সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও নিয়োগ নিয়ে ভোগান্তিতে বেসরকারি শিক্ষকরা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৪ এএম, ২০ ফেব্রুয়ারী,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:১১ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেন সিরাজুম মুনিরা। তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সুপারিশ পান সাভারের নিশ্চিন্তপুর দেওয়ান ইদ্রিস উচ্চ বিদ্যালয়ে। এ খবরে উচ্ছ্বসিত হলেও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি সে আনন্দ। নিয়োগ পাওয়া বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত পদের চাহিদা দিলেও সেটি নন-এমপিও প্রতিষ্ঠান। তাই যোগ না দিয়ে বিষয়টি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) প্রতিষ্ঠানে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। শুধু মুনিরা নন, তৃতীয় ধাপে ৩৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগে সুপারিশের পর প্রতিদিন গড়ে ৫০টির বেশি অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগের স্তূপ জমেছে এনটিআরসিএতে। অভিযোগ রয়েছে প্রার্থী নারী হওয়ায় তাকে যোগদান করতে না দেয়ার। কোনো কোনো স্কুল থেকে দাবি করা হচ্ছে অর্থ। আবার কেউ কেউ কম্পিউটার কিংবা আসবাবপত্রও দাবি করছেন। এতে মহা সংকটে পড়েছেন সুপারিশপ্রাপ্তরা।
ভুক্তভোগী সিরাজুম মুনিরা বলেন, গত ৩১ জানুয়ারি নিয়োগপত্র পাওয়ার পরদিন যোগদান করতে গিয়ে দেখি সেটি জুনিয়র মাধ্যমিক (ষষ্ঠ থেকে অষ্টম) পর্যন্ত এমপিওভুক্ত, মাধ্যমিক পর্যায় চালু থাকলেও সেটি নন-এমপিও। তাই আমি যোগদান করিনি। সেখানে যোগদান করলে সরকারি কোনো সুবিধা পাবো না। নিশ্চিন্তপুর দেওয়ান ইদ্রিস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। গত ৬ ফেব্রুয়ারি এনটিআরসিএতে লিখিত অভিযোগ জানালেও এখনো তার সমাধান পাইনি। ২০ ফেব্রুয়ারি যোগদানের শেষ সময়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্তদের কাছে যোগদানের জন্য অর্থও দাবি করা হচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠানে নারী শিক্ষককে যোগদান করতে না দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। আবার সরাসরি অর্থ না চেয়ে দাবি করা হচ্ছে কম্পিউটার বা বিভিন্ন আসবাবপত্র। প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ও প্রধানদের যোগসাজশে প্রার্থীদের জিম্মি করা হচ্ছে। কিন্তু অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা গণমাধ্যমকে বলতেও ভয় পাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
ফিরোজ রহমান সাতক্ষীরা সদর উপজেলার একটি মাধ্যমিক স্কুলে সুপারিশ পেয়েছেন। কিন্তু যোগদান করতে গেলে ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি তার কাছে চার লাখ টাকা দাবি করেন। প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশ করতে ভয় পাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। প্রতিষ্ঠান প্রধান আমাদের সামনেই সভাপতিকে বলেছেন এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের কাছ থেকে অর্থ নেওয়া উচিত হবে না। কিন্তু সভাপতি বলেছেন ওনাকে খুশি না করে কীভাবে নিয়োগ হয় তা উনি দেখে নেবেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার একটি আলিম মাদারাসায় সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ফারজানা খন্দকার। প্রার্থী নারী হওয়ায় তাকে যোগদান করতে দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। ওই প্রতিষ্ঠানের অধীনে মাজার আছে। ওই মাজারের পির সাহেব নিজেই সভাপতি। যোগদান করতে প্রতিষ্ঠানে গেলে অধ্যক্ষ ভালো ব্যবহার করলেও সভাপতির সঙ্গে দেখা হতেই তিনি সাফ জানিয়ে দেন, এ প্রতিষ্ঠানে কোনো নারী চাকরি করবে না। ভুক্তভোগী বলেন, প্রতিষ্ঠানপ্রধান বলেছেন তিনি সভাপতিকে রাজি করাবেন। এজন্য তিনি সময় চেয়েছেন। অন্য প্রার্থীদের মতো ভয়ে মাদরাসারটির নাম প্রকাশ করেননি তিনি।
