জনপ্রতিনিধি হয়ে পাঁচ বছরে ‘শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়’ গড়েছেন পৌর মেয়র
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪৮ এএম, ১৬ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪৭ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
ফেনীর সোনাগাজী পৌরসভার মেয়র গত ৫ বছর পূর্বে ছিলেন একজন সাধারণ আইনজীবী। ২০১৬ সালে পৌর নির্বাচনে অংশ নেয়ার সময় হলফনামায় বসতভিটা, স্ত্রীর গহনা ও ব্যাংক ব্যালেন্সসহ প্রায় ২০ লাখ টাকার সম্পদের বিবরণ জমা দিয়েছিলেন। মেয়র নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব নেয়ার পর গত পাঁচ বছরে অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, দখল ও নামে-বেনামে প্রকল্প দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে গড়েছেন ‘শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়’। বিগত কয়েক বছর তার বিরুদ্ধে স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ দিলেও অদৃশ্য কারণে কোনোটিরই তদন্ত হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। অবৈধ সম্পদের প্রভাবে ফের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হয়ে মেয়র পদে মনোনয়ন পেতে তদবির চালাচ্ছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম খোকন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পৌর মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর অ্যাড. রফিকুল ইসলাম খোকন সোনাগাজী কাঁচাবাজারে দুটি পৌর মার্কেটের ৬৪টি দোকান বরাদ্দ প্রদানে স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। ২০১৬ সালে কাঁচাবাজারস্থ পৌর মার্কেটের ৬৪টি দোকান বরাদ্দের সময় নির্ধারিত জামানাত ছাড়াও নিজ নামে দোকানপ্রতি বিনারসিদে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা (ম্যানেজ খরচ এর কথা বলে) অতিরিক্ত আদায় করেন। দোকানদারদের জামানতকৃত পৌর তহবিলের প্রায় দেড় কোটি টাকা নিজেই উত্তোলন করে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। এদিকে বিগত ৫ বছরে পৌরসভায় নামসর্বস্ব প্রকল্প দেখিয়ে আত্মসাৎ করেছেন কোটি কোটি টাকা। গুরুত্বপূর্ণ নগর অবকাঠামো উন্নয়ন (আইইউডিপি) প্রকল্পের নামমাত্র কাজ করে প্রায় ১০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের নিজ অর্থায়নে নির্মিত মার্কেটের রাস্তাকে পৌর সড়ক দেখিয়ে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ৩৪ লাখ টাকা বিল পাস করে অর্থ উত্তোলন, বিভিন্ন প্রকল্প নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে ১০ গুণ বেশি টাকায় ভাউচার তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ, নির্মিত প্রকল্প পুনঃনির্মাণের নামে অর্থ লোপাট, পৌরসভার একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প দরপত্রের আগেই কাজ শেষ করে উদ্বোধন, নতুন ভবন নির্মাণ কাজের জন্য পৌরসভা থেকে প্লান অনুমোদনে মোটা অঙ্কের উৎকোচ গ্রহণ, রাজস্ব ও এডিবির প্রাপ্ত টাকায় কোনো প্রকার প্রকল্প কমিটি, টেন্ডার ও রেজুলেশন ছাড়াই নিজেই প্রকল্পের ভাগ-বাটোয়ারা করে অর্থ লুটপাট, পৌরসভার ৯ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে বিপুল অর্থ বাণিজ্য, প্রবাসীর ভূমি দখল ও মুহুরী সেচ প্রকল্প সংলগ্ন ফেনী নদীর পাড় দখলের অভিযোগসহ বহু অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
সোনাগাজী পৌরসভার কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নুরনবী লিটন অভিযোগ করে বলেন, ‘পৌর পরিষদের সভা কিংবা মতাতম ছাড়াই পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। বিগত ৫ বছরে সোনাগাজী পৌরসভা তহবিল মেয়র খোকনের ব্যক্তিগত তহবিলে পরিণত হয়েছে। পৌর পরিষদের সভায় কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই মেয়র নিজের ইচ্ছেমতো আয়-ব্যয় করেন।’
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, গত ৫ বছরে মেয়র খোকন তার নিজ নামে ঢাকার উত্তরায় রাজউকের ৫ কাঠার প্লট ও সোনাগাজীতে ১২টি দলিলে ১০ একর এবং তার স্ত্রী তাসলিমা কাউছারের নামে ৭টি দলিলে ১৭ একর জমি ক্রয় করেন। রাতারাতি কিভাবে মেয়র এত অর্থবিত্তের মালিক হলেন তা প্রশ্নবিদ্ধ! এদিকে নিজের ও স্ত্রীর নামে কেনা জমির বাজার মূল্য প্রায় শতকোটি টাকা হলেও এসব জমি ক্রয়ে রেজিষ্ট্রিকালে ভূমির ধরন পরিবর্তন ও দানদলিল সৃজন করে লাখ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন বলে মেয়র খোকনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। এসব অনিয়ম ও অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য দুদকের চেয়ারম্যান ও সচিবের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন পৌর কাউন্সিলর আওয়ামী লীগ নেতা নুরনবী লিটন ও জেলা পরিষদের সদস্য যুবলীগ নেতা নাছির উদ্দিন আরিফ ভূঞা।
জেলা পরিষদের সদস্য ও উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন আরিফ বলেন, সোনাগাজী পৌরসভার মেয়রের এসব জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি ও পৌর কাউন্সিলর নুরনবী লিটন দুদকে একাধিক লিখিত অভিযোগ করেছেন।
চর খোয়াজের ভূমি মালিক আবদুল মান্নান বলেন, ‘থাক খোয়াজের লামছি মৌজায় আমার ১২০ শতক কৃষি জমি দখল করে মৎস্য খামার করেছে মেয়র খোকন। স্থানীয়ভাবে দেনদরবার করেও দখলমুক্ত করতে পারিনি।’
খোন্দকার গ্রামের নুরনবী বলেন, ‘বড় ফেনী নদীর দু’পাড়ে জেগে উঠা চর দখল করে মৎস্য খামার করেছেন মেয়র খোকন। ওই প্রকল্পের দু’পাশে আমার ১৭ একর জমি দখল করেছেন মেয়র। বাধা দিলে নামমাত্র মূল্য দিয়ে দান দলিল সৃজনের মাধ্যমে মালিক বনে যান খোকন। আমি ছাড়াও তার ওই ১০০ একরের প্রকল্পে অনেক অসহায় কৃষকের জমি রয়েছে।’
এদিকে পৌরসভার সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা সৌদি প্রবাসী মো. শাহজাহান বলেন, ‘২০১৬ সালে পৌর নির্বাচন চলাকালে অর্থ সংকটে পড়ে মেয়র খোকন তার ভগ্নিপতির পাঁচ শতক বাড়ির আঙ্গিনা আমার কাছে বিক্রি করেছিলেন। প্রায় ৫ বছর সময় অতিক্রম করলেও ওই জায়গা এখনও বুঝিয়ে দেননি।’
উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন আরিফ বলেন, মেয়র খোকনের লাগামহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে তথ্য নির্ভর প্রকাশিত প্রতিবেদনের কপিগুলো সংযুক্ত করে জনস্বার্থে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদকে অভিযোগ দিয়েছি।
অর্থ আত্মসাৎ ও ভূমি দখলের অভিযোগগুলো অস্বীকার করে মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে বা হয়েছে সবগুলো মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও মনগড়া। ইতোমধ্যে বিভিন্নভাবে তদন্তে অভিযোগগুলোর কোনো সত্যতা মেলেনি।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচন আসলেই একটা পক্ষ আমার বিরোধিতা করে। যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে তারা নিজেরাই আমার মেয়র পদের প্রতিদ্বন্দ্বী। উপজেলা যুবলীগ নেতা নাছির উদ্দিন আরিফ ও কাউন্সিলর নুর নবী লিটনের সাথে ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব রয়েছে। আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করতে তারা বিভিন্ন দফতরে বারবার অভিযোগ দিয়ে যাচ্ছে।’