়ির মিল ও চা পাতাসহ বিভিন্ন ব্যবসা করতেন। ২০০৮ সালে বাবুল আক্তার এসি (কোতোয়ালী) হিসেবে চট্টগ্রামে যোগদানের পর পলাতক আসামি কামরুল ইসলাম শিকদার মুছার মাধ্যমে বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মুছার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল ভোলার। এছাড়া মুছা আগে থেকেই বাবুল আক্তারের সোর্স হিসেবে কাজ করতেন।
জবানবন্দিতে এহতেশাম ভোলা জানায়, তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা থাকার বিষয়ে বাবুল আক্তারকে জানালে ব্যবস্থা নেন। এরপর থেকে তিনি বাবুলকে বিভিন্ন তথ্য দিতেন। ডবলমুরিং থানা এলাকার একটি বিষয়ে বাবুলকে তথ্য দেন। ওই তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্রসহ এক আসামিকে ধরে বাবুল বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। পরে বাবুল আক্তার কোতোয়ালী জোন থেকে বদলি হয়ে গেলে ভোলার সঙ্গে যোগাযোগ কমে যায়। পরে আবার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে সিএমপিতে আসেন বাবুল আক্তার। তখন বাবুলের নির্দেশে মুছাকে বালুর ব্যবসায় ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেন ভোলা।
এহতেশাম ভোলা আরও বলেন, ‘মুছা ম্যানেজার হিসেবে কাজ করলেও প্রায় সময় বাবুলের সঙ্গে কাজে ব্যস্ত থাকত। এই মামলার আসামি ওয়াসিমকেও কয়েকবার মুছার সঙ্গে চলাফেরা করতে দেখেছি। এর কয়েক বছর পর একদিন মুছা আমাকে বলেন, বাবুল আক্তারের সঙ্গে তার স্ত্রীর পারিবারিক ঝামেলা চলছে। তার স্ত্রীকে শেষ করার দায়িত্ব দিয়েছেন আমাকে।’
জবানবন্দিতে এহতেশামুল হক ভোলা বলেন, ‘আমি মুছাকে বলি, বাবুলের পারিবারিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। মুছা আমার কথায় নাখোশ হয়ে বাবুলকে বলে দেয়। পরে বাবুল আমাকে জিইসি মোড়ে ডেকে নিয়ে বলেন, মুছাকে তিনি (বাবুল) একটা কাজ দিয়েছি, সাহায্য করতে না পারলেও যেন বাধা না দেই। বাধা দিলে পরিণতি ভাল হবে না।’
এহতেশাম ভোলা আদালতকে বলেন, ‘মুছা আমাকে জানায়, বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে খুন করতে হবে। আমি যেন অস্ত্র সংগ্রহ করে দেই। কয়েকদিন পরে বাবুল আক্তারের টাকায় অস্ত্র কেনে মুছা। এরপর মিতু হত্যার দিন ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়। আমি ফোন ধরিনি। ওই দিন বেলা ১১টার দিকে টিভির হেডলাইনে বাবুল আক্তারের স্ত্রীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে মুছাকে ফোন করলে তার মোবাইল বন্ধ পাই।’
জবানবন্দিতে ভোলা বলেন, ‘পরে বিকেলে মুছা অফিসে এলে মিতু খুনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করি। তখন মুছা জানায় যে, কাজটা না করে তার উপায় ছিল না। বাবুল বলছে, কাজটা না করলে মুছাকে ক্রসফায়ারে দেবে। এ কাজ করার জন্য মুছাকে টাকাও দিয়েছে বাবুল। পরে মুছা একটা কাপড়ের ব্যাগ ভোলার কাছে দিয়ে সেটা মনিরকে দিতে বলে চলে যায়। এরপর মনিরের কাছে রাখা ব্যাগ থেকে পুলিশ একটি অস্ত্র উদ্ধার করে। পরে জানতে পারি, এই অস্ত্র দিয়েই মুছা ও তার সহযোগীরা বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যা করেছে।’
মুছাকে খোঁজার বিষয়ে এহতেশাম ভোলা বলেন, ‘মুছাকে না পেয়ে তার স্ত্রী পান্না আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তখন পান্না জানায়, মুছা অনেকদিন ধরে নিখোঁজ। বাবুল তার স্ত্রী হত্যাকাণ্ডের পর মুছাকে ফোন করেছিল। মুছা বাড়ির বাইরে থাকায় পান্না ফোন ধরলে বাবুল মুছার খোঁজ করে। মুছাকে সাবধানে থাকতে বলে। পরে বাবুল আবার ফোন করলে মুছা নিজেই ফোন ধরে। কথা বলার সময় বাবুলের সঙ্গে ক্ষেপে গিয়ে মুছা বলেছিল যে, যদি তার ও তার পরিবারের কোনো ক্ষতি হয় তাহলে এ বিষয়ে সে পুলিশের কাছে মুখ খুলবে। এরপর থেকেই মুছা নিখোঁজ হয়ে যায়।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে চট্টগ্রাম নগরের নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে দুর্বৃত্তদের গুলি ও ছুরিকাঘাতে খুন হন মাহমুদা খানম (মিতু)। ওই সময় এ ঘটনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার সময় মিতুর স্বামী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার অবস্থান করছিলেন ঢাকায়। ঘটনার পর চট্টগ্রামে ফিরে বাবুল আক্তার পাঁচলাইশ থানায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
জঙ্গিবিরোধী কার্যক্রমের জন্য স্ত্রীকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে মামলায় অভিযোগ করেন তিনি। তবে দিন যত গড়িয়েছে মামলার গতিপথও পাল্টেছে। এক পর্যায়ে সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে স্বামী বাবুল আক্তারের নাম। তদন্তে তার বিরুদ্ধেই হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত ১১ মে তাকে হেফাজতে নেয় পিবিআই।
পরে ১২ মে বাবুল আক্তারসহ আটজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়। স্ত্রী মাহমুদা খানম (মিতু) হত্যা মামলার প্রধান আসামি বাবুল আক্তারকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পিবিআই। রিমান্ড শেষে প্রথমে আদালতে জবানবন্দি দেওয়ার কথা থাকলেও পরে জবানবন্দি দেননি বাবুল। তারপর তাকে চট্টগ্রাম কারাগারে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম কারাগার থেকে তাকে ফেনী কারাগারে পাঠানো হয়। বর্তমানে বাবুল আক্তার ফেনী কারাগারেই আছেন।
মাহমুদা হত্যাকাণ্ডের পর ২০১৬ সালের ২৭ জুন অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন এহতেশামুল হক। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এদিকে মাহমুদার বাবার করা মামলায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের অন্তর্বর্তী জামিন পান এহতেশামুল হক। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আত্মসমর্পণের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে সময়ের আবেদন করেন তিনি। ১৪ অক্টোবর আদালত সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ জুলাই আদালত এহতেশামুলসহ তিন আসামির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। অন্য দুজন হলেন কামরুল শিকদার ওরফে মুছা ও মো. কালু।