হ য ব র ল
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৫ এএম, ৭ এপ্রিল,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:৩৬ এএম, ২৮ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় সাত দিনের লকডাউনের দ্বিতীয় দিনেও আজ রাজধানীসহ সারাদেশে জীবনযাত্রা ছিল আরও স্বাভাবিক। বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানতে দেখা যায়নি প্রায়জনকে। লকডাউন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছে না প্রশাসন। অন্যদিকে নানা অব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষ দুর্ভোগের শিকার হলেও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে ব্যবসায়ীরা। সোমবারের মতো গতকাল মঙ্গলবার বেলা যত বেড়েছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মহানগরীর সড়কে বেড়ে যায় মানুষের সংখ্যা। বিধিনিষেধে গণপরিবহন বন্ধের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকায় এদিনও দেখা যায়নি বাস চলতে। তবে অন্য সব গাড়ি চলতে দেখা গেছে রাজধানীতে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী, উন্মুক্ত স্থানে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও কাঁচাবাজার ছাড়া বন্ধ থাকার কথা সব দোকানপাট ও বিপণিবিতান। এরপরও অনেক স্থানে দেখা গেছে দোকান খুলতে। অলিগলির ভেতরের প্রায় সব দোকানই খোলা চোখে পড়ে। রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দেখা গেছে। তবে নিয়ম মানায় বাধ্য করতে তাদের তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি। লকডাউনে সরকারি নির্দেশনা কেমন মানা হচ্ছে, তা দেখতে সরজমিনে সকাল ১০টায় মৌচাক থেকে রিকশা নিয়ে রাজধানীর মগবাজার, বেইলি রোড, শান্তিনগর, মালিবাগ, বাংলামোটর ও কাকরাইল এলাকায় প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থান করেন। এসব এলাকায় শুধু বাস বন্ধ দেখা গেছে। অন্য সব যান স্বাভাবিক নিয়মেই চলেছে। অফিসগামী অনেককে দেখা গেছে রিকশা ও মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে।
সকালে রাজধানীর সড়কে মাঝে মাঝে দুই-একটি বাস চলতে দেখা গেছে। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। অনেককেই স্বাস্থ্যবিধি না মেনে রাস্তায় বের হতে দেখা গেছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কোনো বালাই ছিল না রাস্তায়।
লকডাউন পরিস্থিতি নিয়ে রমনা জোনের এডিসি ফাইজুর রহমান বলেন, রমনা ডিভিশনে যেসব কাঁচাবাজার আছে। যেমন, হাতিরপুল আছে, নিউমার্কেট আছে। এগুলো বড় জায়গায়। এগুলো কনজাসটেট না। কাঁচাবাজার মালিক সমিতি, কর্মচারী সমিতি আছে তাদের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। তারা স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করছেন। আমরা এসব জায়গায় ফিল্টারিং করে ঢুকানোর চেষ্টা করছি। বাজারের ভেতরে দোকানদার ও ক্রেতা যারা আছেন তারা যেন মাস্ক পরেন সে বিষয়টি দেখভাল করছি।
তিনি আরও বলেন, আমাদের এলাকার মধ্যে কোনো হোটেলে বসে খেতে দিচ্ছি না। পার্সেল এবং অনলাইন ডেলিভারির যে সার্ভিস আছে সে ধরনের হোটেল খোলা আছে। এ ছাড়া চায়ের দোকানসহ আড্ডার জায়গা যেসব আছে সেগুলো বন্ধ আছে। আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি লকডাউনের সুফল জনগণকে বুঝানোর। নিত্য প্রয়োজনীয় ছাড়া সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ আছে বলেও তিনি জানান। বিভিন্ন গলিতে সবজি, মাছ ও মুরগি বিক্রেতারা অন্য দিনের মতোই বেচাবিক্রি করছেন।
মালিবাগ এলাকার সবজি বিক্রেতা আবুল হোসেন বলেন, প্রথমে রাস্তায় ভ্যান নিয়ে ছিলাম। পরে পুলিশ দেইখ্যা গলির ভেতরে ঢুইকা গেছি। সিদ্ধেশ্বরী এলাকার গলিতে আরিফ হোসেন নামে এক মুদি দোকানি জানান, লকডাউন তাদের জন্য নয়। তারা নিয়ম মেনেই ব্যবসা করছেন। রাজধানীর অনেক প্রধান সড়ক সংলগ্ন এলাকায় দোকানপাট খোলা রেখেছেন অনেকেই। মিষ্টির দোকান, ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান ছাড়াও খোলা ছিল সুপার শপ। খাবার অনেক দোকান খোলা রয়েছে দ্বিতীয় দিনেও। দোকানের শাটার নামানো থাকলেও ভেতরে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