মতিয়ার রহমান নামের আরেক প্রার্থী জানান, তিনি একটি মাদরাসায় নিয়োগের সুপারিশ পান। প্রথমে মাদরাসাপ্রধান ভালো ব্যবহার করেন। পরে যোগদান নিয়ে আলোচনার পর আমাকে বলেন প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার নষ্ট হয়ে গেছে, সেটি কিনে দিতে হবে।
তিনি বলেন, আমি তাকে জানিয়েছি ২০ হাজার টাকা দেবো। তিনি বলেছেন সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে জানাবেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান মো. এনামুল কাদের খান বলেন, সুপারিশপ্রাপ্ত অনেক প্রার্থীর অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। সেগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যোগদান কার্যক্রম চলবে, তারপর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সুপারিশপ্রাপ্ত সবাইকে নিয়োগ দেয়া হবে।
তিনি বলেন, সুপারিশ পাওয়ার পরও যাদের যোগদান করতে দেয়া হচ্ছে না সেসব প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শোকজ করা হবে। সন্তোষজনক কারণ দেখাতে না পারলে তাদের এমপিও বাতিলসহ নেয়া হবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। যে সব প্রতিষ্ঠান থেকে ভুল তথ্য দিচ্ছে তাদের কাছে কারণ জানতে চাওয়া হবে। ইচ্ছেকৃত কেউ ভুল করলে তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে ব্যবস্থা। নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের কী হবে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের নিজস্ব জনবল না থাকায় উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শূন্যপদের চাহিদা সংগ্রহ করা হয়। এসব মাঠ কর্মকর্তাদের বারবার নির্ভুলভাবে তথ্য দিতে বলা হলেও তাদের যাচাই-বাছাইয়ের পরও অনেক তথ্যে ভুল ধরা পড়ছে। তারা আমাদের অধীন না হওয়া এ বিষয়ে কোনো জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, সৃষ্ট পদ নেই, নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্তি, নারী কোটায় পুরুষ বা পুরুষ কোটায় নারী নিয়োগ পাওয়া প্রার্থীদের নিজ ঠিকানার পার্শ্ববর্তী এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদে নিয়োগের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। অনুমোদন ডেলে সেটি বাস্তবায়ন করা হবে। তবে মাঠ কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (বিদ্যালয়) অধ্যাপক বেলাল হোসাইন বলেন, এনটিআরসিএ আমাদের সঙ্গে সমন্বয় না করে মাঠ কর্মকর্তাদের কাছে তথ্য চায়। সেখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। তারা যদি আমাদের কাছে চিঠি দিয়ে এসব তথ্য চাইতো তবে সেখানে ভুল থাকলে আমরা তাদের কাছে জবাবদিহি করতে পারি। সমন্বয়হীনতার কারণে প্রতিনিয়ত এসব ভুল হচ্ছে।
এনটিআরসিএ থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের ৩০ মার্চ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৪ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। বিভিন্ন নিবন্ধনের রিটকারীদের জন্য দুই হাজার ২০০টি পদ সংরক্ষণ করে বাকি পদগুলোতে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আবেদন না পাওয়া এবং নারী কোটায় যোগ্য প্রার্থী না থাকায় ১৫ হাজার ৩২৫টি পদ বাদ রেখে ৩৮ হাজার ২৮৬ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশপ্রাপ্তদের মধ্যে ভেরিফিকেশন ফরম পূরণ করেননি ছয় হাজার প্রার্থী। ফলে ৩২ হাজার ২৮৩ জনের পুলিশ ভেরিফিকেশন করা হচ্ছে। পরে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি তাদের নিয়োগপত্র তুলে দেওয়া হয়। একদিকে পুলিশ ভেরিফিকেশন চলবে অন্যদিকে তারা সুপারিশ পাওয়া প্রতিষ্ঠানে যোগ দেবেন।