চসিকের দোকান বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে আ: লীগের নেতার ছেলে সহ ২০ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:৫৩ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:৫৩ এএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মিত ২৩টি দোকান প্রভাব খাটিয়ে বরাদ্দ দেয়ার মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অধিকতর তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। মৃত্যুবরণ করায় মামলায় এজাহারের প্রধান আসামি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীকে আগেই অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত।
আরও তিনজনকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ করেছে দুদক। অভিযুক্তদের মধ্যে ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিনের ছেলে, বখতেয়ার উদ্দিন খান নগর শ্রমিক লীগের সভাপতি, মোবারক উল্লাহ নগর আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলমের ছেলে, আঞ্জুমান আরা বেগম মিনু নগর আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর শহীদুল আলমের স্ত্রী এবং মাহবুব মিন্টু শ্রমিকলীগ নেতা।
আগামী ২১ সেপ্টেম্বর মামলাটির অভিযোগপত্র গ্রহণের শুনানি রয়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম আদালতে দুদকের আইনজীবী কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু। অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের অভিযুক্তরা হলেন- নগরীর সুগন্ধা আবাসিক এলাকার মৃত ফারুক আহমদ চৌধুরীর ছেলে মো. জাহেদুল আলম চৌধুরী, পাঁচলাইশ থানাধীন সোনাপুর এলাকার মৃত আহমদ হোসেন চৌধুরীর ছেলে খোরশেদ আলম চৌধুরী, গরীবউল্লাহ শাহ হাউজিং সোসাইটির মৃত নবাব মিয়া চৌধুরীর ছেলে বখতিয়ার উদ্দিন খান, নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির এম এ মজিদের ছেলে এ এম মাইনুল হক ও তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানা, লালখান বাজার চাঁনমারী রোড এলাকার বদিউল আলমের ছেলে মোবারক উল্লাহ, পাঁচলাইশের নাজিরপাড়া সুন্নিয়া মাদ্রাসা দাম্মাপুকুর পাড়ের মো. ছায়দুল হকের ছেলে নেজামুল হক, মুরাদপুর এলাকার শাহজাহান খন্দকারের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম, হাটহাজারীর ফরহাদাবাদ মুহুরী বাড়ির (বর্তমানে ১নং দক্ষিণ খুলশী) মৃত নুর হোসেনের ছেলে মো. ইউনুস, পাঁচলাইশের মুরাদপুর পিলখানা এলাকার মৃত মোহাম্মদ মিয়ার ছেলে শেখ সরওয়ার্দী, দামপাড়া পল্টন রোডের মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর ছেলে ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী, লোহাগাড়ার চুনতি মুন্সেফ বাজার সিকদার পাড়া এলাকার মৃত একরামুল হকের ছেলে মো. এরশাদুল হক, খুলশী থানাধীন জাকির হোসেন রোড, পূর্ব নাসিরাবাদের মৃত আবদুর রহমান ভূঁইয়ার স্ত্রী হাসিনা ভূঁইয়া, পাঁচলাইশের ওআর নিজাম রোডের মেহেদীবাগ এলাকার মৃত হাজী দুদু মিয়ার স্ত্রী নুর নাহার বেগম, কোতোয়ালী থানাধীন হরেশ চন্দ্র মুন্সেফ লেইনের আবুল খায়েরের ছেলে হাসান মুরাদ, পাঁচলাইশ থানাধীন খতিবের হাট এলাকার নুরুল ইসলামের ছেলে দিদারুল ইসলাম, এনায়েত বাজার এলাকার নুরুল ইসলাম চৌধুরীর ছেলে মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, পটিয়ার মুন্সেফ বাজার এলাকার আবুল হাশেমের স্ত্রী গোলমান আরা বেগম, বাকলিয়া ডিসি রোডের মো. শহিদুল আলমের স্ত্রী আঞ্জুমান আরা বেগম মিনু ও ফেনী সদর থানার শিলুয়া গ্রামের মুন্সী মিয়ার ছেলে মাহবুব মিন্টু।
সূত্রে জানা গেছে, নগরীর মুরাদপুরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্মিত ২৩টি দোকান ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মধ্যে বরাদ্দ দেয়া হয়। পত্রিকায় টেন্ডার ছাড়া, যাচাইবাছাই ছাড়া দোকানগুলো বরাদ্দ দেয়ার অভিযোগে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করে দুদক।