অফিসগামী অনেককেই সকালে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। অনেক অফিসে পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় রিকশা বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা হয়ে উঠেছে ভরসা। অনেক অফিসগামী লোক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় অপরদিকে গণপরিবহনও বন্ধ। এতে রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে অফিসগামী মানুষকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে দেশে সাত দিনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। এই বিধিনিষেধের তৃতীয় দিন চলছে। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সকাল থেকে অফিস ও জরুরি কাজে বাইরে বের হওয়া মানুষদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। রিকশা ও সিএনজি ছাড়া কোনো পরিবহনই পাচ্ছেন না রাজধানীবাসী। অনেকের অফিস খোলা থাকার কারণে তাদের বাইরে বের হতে হচ্ছে। আবার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বা ওষুধের জন্যও কেউ কেউ বের হচ্ছেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে নগরবাসীকে লকডাউন মানতে দেখা যায়নি খুব একটা। তবে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ভোগান্তিতে পড়েন কর্মজীবী মানুষ। মিরপুর ৬-এর বাসা থেকে কলাবাগান রওনা দেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মহসিন আলী। এই পথটুকু যেতে তার খরচ হয় ২৫ টাকা। আজ সেখানে তার খরচ হয়েছে ১৭০ টাকা।
তিনি বলেন, গতকালও কষ্ট করে অফিসে এসেছি আবার ফিরেছি। খরচ হয়েছে ২২০ টাকা। এমনিতেই লকডাউনের কারণে বিপাকে পড়েছি। তার ওপরে আবার অফিস যাতায়াতের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় মাসের খরচের টাকা সপ্তাহেই সাবাড় হয়ে যাবে। মোহাম্মদপুরের আজিজ মহল্লা থেকে ধানমন্ডি ৭ নম্বরের কর্মস্থলে যান বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোহাম্মদ রাইহান খান। বাসে তার খরচ হতো ১৫ টাকা। আজ সকালে তিনি ৮০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে অফিসে যান।
তিনি বলেন, অফিস খোলা রেখেই গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখার মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছে। গাড়ি চলছে না। তাই বাধ্য হয়েই রিকশায় যেতে হচ্ছে। কষ্ট যত আমাদের মতো কর্মজীবী মানুষদের। প্রগতি সরণিতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন সালেক বাবু।
তিনি বলেন, আগে সিএনজিতে প্রগতি সরণিতে যেতে ভাড়া লাগত ১০০ থেকে ১২০ টাকা। সেখানে এখন সিএনজিতে ভাড়া গুনতে হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা।
তিনি বলেন, একদিকে গণপরিবহন বন্ধ আবার সরকারি-বেসরকারি অফিসেও খোলা। যানবাহন নেই বলে আমাদের কষ্টের সীমা নেই। রিকশায় অফিসে আসা-যাওয়া করতে বেশি ভাড়া এখন গুণতে হচ্ছে। ধানমন্ডি থেকে রিকশায় করে মতিঝিল যাচ্ছিলেন বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, আগে লাগতো ৬০ থেকে ৮০ টাকা, এখন সে ভাড়া দিতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১৫০ টাকা। যখন সিএনজি নিতে চাইলাম ভাড়া শুনে তো তাজ্জব। ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা ভাড়া চাইলো সিএনজি চালক। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত মোড় সায়েন্সল্যাব। বেলা বাড়তেই এই এলাকায় মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। প্রচুর জনসমাগম হচ্ছে, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মানা ও চলাচলে নিয়ন্ত্রণ ঠেকাতে সেখানে অভিযান চালাচ্ছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব-৩)। ভ্রাম্যমাণ আদালতকে দেখেই মাস্ক পরে নিতে দেখা যায় অনেককে। কেউ কেউ তো মাস্ক ছাড়াই ঘুরছিলেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন র্যাব-৩ এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু। তিনি বলেন, জরিমানা মূল উদ্দেশ্য নয়। মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সচেতনতা বাড়ানো। মানুষ মাস্কের বিষয়ে ঠুনকো অজুহাত দিচ্ছেন। অনেকেই