শাহজালাল বিমানবন্দর প্রবাসী কর্মীদের জন্য ৩০ কোটি টাকায় বিশ্রামাগার : দিনে ভাড়া ২০০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৩ পিএম, ১৮ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:০৮ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
প্রবাসী কর্মীদের বিদেশে যাওয়া-আসার প্রক্রিয়ায় বড় একটি সমস্যা ঢাকায় আবাসন। অনেকের যাওয়ার আগে ঢাকায় এসে থাকতে হয় কিংবা দেশে ফিরে থাকার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে বেশি খরচে হোটেলে ওঠা ছাড়া উপায় থাকে না। অনেকে বিমানবন্দর প্রাঙ্গণেই মশার কামড় খেয়ে রাত কাটান। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের সাময়িক আবাসনে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন ‘বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার’ নির্মাণ করেছে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। দিনে মাত্র দুইশ টাকা খরচ করে এখানে থাকতে পারেন প্রবাসী কর্মীরা। বিমানবন্দরে যাতায়াতও ফ্রি। কিন্তু উদ্বোধনের পর প্রচারণার অভাবে ফাঁকাই থাকছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ সেন্টার।
প্রবাসী কর্মীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ফ্লাইটের এক-দুদিন আগে অনেকে ঢাকায় আসেন। ওঠেন আশপাশের আবাসিক হোটেলে। যাদের সাধ্য নেই, তারা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে বসে মশার কামড় খান। কিন্তু প্রচারণার অভাবে তাদের কেউ বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারের খোঁজ জানেন না।
তবে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার চালুর পর পত্রপত্রিকা-টেলিভিশনে অনেক বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। প্রচার করা হয়েছে সেন্টারের সুযোগ-সুবিধার কথা। তারপরও আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। এখন পর্যন্ত সেন্টারের ৯৯ শতাংশ শয্যাই ফাঁকা থাকছে। তাই প্রচারের কাজটি আরও জোরদার করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন তারা।
জানতে চাইলে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও উন্নয়ন) মুশাররাত জেবীন বলেন, প্রবাসী কর্মীদের জন্য এই সেন্টারটি স্থাপন করা হয়েছে। এখানে অনেক কম মূল্যে তারা থাকতে এবং খেতে পারবেন। তবে প্রবাসীরা সেখানে কম যাচ্ছেন। এই সেন্টারের সেবা সম্পর্কে আরও প্রচারণা চালানো হবে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বিদেশগামী ও প্রবাসফেরত কর্মীদের সাময়িক আবাসন সুবিধাসহ বিভিন্ন সেবা দিতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সন্নিকটে ১৪০ কাঠা জমির ওপর ‘বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার’ স্থাপন করা হয়। গত ১৮ মার্চ এই সেন্টারের উদ্বোধন করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। এই সেন্টারে প্রবাসী কর্মীরা দিনে ২শ টাকা ভাড়ায় বিদেশে যাওয়ার সময় অথবা বিদেশ থেকে দেশে ফেরার সময়ে সাময়িকভাবে অবস্থান করতে পারবেন। সাশ্রয়ীমূল্যে খাবারের ব্যবস্থাও আছে। এখানে ৪০ জন পুরুষ ও ১০ জন নারীর থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সন্নিকটে বলা হলেও আদতে তা কাছে নয়। এটি বিমানবন্দর থেকে অন্তত ছয় কিলোমিটার দূরে খিলক্ষেতের বরুয়ার লঞ্জনীপাড়ায়। অনেকটা গ্রামীণ পরিবেশে সেন্টারটি নির্মাণ করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, নিরিবিলি সবুজ পরিবেশে প্রাচীর ঘেরা বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার। দেখতে অনেকটা রিসোর্টের মতো। সেখানে একটি দ্বিতল ভবনের নিচতলায় প্রবাসী কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। পরিপাটি প্রতি কক্ষে তিন-চারটি করে শয্যা। তবে কোনো প্রবাসী কর্মীকে সেখানে দেখা যায়নি। ক্যান্টিনও দেখা গেছে বন্ধ। সেন্টারে সামনে বসে গল্প করার জন্য রয়েছে সবুজ মাঠ। যার চারপাশে রয়েছে দেশি-বিদেশি প্রজাতির অসংখ্য ফল-ফুল গাছ। এমন পরিবেশ যে কারও প্রশান্তি দেবে। ভবনের নিচতলায় অভ্যর্থনা কক্ষ। এখানে কাতারগামী প্রবাসী সনাতনকে পাওয়া যায়। গত ১৩ নভেম্বর তার কাতার যাওয়ার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু ফ্লাইট মিস হওয়ার কারণে দুদিন ধরে তিনি এই সেন্টারে অবস্থান করছেন। মঙ্গলবার রাতের ফ্লাইটে ফের টিকিট কিনেছেন।
আলাপকালে সনাতন জানান, তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে। ১৩ নভেম্বর রাতে তার ফ্লাইট ছিল। কিন্তু যথাসময়ে তিনি বিমানবন্দরে উপস্থিত হতে পারেননি। তার এক পরিচিতজনের কাছ থেকেই সেন্টারের খোঁজ পেয়েছেন। এখানে সেবার মানে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন তিনি। এই সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক হাবিবুল্লাহ বাহার। ১৫ নভেম্বর তিনি কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন। তার দায়িত্ব পালন করছিলেন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-সহকারী পরিচালক মো. আনিসুজ্জামান।
তিনি জানান, এই সেন্টারে গত আট মাসে প্রায় ২শ জন প্রবাসী অবস্থান করেছেন। চলতি মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত প্রবাসী সনাতনসহ ২০ জন ছিলেন।
