অর্থনীতি এখন ‘অটোপাইলটে’ চলছে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৫ এএম, ২২ মে,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ০৯:০৬ পিএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ‘অটোপাইলটের’ মাধ্যমে চলছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, চলমান সংকটে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা অপর্যাপ্ত এবং এসব সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। দেশের অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা প্রশাসননির্ভর হয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আজ শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ ও বাজেট প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আজ সকালে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন।
বৈঠকে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমানে চলছে প্রশাসননির্ভর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। অর্থ ও মুদ্রানীতি-সম্পর্কিত সরকারের করা আইন আছে। সেখানে যেসব কাজ করার কথা বলা আছে, সেগুলোও সরকার করছে না। ফলে যেটা হচ্ছে, সমস্যা তৈরি হওয়ার পর নীতি-ব্যবস্থাগুলো সরকারের দিক থেকে প্রতিক্রিয়ার মতো আসে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন একটি ‘অটোপাইলটের’ হাতে আছে। এই অটোপাইলট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে। এটা তো হতে পারে না।
সিপিডির বিশেষ এই ফেলো আরও বলেন, তথ্য-উপাত্তের প্রতি অবজ্ঞা এবং অনেক ক্ষেত্রে অন্ধত্ব আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে। আমরা যে উন্নয়ন-উপাখ্যান তৈরি করেছি, সেই উন্নয়ন-উপাখ্যানের সঙ্গে অর্থনীতিবিদদের বক্তব্য যদি যুক্তিসংগত না হয়, তখন তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণকেও বিভিন্ন ধরনের অপমানসূচক বক্তব্য দিয়ে ছোট করা হয়। তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সরকার এখন মেনে নিচ্ছে অর্থনীতিতে সংকট বিরাজমান। আমরা আগে থেকেই বলে আসছি, সংকট বিরাজমান, এখন বিকাশমান।
দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রবৃদ্ধিকে ‘অনন্য দেবতার’ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উল্লেখ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই অবস্থান থেকে ওনাকে (প্রবৃদ্ধি) সরাতে হবে। এখন অর্থনৈতিক সামষ্টিক স্থিতিশীলতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সমস্যার সমাধানে মধ্য মেয়াদের চেয়ে স্বল্প মেয়াদে ব্যবস্থা নেয়ার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হতে হবে দুই থেকে তিন বছর মেয়াদি।
বৈঠকে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের কম সুদে যে ঋণ দেয়া হয়েছে, তার ৬০-৭০ শতাংশ ফেরত আসছে না। তাই এসব ঋণের মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে।
ডলার সংকটের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, গত বছর এই সময়ে প্রবাসী আয় বেড়েছিল, এই কারণে রিজার্ভও নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এখন পরিস্থিতি পুরো উল্টো। এখন টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে, ফলে ডলারের সঙ্গে টাকারও সংকট তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় পড়ে যাব, আগে এমনটা ধারণাও করিনি। এখন আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের দাম যাই হোক না কেন, ডলারের দাম তো বেড়েই গেছে। বেশি দামে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে।
সংকট উত্তরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির গুরুত্ব উল্লেখ করে পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যবসায়িক দলের সঙ্গে আমার কথা হয়। তারা আমাদের মাথাপিছু আয়সহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তারা বলেছে, তোমাদের এখানে সুযোগ আছে সত্য, তা যদি তোমরা বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরতে না পারো, তাহলে সুযোগ কাজ করবে না।
এম মাশরুর রিয়াজ আরও বলেন, দেশে এখন চলছে রেগুলেটরি ক্যাপচার বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপর প্রভাব বিস্তারের ব্যবস্থা। কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে নীতি বদলে যায়। অর্থনীতির চলমান সংকট মোকাবিলায় নানা পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক। মানুষকে স্বস্তি দিতে ব্যক্তিশ্রেণির আয়কর কমানোর সুপারিশ করেন তিনি। পাশাপাশি পরোক্ষ করের বোঝা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের বাড়িয়ে বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। মানুষের জীবনের, বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের সংকট দূর করতে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন সায়েমা হক।
তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর বেশির ভাগই গ্রামকেন্দ্রিক। বর্তমান বাস্তবতায় শহরের জন্যও বিশেষ সামাজিক কর্মসূচি চালু করা দরকার।
ডলার সংকট নিয়ে ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর নাজনীন আহমেদ বলেন, সব মিলিয়ে আমরা বর্তমানে একটি চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছি। ডলার সংকটের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা দায়ী। তাই এ ধরনের সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, অর্থনৈতিক নীতি দুর্বলতার কারণে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার যে আকাক্সক্ষা, স্বাধীনতার ৫০ বছরেও সেটি অর্জিত হয়নি। সমাজের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে ৪০ শতাংশ সম্পদ। তাদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ হারে কর আদায় নিশ্চিত করা গেলে জিডিপির ৪ শতাংশের সমান কর আসবে। পাশাপাশি রফতানি আয়ের দিকে সরকারকে মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে এম এ রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশ রফতানি আয়ের দিক থেকে প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমএ) চেয়ারম্যান আলমগীর কবির বলেন, অর্থনীতির এমন পরিস্থিতি আগে আমরা কমই মোকাবিলা করেছি। আগেও অর্থনৈতিক মন্দা হয়েছে। তবে এবার মন্দা শুরুর আগেই আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বলতে ইচ্ছা করছে, কেন এই আতঙ্ক তৈরি হলো? আমরা প্রথম থেকেই বলছি, এটা শ্রীলঙ্কার মতো হবে না। আমাদের অনেক রিজার্ভ (বৈদেশিক মুদ্রার মজুত) আছে। আমাদের অনেক শক্ত জায়গা রয়েছে। তারপরও আমরা বাস্তবে আতঙ্ক তৈরি করে ফেলেছি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে কি না, সেটা আমার জানা নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ১ ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেই জানে, তার ডিলার ব্যাংক বা বাণিজ্যিক ব্যাংকে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকার ওপরে। এত পার্থক্য কেন? তাহলে কি বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এখানে? যদি নিয়ন্ত্রণ থাকত, তাহলে এই অবস্থা হবে কেন? প্রথম থেকে কেন হাত দেয়া হলো না। কেন অবৈধভাবে অর্থ মানুষের কাছে চলে যায়।’
সিমেন্ট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ক্রাউন সিমেন্টের এই ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, অর্থনীতি নিয়ে নীতিটা কার হাতে সেটি আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা কালকে যে পণ্য আমদানি করব, তার জন্য ডলারের কী দর হবে, সেটি ঠিক করতে পারছি না। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও ঊর্ধ্ব মূল্যায়ন দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত হলে আমরা সেটি ম্যানেজ করতে পারি। তার চেয়ে বেশি পরিবর্তনের জন্য আমরা প্রস্তুত না। এটা ব্যবসাবান্ধব হওয়া দরকার। এটা হচ্ছে না।
শিক্ষা খাতের বাজেট নিয়ে আলোচনা করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা সহযোগী তাহরিন তাহরীমা চৌধুরী। তিনি বলেন, করোনার কারণে শিক্ষার মানের ব্যাপক অবনতি হয়েছে। এই ঘাটতি পূরণে করোনার সময়ে নীতিনির্ধারকেরা অনেক নীতি ও উদ্যোগ নেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর এখন আর সেই ধরনের কোনো কথাবার্তা হচ্ছে না। ফলে বর্তমান শ্রমবাজারে এই শিক্ষার্থীদের অবদান না থাকলেও ভবিষ্যতে তা কিন্তু বড় ক্ষতির কারণ হবে।