৮৯৭ রোহিঙ্গার নাগরিকত্বের প্রমাণ পেয়েছে দুদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৩১ এএম, ১৬ জুলাই,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০২:৩৯ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
টাকার বিনিময়ে সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশি নাগরিকত্ব হিসেবে ৮৯৭ রোহিঙ্গার জাতীয় পরিচয়পত্র রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে এসেছে। এ নিয়ে অর্ধশত রোহিঙ্গাসহ ১০৬ জনকে আসামি করে ইতোমধ্যে ১৮টি মামলা দায়ের করেছে দুদকের চট্টগ্রাম অফিস।
অভিযোগ আছে, টাকার বিনিময়ে সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের জন্মনিবন্ধন, চেয়ারম্যানের সনদসহ পাসপোর্ট এমনকি তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে সহায়তা করছে। ওই চক্রের সহযোগিতায় প্রাথমিক তদন্তে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পেছনে জেলা নির্বাচন কমিশনের অফিস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
২০১৭ সালে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনে শিকার হয়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। এর আগে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করেন তারা। সরকারি হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, নানা কৌশলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করছে। সর্বশেষ কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়নে দুই শতাধিক রোহিঙ্গার নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেÑ এমন অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৫ হাজার ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ভোটার বানানো হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা।
ওই ঘটনায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কক্সবাজারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রায় ১০৬ জনকে আসামি করে মোট ১৮টি মামলা দায়ের হয়েছে।
দুদকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। এখনও নাগরিকত্ব পাওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা যায়নি। ফলে তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি ঝুলে আছে। তবে তদন্তপর্যায়ে ৮৯৭ রোহিঙ্গার নাম এবং তাদের ঠিকানাসহ একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
ওই তালিকায় দেখা যায়, কক্সবাজার সদর উপজেলার ৩নং ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের টেকপাড়ার ছয় রোহিঙ্গা, সিকদার পাড়ার পাঁচজন, পশ্চিম বোয়ালখালির পাঁচজন, পূর্ব বোয়ালখালির ৬২ জন, পূর্ব ইউছুপেরখিলের ১২ জন, পাহাশিয়াখালির দুজন, ইউছুপেরখিলের দুজন, হরিপুরের ২৯ জন, খোদাইবাড়ির ১৮ জন, আউলিয়াবাদের ৩৮৬ জন, ছৈইম্মা ঘোনার সাতজন, বর্মাপাড়ার ১৩ জন, পশ্চিম গজালিয়ার ১৫৯ জন, থানার পশ্চিমে একজন, বামবাগানের সাতজন, ছফুরার বাড়ির দুজন, খুশির শিয়ারের চারজন, মাস্টার পাড়ার তিনজন, কারাচি পাহাড়ের ১৭ জন, ধোয়াশিয়ার একজন, গজ্জন বগিচার একজন, ওয়াহেদর পাড়ার পাঁচজন, মধ্যম গজালিয়ার ৬০ জন, পূর্ব গজালিয়ার ৮৪ জন এবং গজালিয়ার দুজন রোহিঙ্গা রয়েছেন।
দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, এসব রোহিঙ্গা পরিবারের অধিকাংশ সদস্যই বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পেয়েছেন। এর মধ্যে একই পরিবারের পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ ১২ জন সদস্যও রয়েছেন। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি নাগরিকত্ব দেওয়ার কারিগর কারা তাদেরও খুঁজে বের করার চেষ্টা চলাচ্ছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জানান, যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে, তাদের বিরুদ্ধেই তদন্ত চলছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গারাও রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) তৈরির কাজে ব্যবহৃত সাতটি ল্যাপটপ চুরি হয়। মূলত, সেখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।
তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে ৫৫ হাজার জনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলমান। অনেকগুলো মামলাও হয়েছে। অবৈধ নাগরিকত্ব পাওয়া সবাইকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এটি চিহ্নিত হলে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের লোকজনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তা না হলে ভুয়া নাম, পরিচয় দেখিয়ে এনআইডি, জন্মনিবন্ধন কিংবা পাসপোর্ট করা সম্ভব নয়। এরা দেশের শত্রু। এ বিষয়ে আরও অনেক মামলা হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালে নিজ দেশের সেনাবাহিনীর হাতে নির্মম নির্যাতনে শিকার হয়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে এক প্রকার মানবিক কারণেই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছিল বাংলাদেশ। সরকারি হিসাবে বর্তমানে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
সেই রোহিঙ্গারাই আজ বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন। ভোটার তালিকায়ও উঠছে তাদের নাম। অনেকে আবার টাকার বিনিময়ে ভুয়া তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। সেখানে গিয়ে নানা অপকর্মের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ম করছেন।