দুদকের তৎকালীন পরিদর্শক সামছুল আলম বাদি হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীসহ ২৪ জনকে আসামি করা হয়। মামলার বাদী প্রথমে আদালতে সাক্ষ্য স্মারক জমা দেন। পরে সামছুল আলম বদলি হলে মামলাটি দুদকের আরেক পরিদর্শক মো. মবিনুল ইসলাম তদন্ত করে তিনিও আদালতে সাক্ষ্য স্মারক জমা দেন।
মবিনুল ইসলামের সাক্ষ্য স্মারকে উল্লেখ করা হয়, মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী উক্ত দোকান ইজারা সংক্রান্ত পত্রিকায় কোন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেননি। প্রতিটি আবেদনপত্রের ওপর নিজের মনগড়া দোকানের মূল্য ও মাসিক ভাড়া নির্ধারণ পূর্বক লিখিত বরাদ্দ আদেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে আরেক পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলম আগের দুই তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য স্মারক পর্যালোচনা করে ২০০৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আদালতে অভিযোগ পত্র দাখিল করেন।
এরপর মহিউদ্দিন চৌধুরীর রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০০৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মামলাটির কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দেন। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ৬ ডিসেম্বর রিট পিটিশন সংক্রান্ত রুল খারিজ করে দিয়ে মামলার কার্যক্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন হাইকোর্ট। এরপর মামলাটির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট আদালত। আদালতের নির্দেশে দুদক প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম মামলাটি তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র জমা দেন।
অভিযোগ পত্রে কেবিএম সিরাজ উদ্দিন, হাফেজ আহমদ ও খায়রুল আনোয়ার মৃত্যুবরণ করায় তাদের মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানানো হয়। এর আগে এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যাওয়ায় ২০১৮ সালের ৩০ মে আদালত তাঁকে অব্যাহতি প্রদান করেন। বর্তমানে এজাহার নামীয় ২০ জন আসামি মূল বেনিফিশিয়ারি হিসেবে ২০টি দোকানের পজিশন গ্রহণ করে ১৯৪৭ সনের ২নং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অপরাধের সাথে পরস্পর যোগসাজশে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন দেন তদন্ত কর্মকর্তা।
দুদক প্রধান কার্যালয় থেকে গত ২৭ জুন অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদনটি অনুমোদন দেয়া হয়। পরবর্তীতে গত ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম স্পেশাল জজ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলাম।
আদালতে জমা দেয়া অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, নগরীর মুরাদপুর যাত্রী ছাউনিতে কিছু দোকান নির্মাণ করা হয়। নির্মিত ২৩টি দোকান বরাদ্দ কিংবা ভাড়া প্রদানের জন্য চসিক পত্রিকায় কোন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেনি। কোন নোটিশও ঘোষণা করা হয়নি। ২৩ জন যাত্রী ছাউনির দোকান বরাদ্দ প্রাপ্তির আশায় তৎকালীন মেয়রের বরাবরে সাদা কাগজে সরাসরি আবেদন করেন।
মেয়র দোকানগুলো ভাড়া কিংবা ইজারা প্রদান সংক্রান্ত কোন দাম কিংবা নীতিমালা তৈরি না করেই, কোন কমিটি না করেই, নিজেই প্রতিটি দরখাস্তের উপর দোকানের মনগড়া দাম উল্লেখ করে দোকান বরাদ্দ প্রদান করেন। পত্রিকায় দরপত্র প্রকাশের মাধ্যমে দোকানসমূহ বরাদ্দ প্রদান করা হলে, অধিক মূল্যে এবং অধিক হারে মাসিক ভাড়ায় দোকানগুলো বরাদ্দ প্রদান সম্ভব হতো।
এ ক্ষেত্রে মেয়র ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক নিজে লাভবান হওয়ার জন্য এবং অন্যকে লাভবান করার উদ্দেশে মুরাদপুর যাত্রী ছাউনিতে নির্মিত ২৩টি দোকান বরাদ্দ প্রদান করে চসিকের ক্ষতিসাধন করেন বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. ফখরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি।