আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে নরসুন্দর পেশা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬:৩৬ পিএম, ৩০ আগস্ট,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:১০ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
মানুষ মাত্রই সৌন্দর্য পিয়াসী। আর এই সৌন্দর্যের অন্যতম উপকরণ হলো চুল। চুল নিয়ে মানুষের ভাবনার যেন অন্ত নেই। মানুষের জীবনে চুল-দাড়ি কাটা-ছাটা, সেভ করা প্রতিদিন প্রয়োজনীয় কাজের একটি অংশ। সে কারণেই কেশবিন্যাসের কারিগর নাপিতের প্রয়োজনীয়তা।
আগে হাট-বাজারের বট বৃক্ষের ছায়ায়, খেয়াঘাটে, ফুটপাতে কিংবা গ্রামগঞ্জের রাস্তাঘাটে ইটের ওপর সাজানো পিঁড়িতে বসে নাপিতরা গ্রামবাংলার মানুষের চুল-দাড়ি কামিয়ে দিতো। সেই আদি পরিচিত দৃশ্য এখন সচরাচর চোখে পড়ে না। কারণ আধুনিক সভ্যতার ক্রমবির্বতনে কেশ কারিগরদের গতিধারায় লেগেছে নতুনত্বের ছোঁয়া।
যাদের শৈশব কেটেছে গ্রামে তাদের স্মৃতিতে আজও চোখের সামনে ভাসে সে স্মৃতিময় দিনগুলো। তবে এখনও গ্রামের কিছু হাট-বাজারে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। যদিও তা খুবই কদাচিৎ। যাকে আমরা বলি নরসুন্দর বা নাপিত। বংশ পরম্পরায় তারা এ পেশাকে ধারণ করে চলেছে যুগ যুগান্তরে। নাপিত বা নরসুন্দর এমন এক শ্রেণীর পেশা যারা পুরোনো কায়দায় রাস্তার পাশে আয়না ঝুলিয়ে বিভিন্ন ভাবে মানুষের চুল ছাঁটেন এবং দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে থাকেন।
নরসুন্দর সর্বত্রই বিরাজমান ছিলো, এদের সামাজিক অবস্থান মিশ্র ধরনের। বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের লোকজন এ পেশায় সম্পৃক্ত থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এরা নরসুন্দর সম্প্রদায়ভুক্ত। গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজারে গেলে এখনও কোথাও কোথাও চোখে পড়ে চিরচেনা সেই দৃশ্য। রাস্তার পাশে, হাটে-ঘাটে জলচৌকিতে বসিয়ে ও কাঠের বক্সে বসে ক্ষুর, কাঁচি, চিরুনি, সাবান, ফিটকারি, পাউডার ও নিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষকে সুন্দর করার কাজ করে যাচ্ছেন এসব নরসুন্দর বা নাপিতরা।
গ্রামের বাজারে নাপিতদের নির্দিষ্ট স্থানে বা দোকানে লোকেরা তাদের চুল কাটা, ছাঁটা, এবং ছোটখাট কাটাছেঁড়ার কাজ করতো। এসব সেবা প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো নাপিতরা। এই উপার্জনের অর্থ হতে পারে, আবার কোন দ্রব্যসামগ্রীও হতে পারে। আগেকার দিনে নাপিতদেরকে কাজের বিনিময়ে সাধারণত দ্রব্যসামগ্রী দেওয়া হতো। বর্তমানে চুল-দাড়ি কাটার সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতিতেও পরিবর্তন হয়েছে। ছোঁয়া লেগেছে আধুনিকতার।
সেলুনে এখন আর শান দেয়া ক্ষুর দেখাই যায় না। তার বদলে এসেছে ব্লেড লাগানো ক্ষুর। এসেছে শেভিং ক্রিম, লোশন, চুলের কলপ ও বিভিন্ন রকমের কালার। আগে এগুলো ছিল কল্পনার অতীত। দৈনন্দিন গ্রামীণ জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ আনুষঙ্গিক বিষয়ের মধ্যে চুল কাটা-ছাটা, সেভ ইত্যাদি কাজে দীর্ঘকাল ধরে নিয়োজিত নরসুন্দর বা নাপিতদের বর্তমানে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগেকার দিনে তাদের আয় দিয়ে সংসার ভালোভাবে চললেও এখন তারা আর্থিক সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। তাই দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম পেশা নরসুন্দর বা নাপিত।
দামুড়হুদা দশমীপাড়ার নরসুন্দর মনিরুল ইসলাম জানান, মানুষ আমাদের কাছে বসতে চায় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবাই উচ্চাভিলাষী হয়ে গেছে। গদির চেয়ারে বসে চুল কাটতে আধুনিক সেলুনে যায়। আমাদের কাছে আর কাঠের টুলে বসে চুল-দাঁড়ি কামাতে চাই না।
দৈউলী গ্রামের নরসুন্দর আঃ রাজ্জাক জানান, দিন দিন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে সর্বত্র। তেমনি আমাদের পেশায় ও। এখন মানুষ আর কাঠের চেয়ার বা টুলে বসে চুল, দাঁড়ি কাটতে চাই না। শহরের বাজারে দোকান ভাড়া নিয়ে দোকান করার সাধ্য না থাকায় অনেকে এখন পেশা বদলে ফেলেছে।
আগের দিনে বিয়ে বাড়ি চুল কাটতে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া হতো, বেশ ভালো লাগতো। সেখানে বেশ কিছু টাকা বকশিস ও পাওয়া যেতো। এখন আর বিয়ে বাড়িতে চুল কাটানোর জন্য কোনো নাপিত কে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে ডাকা হয় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় দিন দিন সেসব পুরনো ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে।