গণপূর্তে শালা-দুলাভাইয়ের দৌরাত্ম্য, ঠিকাদারদের অসন্তোষ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০২ এএম, ২৫ ফেব্রুয়ারী,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:৩৮ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
গণপূর্তের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ-এর বিরুদ্ধে টেন্ডারের তথ্য আগাম ফাঁস করে তার শ্যালকের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’কে কোটি কোটি টাকার কাজ পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ নিজের শ্যালক সাইফুল ইসলাম খানের নামে একটি ঠিকাদারি ফার্ম খুলে গণপূর্তের কোটি কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে টাকার কুমির বনে গেছেন। কোনো সরকারি কর্মকর্তা নিজে বা পরিবারের বা আত্মীয় স্বজনের মাধমে তার প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট কোনো ঠিকাদারি কাজে নিযুক্ত হওয়ার আইনগত বিধান নেই। কিন্তু গণপূর্তের সার্কেল-৩ ই/এম শাখার কোনো কাজের টেন্ডার হলেই তার অনুমোদন পেত ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’। আবার এই টেন্ডারগুলোর অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ ছিলেন প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদ। অতি অল্প সময়ের মধ্যে তার শ্যালকের এই প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় অর্ধশতাধিক টেন্ডারের অনুমোদন দেয়ায় তালিকাভুক্ত অন্যান্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গণপূর্ত ই/এম সার্কেল-৩ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কালাম আজাদের শ্যালক সাইফুল ইসলাম খানের ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রকৌশলী আবুল কালাম তার আওতাধীন বিভিন্ন নির্বাহী প্রকৌশলীকে তার শ্যালকের প্রতিঠানকে কাজ দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতেন। গণপূর্ত ইএম বিভাগ-৮ এর অন্তত ২০টি কাজের টেন্ডার দিয়েছেন শ্যালকের প্রতিষ্ঠানকে। আবার ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এই কাজগুলো অনুমোদন করেছেন আবুল কালাম নিজেই। পিপিআর-২০০৮ ধারা ১১৯ (২) অনুযায়ী এ ধরনের অনুমোদন সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করা হয়েছে। আবার রাজস্ব বাজেটে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে আবুল কালামের অনুমোদনের ক্ষমতা ১২ লাখ টাকা হলেও শ্যালকের এই প্রতিষ্ঠানের নামে ২৩ লাখ ২১ হাজার ২৭৬ টাকার কাজ নিজেই অনুমোদন দিয়েছেন। কালাম তার ঊর্ধ্বতন অফিসারের ক্ষমতা নিজেই প্রয়োগ করতেন। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে রাজস্ব বাজেটের ১২ লাখ টাকা প্রাক্কলন অনুমোদন করার ক্ষমতা আবুল কালামের হাতে থাকলেও কোস্টগার্ডের একটি কাজে ১ কোটি ২৬ লাখ ৮১ হাজার টাকার রাজস্ব বাজেটের একটি কাজ বিধিবহির্ভূতভাবে শ্যালকের প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন করেছেন।
অভিযোগ আছে, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে প্রকৌশলী আবুল কালাম তার অধীনস্ত কর্মকর্তাদেরকেও এই প্রতিষ্ঠানে নামে কাজের অনুমোদন দিতে বাধ্য করতেন। যদি কোনো নির্বাহী প্রকৌশলী তার কথা না শুনতেন তাহলে তাকে হয়রানিমূলকভাবে অন্যত্র বদলি করে দিতেন। এমনকি তার চাকরি খেয়ে ফেলারও হুমকি দিতেন।
জানা গেছে, আবহাওয়া অধিদফতরের রাজস্ব বাজেটের ৬৩ লাখ ২ হাজার টাকার ১টি, ৫৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকার ১টি ও ২২ লাখ ১২ হাজার টাকার ১টি কাজ ক্ষমতা বহির্ভূতভাবে অনুমোদন দিয়েছেন শ্যালকের প্রতিষ্ঠানকে। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে আবুল কালাম এ ধরনের অসংখ্য ক্ষমতা বহির্ভূত কাজ করেই চলছেন। বিধি লঙ্ঘন করে শ্যালকের ফার্ম ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসের’ মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়ে কালাম নিজেও হয়েছেন টাকার কুমির।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, গণপূর্ত ই/এম সার্কেল-৩, শেরেবাংলা নগর, ঢাকায় বর্তমানে নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ই/এম কারখানা বিভাগের ঢাকায় ‘মেসার্স ইনটিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’কে ছয়টি কাজ দেয়া হয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পে। যার আইডি নং- ২১৪৯২৪, ২১৪৯২৪, ২১৮৩৩১, ৩৩৭৮১১, ১৩৭৯৯২, ১৪০২৬৭, ১৮৩১৪৯। এতে অনুমোদন দিয়েছেন গণপূর্ত ই/এম কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ ইসকান্দার আলী। পরবর্তীতে ৫টি আইডি গোপন রেখে একই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউচুপ ২৪.১২.২০২১ সালে এই অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর নিকট কাজের তালিকা পাঠান। এই বিষয়ে গণপূর্ত ই/এম কারখানা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ইউচুপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোন কথা বলতে চাননি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি চাকরির আচরণ বিধিমালার ১৭নং বিধি অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীর পরিবারের কোনো সদস্যকে তার আওতাধীন এলাকায় ব্যবসা করার অনুমতি না দেয়ার বিধান রয়েছে। এছাড়াও পিপিআর বিধি ১১৯(২) অনুযায়ী কোনো আত্মীয়-স্বজন বা ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে এমন কাউকে কাজ দেয়ার বিধান নেই। কিন্তু কে শোনে কার কথা! তার শ্যালকের জন্য অন্য ঠিকাদাররা কাজ পায় না। অনৈতিকভাবে কাজ দেয়ার জন্য আবুল কালামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় খবরও প্রকাশিত হয়েছে। তাতেও টনক নড়েনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের। আবার নিজ শ্যালকের ফার্মে কাজ নেয়ার জন্য বিভিন্ন দরপত্রে অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য আগেই বলে দিতেন শ্যালককে। ফলে অন্যান্য ঠিকাদারগণ মূল্য জানতে না পারার কারণে সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার সুযোগ থাকতো না। বিটিআরসি ভবন নির্মাণ প্রকল্পে (দরপত্র আইডি- ৬১৮১৭৩) অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য কালামের শ্যালক সাইফুল দুলাভাইয়ের কল্যাণে আগেই জেনে যায়। পরে ১০ শতাংশ কমে দরপত্র দাখিল করে কাজ বাগিয়ে নেয়।
প্রকৌশলী আবুল কালাম অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য সংবলিত এই কাজের কপি ৮ সেপ্টেম্বর-২০২১ তারিখে পৃষ্ঠাংকন করে গণপূর্ত ই/এম সার্কেল-৩ নির্বাহী প্রকৌশলীর নিকট প্রেরণ করেন। অর্থাৎ এই অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য আগেই জানতেন। আর এটা শ্যালককে না বলা কোন অবকাশ থাকে না। উক্ত প্রাক্কলনের অধিকাংশ আইটেম শিডিউল বহির্ভূত আইটেম। কাজেই কোনক্রমইে অনুমোদিত প্রাক্কলনের মূল্য কোন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে আবুল কালামের শ্যালক সাইফুলের ‘ইন্টিগ্রেটেড কনস্ট্রাকশন সার্ভিসেস’ ছাড়া কোন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানই ১০ শতাংশ কমে দর মিলিয়ে দরপত্র দাখিল করতে পারেনি। এভাবে শ্যালকের মাধ্যমে কাজ বাগিয়ে নিয়ে আবুল কালাম এখন শতকোটি টাকার মালিক।
সূত্র জানায়, রাজধানীর বনশ্রীতে আবুল কালামের ৫ হাজার বর্গফুটের একটি আলিশান ফ্ল্যাট, গুলশান নিকেতনে ২৫শ বর্গফুটের ২টি ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা আ/এ ডি-ব্লকে ৩টি ৫ কাঠার প্লট, নবীনগরে ৪৫ একর জমির সন্ধান মিলেছে এবং সম্প্রতি গ্রামের বাড়িতে করেছে আলিশান বাংলো, প্রিয় প্রাঙ্গণে রয়েছে ২৭ বিঘা জমি। এক কথায় সে এবং তার স্ত্রী এখন টাকার কুমির। কোন প্রকল্পের ইস্টিমেট অনুমোদন করাতে হলে তাকে ৪% এবং দরপত্র অনুমোদন করাতে হলে ২% টাকা কমিশন দিতে হয়। ফলে ঠিকাদাররা এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে লোকসানের মুখেও পড়ছে। এ কারণে দুর্নীতিবাজ আবুল কালামের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে চাকরিচ্যুত করার দাবি জানান অন্যান্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো। এই অভিযোগের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তাকে তার দফতরে পাওয়া যায়নি।
খুদেবার্তা পাঠালে তিনি কয়েক ঘণ্টা পর মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি এখন গ্রামের বাড়িতে আছি। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।’ যদিও পরে তিনি আর কথা বলেননি।
গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘আপনার কাছ থেকে বিষয়টি শুনলাম। আমরা এই বিষয়ে তদন্ত করবো।’
দুর্নীতি দমন কমিশন ‘দুদক’র উপপরিচালক জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেক বলেন, ‘গণপূর্তের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালামের বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ আমাদের দফতরে এসেছে। বিষয়টি তদন্ত চলছে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।