লাউয়াছড়ার শত কোটি টাকার জমি দখল, নীরব বনবিভাগ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৩ এএম, ২৪ এপ্রিল,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:২৮ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
রীতিমতো পাল্লা দিয়েই বেদখল হচ্ছে দেশের অন্যতম রেইনফরেস্ট কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভূমি। ঐতিহ্যবাহী এই উদ্যানটি মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ১২০০ হেক্টর ভূমি নিয়ে গড়ে ওঠে প্রাণ-প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রমখ্যাত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ক্রমেই কমে আসছে।
জানা গেছে, প্রচুর পর্যটকের আগমন শুরু হওয়ায় এখানে বাণিজ্যিকভাবে চা বাগানের মনোরম পরিবেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ শুরু করে। বিশেষ করে রিসোর্ট এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক। এই সুযোগে জায়গা বেচা-কেনার শক্তিশালী একটি দালাল সিন্ডিকেটও গড়ে ওঠে। এই জায়গা বেচা-কেনার চক্রটিই দখলের মাধ্যমে জায়গা বেচাকেনার কাজটি করে। শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাধানগর, বিষামনি, পিচের মুখ, রামনগর এলাকাগুলোতে বৈধ সম্পত্তির বিপরীতে বেশিরভাগ ভূমিই খাস খতিয়ানভুক্ত। এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে দালাল চক্রটি। এই দালাল চক্রটিই মৌরসি সূত্রে প্রাপ্ত বৈধ এক বিঘা জমি ক্রেতার কাছে বিক্রি করে, পাশে থাকা সরকারি এবং বনের ভূমি অবৈধ পন্থায় ক্রেতার কাছে সামান্য মূল্যে দখলে বুঝিয়ে দেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, লাউয়াছড়ার আশপাশ যেমন বিষামনি, রাধানগর, গ্র্যান্ড সুলতান রিসোর্টের সামনে এবং পেছনে যাদেরই জমি রয়েছে প্রত্যেকেরই দখল করা মোট ভূমির একভাগ বৈধ হলেও দখলকৃত মোট ভূমির বাকি তিনভাগই সরকারি কিংবা লাউয়াছড়া বনের ভূমি। কোটি কোটি টাকা মূল্যের এসব ভূমির সীমানা নির্ধারণ অথবা অবৈধ দখলে থাকা ভূমি উদ্ধার করা দূরে থাক, রহস্যজনককারণে এই বিষয়টি সামনে এলেই অবৈধ দখলে থাকা এসব ভূমি উদ্ধারে বিষয়টি অনেকটা সুকৌশলে এড়িয়ে যান খোদ উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে বনবিভাগের কর্মকর্তারাও। দিন দিন বনের জমি দখল করে রিসোর্ট নির্মাণের নামে বন ও গাছপালা উজাড়, পাহাড়ি প্রাকৃতিক ছড়া দখল করে মাটি ভরাট করে রাস্তার কারণে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ছড়াগুলো। বিশেষ করে বালিশিরা মৌজার ছড়াগুলো অবৈধভাবে দখলে নিয়ে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণের জন্য ভরাট করে ফেলায় এসব প্রাণচ্ছ্বোল ছড়াগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১২০০ হেক্টরের বনাঞ্চলজুড়ে প্রায় আড়াই হাজারের অধিক বন্যপ্রাণি রয়েছে লাউয়াছড়ায় যার মধ্যে দুর্লভ ও বিলুপ্তপ্রায় ৪৬০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। ১৯৯৬ সনে লাউয়াছড়াকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকেই মূলত বনের জমি অবৈধভাবে দখলদারিত্ব শুরু হয় হয়। পাঁচতারকা মানের হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান শুরু হওয়ার পর থেকেই রাঘব বোয়ালদের চোখ পরে এই স্থানে। এক বিঘা বৈধ জমি কিনে দশ বিঘা সরকারি কিংবা বনের ভূমি দখলের বিষয়টি এখন প্রায় ওপেন সিক্রেট। অবৈধভাবে দখলে নেয়া এসব ভূমিতে রিসোর্ট নির্মাণ ছাড়াও লেবু, আনারসসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ করা হচ্ছে। প্রতি বছরই দখলের পরিসর বাড়ছেই। বন ও বন্যপ্রাণী দেখাশোনার জন্য বনবিভাগ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থাকার পরও এটিকে নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানই বলা চলে। দিনের পর দিন অবৈধভাবে বনের ভূমি বেদখল হতে থাকলেও তারা দেখেও না দেখার ভান করে রয়েছে নীরব। প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণীপ্রেমীদের অভিযোগ, বনবিভাগের অসাধু কর্মকতা-কর্মচারীদের সঙ্গে হাত না মিলিয়ে কোনোভাবেই এভাবে বনের জায়গা দখলের সুযোগ নেই। দখল আর গাছ উজাড় করে স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত থাকায় বন্যপ্রাণির আবাসস্থল সংকটে পড়ার পাশাপাশি উদ্যানের পরিসরও ক্রমাম্বয়ে কমে যাচ্ছে। সরেজমিন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ডরমিটরি টিলাসংলগ্ন পূর্ব এলাকায় প্রায় ১৫ একর ভূমি দখল করে গত চার বছর ধরে লেবু আনারস, বিভিন্ন ফসল, ঘরবাড়ি এমনকি একাধিক নামিদামী রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। সম্প্রতি এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে বনবিভাগের বেশ কিছু ভূমি উদ্ধার করে ‘এই ভূমির মালিক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ লেখা সাইনবোর্ড টানিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বদলির সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত সাইনবোর্ড উপড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, এই এলাকায় যতগুলো রিসোর্ট তৈরি হয়েছে প্রায় প্রত্যেক রিসোর্টের মধ্যেই বন এবং সরকারের জায়গা রয়েছে। প্রভাবশালী হওয়ায় রিসোর্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকেই সরকারি নিয়মনীতি মানেন না। দিনের পর দিন এমন লাগামহীন দখলদারিত্ব চলতে থাকলেও বন বিভাগ কিংবা উপজেলা প্রশাসন নীরব।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ একর বনভূমি বেদখল হয়েছে। লাউয়াছড়া ডরমিটরি এলাকার পশ্চিম পার্শ্বে হিড বাংলাদেশ অফিসসংলগ্ন জাতীয় উদ্যানের আরও একটি টিলার প্রায় ১৫ একর ভূমি দখলে নিয়ে লেবু বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। লেবু বাগানঘেঁষা টিলাসমূহে গাছগাছালি ও লতাগুল্মের সঙ্গে টিলা কেটে নতুন করে বাণিজ্যিকভাবে আবাদের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। হিড বাংলাদেশের কার্যক্রম পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখা যায়, আবাসিক হোটেল, টার্কি মুরগির ফার্মসহ বিভিন্ন বাণিজ্যিক কার্যক্রম বছরের পর বছর ধরে চালিয়ে আসছে তারা। সরকারি কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ভবন নির্মাণ, এমনকি যখন তখন গাছপালা উজাড় করছে তারা। অন্যদিকে, গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট তৈরির পর থেকেই আশপাশের জায়গার মূল্য চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মরিয়া হয়ে অবৈধভাবে ভূমি দখলে নেমেছে প্রভাবশালী চক্রটি। শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ড. আবদুস শহীদ লাউয়াছড়া সংক্রান্ত বনভূমির অবৈধ দখল প্রসঙ্গে বলেন, স্থানীয় মেয়র মহসিন মিয়ার ভাই সেলিম আহমেদ লাউয়াছড়াসংলগ্ন লেমন গার্ডেন রিসোর্টের অর্ধেকের বেশি বনের ভূমি অবৈধভাবে দখল করে রিসোর্ট ব্যবসা করছেন। বনের ভূমি দখল করে চলছেন। যে কারণে প্রশাসনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তবে লেমন গার্ডেন টি রিসোর্টের সত্ত্বাধিকারী স্থানীয় মেয়র মহসিন মিয়া’র ভাই সেলিম আহমেদ বলেন, আমার রিসোর্টে বনের কোনো ভূমি দখলে নেই। তবে স্থানীয় এমপি উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদের অভিযোগের জবাবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। বার বার প্রশ্ন করা হলে এক পর্যায়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমি আর কি কইমুরে ভাই। আমার রিসোর্টে বনের কোনো ভূমি দখলে নেই। স্থানীয়রা বলছেন, দ্রুতই বন এবং বন্যপ্রাণী বাঁচার স্বার্থে দখলদারদের কাছ থেকে বনের ভূমি উদ্ধার, গাছ এবং পাহাড় এবং বৃক্ষ উজাড় বন্ধ করতে হবে। তা না পারলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান একসময় বিলীন হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা তাদের।