চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে কচুরিপানার জ্যাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:১৩ পিএম, ৭ জুলাই,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:৩৭ এএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ডাকাতিয়া নদীতে দীর্ঘ বছর থেকে কচুরিপানার জ্যাম লেগেইে আছে। এতে করে নদীন পানি বিনষ্ট হয়ে মাছ মরে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে মারাত্বক আকারে। কোথাও কোথাও কচুরিপানার জট এতটাই চাপা যে, অনায়াসে এর উপর দিয়ে হেঁটে নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার উপর জন্মেছে পরগাছা।
ডাকাতিয়া নদীর উপর ভর করে এ উপজেলার কয়েক হাজার জেলে পরিবার বেঁচে আছে। কচুরিপানার ভয়াবহ জ্যামে দূষিত পানিতে দেশিয় প্রজাতির মাছ ক্রমাম্বয়ে বিলুপ্ত হওয়ায় জেলেদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। এ ডাকাতিয়া নদীর সুস্বাদু মাছের চাহিদা ছিল দেশের সর্বত্র।
ডাকাতিয়ায় এক সময় দেশিয় প্রজাতির বিশেষ করে পাবদা, সরপুটি, বোয়াল, শিং, মাগুর,কই, শইল, ফইলা, চিতল মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতের প্রচুর পরিমানে আহরন করতেন জেলে পরিবার ও এ উপজেলার মানুষেরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হতো ডাকাতিয়া নদীটির সুস্বাদু মাছ।
খোজ নিয়ে জানা গেছে এক সময়ের নামকরা ডাকাতিয়া আজ মরা ডাকাতিয়া নদীতে পরিণত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, হাইমচর, লক্ষ্মীপুর জেলার লক্ষ্মীপুর সদর, রামগঞ্জ এবং রায়পুরের কিয়দংশ নিয়ে প্রায় ১শ’ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে শুরু হওয়া ৫৭ হাজার হেক্টর জমিকে বন্যামুক্ত রেখে বছরে একাধিক ফসল ও মাছ উৎপাদনের জন্য চাঁদপুর সেচ প্রকল্প নামে ওই সময়ে ৫৪.৩০ কোটি ব্যয়ে প্রকল্পটি ১৯৭৮ সালে সম্পন্ন হয়।
এরপর বস্তুত প্রমত্তা ডাকাতিয়া তার গতি ও স্রোত হারিয়ে ফেলে। কালের বিবর্তনে ফরিদগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাকাতিয়া দখল, নব্যতা সঙ্কট এবং কচুরিপানা জটের কারণে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় পৌঁছেছে। এর সাথে গত এক দশক ধরে নদী থেকে ইচ্ছে মতো অবৈধ ড্রেজিং ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে কিছু কিছু লোক লখোপতি হয়ে গেলেও ডাকাতিয়া নদী ক্রমশঃ খালে পরিণত হয়েছে।
শুস্ক মৌসুমে এটি প্রায় পানি শূন্য ও কচুরিপানার কারণে দুর্গন্ধ ও ব্যবহার উপযোগী হয়ে পড়ায় এই নদীর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১০ হাজার জেলে পরিবারকে অনেকটা বেকার জীবন কাটাতে হয়। এসব দুরাবস্থার কারণে ইতিমধ্যেই জেলে পরিবারের সদস্যরা তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে এবং এর সাথে সংযুক্ত খাল সমূহে সেচ প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত পানি যেতে না পারায় প্রতি বছরই উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সেচের পানির জন্য কৃষকরা ফসল ফলাতে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে।
চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বাঁধ তৈরির পর বছরে স্থান ভেদে তিনটি ফসল কৃষকরা ঘরে তোলার পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছে মৎস্য খামার। গত ৪ দশকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা খাদ্যে স্বয়ং সম্পন্ন হওয়ার সাথে মাছে উৎপাদন করে আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিঃস্ব থেকে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেক মৎস্যজীবী। বর্তমানে ফরিদগঞ্জে কোটি কোটি টাকার মাছের চাষ হচ্ছে।
এসব কিছুই মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায় ডাকাতিয়া নদীর কারণে। নাব্যতা সঙ্কটের কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানির পরিমাণ বাড়লেও দু’কুল উপচিয়ে তা পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেত ও মাছের প্রজেক্টগুলোতে প্রবেশ করায় প্রায় প্রতি বছরই মাছ চাষীদের লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে।
মৎসজীবি আবু পাটওয়ারীসহ বেশ কয়েক জনের সাথে ডাকাতিয়া নদীটির বিষয়ে কথা বলে জানা যায়, ডাকাতিয়া একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নদী। এ নদী ঘিরে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি। একসময় ডাকাতিয়া নদী তীব্র খরস্রোতা ছিল। মেঘনার এই শাখা নদী ডাকাতিয়ায় মেঘনার উত্তাল রূপ ফুটে উঠত। ফলে ডাকাতিয়ার করাল গ্রাসে নদীর দুই পাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাত। ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের সলিল সমাধিও ঘটেছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী বলেই এর নাম হয়েছে ডাকাতিয়া।
বিষয়টি নিয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা ডাকাতিয়া নদীরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নুর সাথে কথা হলে তিনি জানান, কচুরিপানা গো-খাদ্য ও ভালো সার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ডাকাতিয়া নদী দূষণমুক্ত রাখা, দেশিয় প্রজাতির মাছ রক্ষা এবং জেলেদের জীবিকা নির্বাহ অব্যাহত রাখতে কচুরিপানা পরিষ্কার করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।
বিষয়টি নিয়ে উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মোসা. ফারহানা আকতার রুমা জানান, ডাকাতিয়া নদীটির এমন চিত্র বহুদিন ধরে, কচুরিপানা সহ বিভিন্ন আবর্জনায় নদীটি যে সমস্যার সম্মুখিন হয়েছে। তার সমাধান করতে হলে বিশাল অর্থ বাজেটের প্রয়োজন। এছাড়া ডাকাতিয়া নদী রক্ষা কোন সমাধান আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলী হরি জানান, ডাকাতিয়া নদীর বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ, ফরিদগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস নেই, জেলাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবস্থা নিতে চাইলে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।