করোনার টিকাদান কর্মসূচি কি গভীর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে?
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০৩ এএম, ৩১ মার্চ,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:১৩ এএম, ১৫ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
আগামী ৮ এপ্রিল থেকে করোনাভাইরাসের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরুর কথা থাকলেও নতুন করে টিকা পাওয়া নিয়ে সঙ্কটের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। এমনকি প্রথম ডোজ পাওয়া সবাইকে দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত টিকাও এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে নেই। পাশাপাশি ভারতে তৈরি অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা রফতানির ক্ষেত্রে দেশটি সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারির পর এ নিয়ে শঙ্কা আরো তীব্রতর হয়েছে। জানুয়ারি থেকে গত তিন মাসে বাংলাদেশের কেনা টিকার মধ্যে দেড় কোটি ডোজ আসার কথা থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে এখন পর্যন্ত সে টিকা থেকে বাংলাদেশে পেয়েছে অর্ধেকেরও কম।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সম্প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন, সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে যথাসময়ে টিকা না এলে তারা ‘অন্য পরিকল্পনা’ করবেন। তবে বাস্তবতা হলো সেরাম ইন্সটিটিউট ছাড়া অন্য কোনো সূত্র থেকে টিকা আনার জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি এখন পর্যন্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে সেরাম ইন্সটিটিউট চুক্তি অনুযায়ী টিকা দিতে ব্যর্থ হলে করোনার টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ এক গভীর সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, টিকা নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে এবং তারা আশা করছেন চাহিদামতো টিকা সময়মতোই পেয়ে যাবেন তারা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা বিবিসি বাংলাকে বলেন, টিকা নিয়ে উদ্বেগের কিছু নেই। কাজ চলছে। সময়মতোই টিকা পাবে বাংলাদেশ। তাই কোনো সঙ্কট হবে না। দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরুর আগে প্রথম ডোজ দেয়া সাময়িকভাবে বন্ধ করা হবে। আবার দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার মধ্যেই নতুন করে টিকা আসা নিশ্চিত হয়ে যাবে। এরপর আবার নতুন করে টিকা দেয়ার কার্যক্রম শুরু হবে। ফলে সঙ্কটের আশঙ্কা নেই। যদিও আগামী ৮ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া শুরুর কথা থাকলেও তার আগে প্রথম ডোজ দেয়া কবে বন্ধ হবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আবার প্রথম ডোজ দেয়া বন্ধ করা হলে, যারা টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন তাদেরও অনেকের টিকা না পাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হবে।
দেশে গত ২৭ জানুয়ারি করোনাভাইরাসের টিকা দেয়ার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। পরে ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় গণটিকাদান। প্রথম ডোজের টিকা দেয়ার পর দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়ার জন্য আট সপ্তাহের বিরতির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এবং সে হিসাবে ৮ এপ্রিল থেকেই দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরু হওয়ার কথা। আর টিকা আনার ক্ষেত্রে যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, তাতে প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ হিসেবে মোট তিন কোটি ডোজ টিকা আনার কথা ছিল ছয় মাসের মধ্যে। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে, ২৯ মার্চ দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট টিকা নিয়েছেন ৫২ লাখ ৬৩ হাজার ২৪৮ জন। নিবন্ধন করেছেন ৬৭ লাখ ৩৭ হাজার ৯৯০ জন।
অন্যদিকে এর বিপরীতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে এক কোটি দুই লাখ ডোজ টিকা, যার মধ্যে ৩২ লাখ ডোজই ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পাওয়া। আর বেক্সিমকো ও সেরাম ইন্সটিটিউটের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী যে তিন কোটি ডোজ আসার কথা। তার মধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি ৫০ লাখ আর ২৩ ফেব্রুয়ারি এসেছে ২০ লাখ ডোজ।
এখন ভারত রফতানি সাময়িক স্থগিত করায় বাকি টিকা কবে আসে তা নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আইইডিসিআরের পরামর্শক ডা: মুশতাক হোসেন বলেন, টিকা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা আছে কিন্তু এটা বৈশ্বিক সমস্যা। বাংলাদেশের জন্য এটা বড় কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া সেরামের পাশাপাশি অন্য সূত্রগুলো থেকেও চেষ্টা করার কথা সরকার বলছে। যে ধরনের তৎপরতা আছে তাতে আশা করছি টিকা চলে আসবে।
এর আগে সোমবার এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির চেয়ার অধ্যাপক ডা: মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছিলেন, প্রথম ডোজের টিকা যারা নিয়েছে তাদের জন্য দ্বিতীয় ডোজের টিকা সুরক্ষিত আছে, যদিও সবার জন্য সেটি নেই।
তিনি বলেন, এ কথা সত্যি সবার জন্য দ্বিতীয় ডোজের টিকা নেই। কিন্তু আমরা এ বিষয়ে কাজ শুরু করব। টিকা যাতে এসে যায়, সে বিষয়ে আমরা কাজ করছি। এ মুহূর্তে ৪২ লাখ ডোজ মজুত আছে জানিয়ে তিনি আশা করেন, আগামী মাসে কিছু টিকা তারা পাবেন। যার ভিত্তিতে সবার (প্রথম ডোজ নেয়া) দ্বিতীয় ডোজ দেয়া নিশ্চিত হবে। এসব কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, দ্বিতীয় ডোজ দেয়া শুরুর পরেও যদি নতুন করে টিকা না আসে তাহলে পরিস্থিতি কেমন হবে? সোমবারই হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, সেরাম ইন্সটিটিউট থেকে সময়মতো টিকা না পেলে অন্য পরিকল্পনা নেবেন তারা। যদিও ওই পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য তিনি দেননি।
মন্ত্রী বলেন, এ মাসের টিকা আমরা পাইনি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে টিকার বিষয়ে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। টিকা পেতে দেরি হলে আমাদের অন্য পরিকল্পনা করতে হবে।
প্রাপ্ত টিকার ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন : স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক পরিচালক বেনজির আহমেদ বিবিসিকে বলেন, একদিকে টিকা যথাসময়ে না পাওয়ায় এবং অন্যদিকে পাওয়া টিকা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করতে পারায় সঙ্কটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তিন মাসে ৫০ লাখ মানুষেরও দু ডোজ টিকা প্রদান শেষ করা যায়নি, অথচ এখনই টিকার সংস্থান হুমকির মুখে। টিকা নিয়ে এমন অবস্থা তৈরি হওয়ায়, টিকাদানের মাধ্যমে সংক্রমণ মোকাবিলা করার যে সম্ভাবনা ছিল তা হুমকির মুখে পড়বে।
বেনজির আহমেদ আরো বলেন, সব মিলিয়ে টিকাকে কেন্দ্র করেই এ সঙ্কটময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অথচ কিভাবে এ সঙ্কট মোকাবিলা করতে হবে তার কোনো উত্তর কারো কাছে নেই।