তিনি বলেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে এই সেন্টারে থাকার জন্য দেশ-বিদেশের অনেক প্রবাসী নির্ধারিত ফোন নম্বরে কল দিচ্ছেন। সেন্টারের সেবা ও পরিবেশ সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছেন। আশা করি সামনের দিনগুলোতে এই সেন্টারে প্রবাসীদের চাপ বাড়বে। তবে মঙ্গলবার দুপুরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল-১ ও টার্মিনাল-২ এর নিচতলা ও দ্বিতীয় তলায় ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। এই দুটি টার্মিনালের নিচতলা দিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখেন প্রবাসফেরত কর্মীরা। আর দ্বিতীয় তলা দিয়ে প্রবাসে যান। কিন্তু তাদের কেউ বঙ্গবন্দু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারের খোঁজ জানেন না। শত শত প্রবাসী শ্রমিককে টার্মিনাল দুটির সামনে মালামাল নিয়ে অবস্থান করতে দেখা গেছে। গত ১৪ নভেম্বর রংপুর থেকে রাত ৩টায় শাহজালাল বিমানবন্দরের টার্মিনাল-২ এর দ্বিতীয় তলায় পৌঁছান ওমান প্রবাসী মারুফ হোসেন। ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টায় তার ফ্লাইট। এই ফ্লাইট মিস হওয়ার আশঙ্কা আগেভাগেই তিনি বিমানবন্দরে চলে যান।
আলাপকালে মারুফ হোসেন বলেন, বিমানবন্দরের আশপাশের হোটেলে ভাড়া বেশি। তাই টার্মিনালের সামনে বেঞ্চে বসেই সময় পার করছি। তাকে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারের কথা জানালে তিনি এই সেন্টার বিষয়ে অবগত নন বলে জানান।
এসময় পাশে থাকা আরেক ওমানগামী প্রবাসী মো. হাসান বলেন, সরকার প্রবাসীদের কাছে শুধু রেমিট্যান্স চায়। কিন্তু তাদের জন্য ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা দিতে চায় না। এখন বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার যদি নির্মাণ করেও থাকে, তা প্রচারে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারে শুধু আবাসন নয়, এখানে প্রবাসী কর্মীদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও রয়েছে। এই সুযোগ-সুবিধাগুলোর মধ্যে বিদেশগামী ও ফেরত প্রবাসী কর্মীরা একশ টাকা ফি দিয়ে সরাসরি বা অনলাইনে ভর্তির আবেদন করতে পারবেন। একজন কর্মী আবেদন করতে পারবেন একটি সিটের জন্য। প্রতি রাতের জন্য সিট ভাড়া ২শ টাকা এবং প্রতিবার সর্বোচ্চ দুই রাত অবস্থান করা যাবে। অবস্থানের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট ও এয়ার টিকিটের কপিসহ লাগবে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। বিমানবন্দর থেকে সেন্টারে যাতায়াতের জন্য ফ্রি পরিবহন সুবিধা রয়েছে। সেফ লকারে লাগেজসহ মূল্যবান মালামাল সংরক্ষণের ব্যবস্থা, টেলিফোন সুবিধা, ইন্টারনেট ব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেন্টারটিতে। এছাড়া কর্মীদের জন্য কাউন্সিলিং ও মোটিভেশনের ব্যবস্থা, প্রাথমিক চিকিৎসা, প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থাসহ সাশ্রয়ী মূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে এই সেন্টারে। নারী-পুরুষের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থাও এখানে রয়েছে। এখানে প্রবাসী কর্মীদের রি-ইন্টিগ্রেশন (পুনঃএকত্রীকরণ) এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বা করণীয় সম্পর্কে ব্রিফিং করা হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারটি প্রবাসী কর্মীদের একত্রিত হওয়ার এবং পারস্পরিক অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য একটি উপযুক্ত স্থান, যা দেশে এই প্রথম। ১০০ টাকা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারে সরাসরি বা অনলাইনে বুক করার সুযোগ রয়েছে। অনলাইনে বুকিংয়ের জন্য ০১৩১০৩৫০৫৫৫, ০১৭৫৪৭১৫৭২০ নম্বরে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা যাবে। এ ছাড়া www.wewb.gov.bd ওয়েবসাইটে সেন্টারের ব্যবহার নির্দেশিকা পাওয়া যাবে। সম্প্রতি বিমানবন্দর সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে বিআরটিএ প্রকল্পের কাজের জন্য এই সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে যদি ভারি বৃষ্টিপাত হয়, তাহলে এই সড়কে যানবাহন চলাচল স্থবির হয়ে যায়। এতে অসংখ্য যাত্রী নির্ধারিত সময়ে বিমানবন্দর যেতে পারছেন না, ফ্লাইট মিস করছেন। তাই বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারের প্রচারণা বাড়লে ফ্লাইট মিসের হার অনেকটাই কমবে বলে মনে করে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। জাতনে চাইলে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক হাবিবুল্লাহ বাহার বলেন, যে কোনো প্রবাসী শ্রমিক বিমানবন্দর থেকে নির্ধারিত নম্বরে কল দিলে নিজস্ব মাইক্রোবাস (১২ আসন) দিয়ে তাকে সেন্টারে নিয়ে আসা হবে। আবার নির্ধারিত ফ্লাইটের তিন ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে নামিয়ে দেয়া হবে। এজন্য মাইক্রোবাস ভাড়া দেয়া লাগবে না। দিনের ২৪ ঘণ্টাই এই সেবা পাবেন প্রবাসীরা। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার থেকে বিমানবন্দর যেতে সড়কে যানজট থাকে না। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যেই যাত্রীকে পৌঁছে দেয়া যায়। ফলে ফ্লাইট মিস হওয়ার আশঙ্কা নেই।