কম গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্যও বের হচ্ছেন। স্বাস্থ্যবিধি না মানায় জরিমানার পাশাপাশি সতর্ক করা, অসচ্ছল মানুষের মধ্যে বিনা মূল্যে মাস্ক বিতরণ করা হচ্ছে। সকালে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজগেট, সংসদ ভবন মোড় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়কে সোমবারের চেয়ে বেশি যানবাহন চলাচল করছে। কোনো কোনো সড়কে জ্যামও দেখা গেছে। এসব এলাকার প্রধান সড়কের দোকানপাট বন্ধ থাকলেও উপসড়ক ও গলির জীবনযাত্রা ছিল প্রায় স্বাভাবিক। কল্যাণপুর শহীদ মিনার রোড এলাকায় প্রতিদিনের মতো বসেছে কাঁচাবাজার। ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ও ছিল আগের মতোই। সব ধরনের দোকানপাটও খোলা রেখেছেন দোকানিরা। বেশিরভাগ মানুষকেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যায়নি। কল্যাণপুর নতুন বাজার, মিরপুর আনসারক্যাম্পেও একই চিত্র দেখা গেছে। রিকশার চাহিদা বেশি থাকায় রিকশাচালকরা ভাড়া বেশি নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ রাইহান খানের।
তিনি বলেন, প্রতিদিন এভাবে বাড়তি ভাড়া দেয়া আমাদের মতো মধ্যবিত্তের পক্ষে সম্ভব না। আবার অফিসও খোলা, যেতেই হবে। এতো বেশি ভাড়া দিয়ে কিভাবে যাবো? আমরা অনেক বিপাকে আছি।
এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করেছে ব্যবসায়ীরা। করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেশে সোমবার থেকে ৭ দিনের লকডাউন চলছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু মানুষকে সাময়িক সময়ের জন্য বিপাকে পড়তে হচ্ছে। লকডাউনের ফলে অনেক পেশার মানুষই কর্মহীন হয়ে পড়েছিল। এবারও তেমনি আশংকা করছেন অনেক সাধারণ মানুষ। লকডাউনে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দোকানপাট, শপিংমল বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু গতকাল সকাল থেকেই লকডাউনে দোকান খুলে দিতে গাউসিয়া-নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেছেন। আজও সকাল থেকে একই দাবিতে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন রাজধানীর নিউমার্কেট ও মিরপুরসহ একাধিক এলাকার ব্যবসায়ীরা। মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরের পাশে বেলা ১১টার দিকে শতাধিক ব্যবসায়ী ব্যানার হাতে নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের দাবি, লকডাউনে যেন স্বল্প পরিসরে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার জন্য হলেও দোকানপাট খুলে দেয়া হয়। মানববন্ধনে অংশ নেয়া হাবিবুর রহমান বলেন, আমরা পরিবার নিয়ে কীভাবে বাঁচবো। দোকান বন্ধ রাখলে তো উপার্জনের পথও বন্ধ। তাই সরকারের কাছে অনুরোধ যেন স্বল্প পরিসরে হলেও দোকান খুলে দেয়া হয়। শাহ আলী প্লাজার জুতা ব্যবসায়ী জহুরুল হক বলেন, ছোট দোকানের ওপরে নির্ভর করে চলে আমার পরিবারের ৭ জন মানুষ। তাই এই দোকান বন্ধ রাখলে আমরা কীভাবে চলবো। সরকার যেন ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার জন্য হলেও দোকান মার্কেট শপিংমলগুলো খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করে। অপরদিকে মার্কেট খুলে দেয়ার দাবিতে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় সড়কে নেমে বিক্ষোভ করছেন দোকান মালিক-কর্মচারীরা। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের বুঝিয়ে সড়ক থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে গত রবিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। এর আওতায় গণপরিবহন চলাচল বন্ধের পাশাপাশি শপিং মল, দোকান-পাট, হোটেল- রেস্তারাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে ১১ দফা নিষেধাজ্ঞায় সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক জরুরি প্রয়োজনে সীমিত পরিসরে খোলা রাখার সুযোগ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে একুশে বইমেলা ও সিনেমা হলগুলোও।
এদিকে কোনোভাবেই সামাল দেয়া যাচ্ছে না করোনা। আক্রান্ত ও মৃত্যুর বাড়ছে। গতকাল করোনায় মৃত্যু হয়েছে ৬৬ জনের। শনাক্ত ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।