পুলিশে চাকরি দিতে জালিয়াতি
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৭ এএম, ২৮ আগস্ট,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৩২ পিএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে পুলিশে চাকরি দিতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯ সালে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে বিভিন্ন জেলার ১৮ জন প্রার্থীর কাছ থেকে এই বিশাল অংকের ঘুষ নিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করেছিল পুলিশের একটি চক্র। স্থায়ী বাসিন্দা বানাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা, আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জ থানার ওই ১৮ জনের মধ্যে ৪ থেকে ৫ জনের গ্রুপ বানিয়ে একই সময়ে জমি কিনিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দু’মাস বা এক মাস পর।
নিয়োগপ্রাপ্ত ওই ১৮ জন ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবলকে ইতোমধ্যে বরখাস্ত করা হলেও এই বিশাল নিয়োগ বাণিজ্য ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। তবে ইতোমধ্যেই পুলিশ সদর দফতরের একটি তদন্ত কমিটি এ ব্যাপারে বিশদ প্রতিবেদন দাখিল করেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত ২০২০ সালের ১০ অক্টোবর দাখিল করা ওই প্রতিবেদনে জালিয়াতি ও বিভাগীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজের সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল। অনুসন্ধানে সেই জালিয়াতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে।
তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল তারা হলেন, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার সাবেক ওসি আসলাম হোসেন, রূপগঞ্জ থানার সাবেক ওসি মাহামুদুল হাসান, আড়াইহাজার থানার সাবেক ওসি নজরুল ইসলাম, জেলার সাবেক ডিআইও-১ পুলিশ পরিদর্শক মোমিনুল ইসলাম, রূপগঞ্জ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফরিদ উদ্দিন, এসআই শাহজাহান খান, রূপগঞ্জ থানার সাবেক এসআই শামীম আল নুর, সাবেক এসআই খায়রুল ইসলাম, আড়াইহাজার থানাধীন কালাপাহাড়িয়া তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ এসআই বিজয় কৃষ্ণ কর্মকার ও ফতুল্লা থানার সাবেক এসআই আরিফুর রহমান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৪ মে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে জনবল নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পুলিশ সদর দফতর। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরপরই নারায়ণগঞ্জ জেলা থেকে কনস্টেবল পদে চাকরি দেওয়ার কাজ হাতে নেয় একটি চক্র। এই চক্রের সঙ্গে মোট ১৮ জন প্রার্থী জন প্রতি ১৫ লাখ টাকায় চুক্তিবদ্ধ হন, যারা নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা নন। ওই চক্র সুকৌশলে ১৮ জনকে নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা বানাতে জেলার আড়াইহাজার ও রূপগঞ্জে নামমাত্র মূল্যে জমি ক্রয়ের ব্যবস্থা করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব জমি নদী তীরবর্তী ও বছরের অর্ধেক সময় পানিতে ডুবে থাকায় সেগুলো খুবই কম দামে বিক্রি করেন জমির মালিকরা। পুলিশ সদর দফতরের দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রার্থী রিপন হোসেন (কনস্টেবল নং-২৯৫০, পিএসটিএস-টিআরসি/১৪৫), মো. সজিব (কনস্টেবল নং-২৮৩২, পিএসটিএস-টিআরসি/৪১১), সবুজ হোসেন (কনস্টেবল নং-৪৯৬৫, পিএসটিএস-টিআরসি/২৫৭), মো. রাসেল (কনস্টেবল নং-৭৮৪,পিএসটিএস-টিআরসি/২৬১) ও কবীর মিয়া (কনস্টেবল নং-৯১৬, পিএসটিএস-টিআরসি/১৮৮) এই পাঁচজন প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানার স্বপক্ষে দাখিলকৃত জমির দলিল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশনের তারিখ একই ছিল। একইভাবে হুময়ান কবরী (কনস্টেবল নং-১৬৬৫, পিএসটিএস-টিআরসি/৫৮), রাসেল শেখ (কনস্টেবল নং-৮৪০, পিএসটিএস-টিআরসি-১৭৬) ও সুজন আহম্মেদ (কনস্টেবল নং-৭২৪২, পিএসটিএস-টিআরসি/৭৬৩) এই তিনজনের স্থায়ী ঠিকানার স্বপক্ষে দাখিলকৃত জমির দলিল নম্বর একই এবং রেজিস্ট্রেশনও একই তারিখে করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বাকি প্রার্থীদের মধ্যে আকরাম হোসেন, সোহেল রানা, মানিক মিয়া, মো. রাসেল, রিপন সরকার, আপিরুল ইসলাম, তোফায়েল খান, সুমন আহম্মেদ, রায়হান আলীর ক্ষেত্রেও একই রকম জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া যায়। তবে এই বিশাল নিয়োগ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় সেটি হলো এই ১৮ প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানার স্বপক্ষে দেওয়া প্রতিটি জমির দলিলই রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর। যার কোনোটি ৬৫ দিন পরে, কোনোটি ২৩ দিন আবার কোনোটি ৩০ দিন পর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ জেলার বাইরের এই ১৮ প্রার্থীকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রথম ধাপ সম্পন্ন করেন মোট ছয়জন উপ-পরিদর্শক (এসআই)। সে সময় ১৮ পুলিশ সদস্যের ঠিকানা যাচাই করতে বলা হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশকে। সেখান থেকে দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় থানাকে। কিন্তু প্রথম দফা ঠিকানা যাচাইয়ে ছয় এসআই ওই প্রার্থীদেরকে নারায়ণগঞ্জ জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেন এবং রূপগঞ্জ, আড়াইহাজার ও ফতুল্লা থানার তিন সাবেক ওসি সেগুলো অগ্রগামী করেন। পরবর্তী ধাপে সেগুলো ক্লিয়ার করেন তৎকালীন ডিআইও-১ মোমিনুল ইসলাম।
দ্বিতীয় দফা তদন্তে রূপগঞ্জ থানার সাবেক ওসি মাহমুদুল হাসান প্রত্যেকের ঠিকানা সঠিক বলে রিপোর্ট দেন। শুধু তাই নয়, মানবিক কারণে চাকরির সুপারিশও করেন, যা নিয়মবহির্ভূত। রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় প্রশিক্ষণ শেষে ওই ১৮ জন প্রার্থীর কনস্টেবল হিসেবে প্রথম পোস্টিং হয় ১৮ জেলায়। কিন্তু নতুন চাকরি পাওয়াদের বিষয়ে জালিয়াতি নিয়ে গুঞ্জন শুরু হলে পুলিশ সদর দফতরের তদন্তে বেরিয়ে আসে ঠিকানা জালিয়াতির তথ্য। নানা পদক্ষেপের পর শেষ পর্যন্ত চাকরি হারান তারা।
তথ্যানুসন্ধানে আরো জানা গেছে, পুলিশ সদর দফতর গঠিত তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যেই অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের জবানবন্দি সংগ্রহ করেছে। দাখিলকৃত ওই তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ জন প্রার্থী নারায়ণগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও প্রথম দফায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের দাখিলকৃত ভেরিফিকেশন রোল (ভি-রোল) থানার ওসিরা অগ্রগামী করে দায়িত্বে চরম অবহেলা ও গাফিলতি প্রদর্শন করেছেন। অভিযুক্ত ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। এদিকে অভিযুক্ত ওই ১০ কর্মকর্তার কেউই বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম বলেন, ২০১৯ সালে আমি এই জেলার পুলিশ সুপার ছিলাম না। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ সদর দফতরে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। বিষয়টি জানতে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানার মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।