ক্ষমতাসিন নেতাদের প্রশ্রয়ে ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলবাসীর মূর্তিমান আতংক কিশোর গ্যাং
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৪৩ পিএম, ২ ফেব্রুয়ারী,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৪০ পিএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা শিল্পাঞ্চলে বিভিন্ন এলাকায় সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়ে গড়ে উঠা উঠতি বয়সী কিশোররাই এখন ফতুল্লাবাসীর আতংকের কারন হয়ে উঠেছে। তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ হয়ে পরেছে ফতুল্লাবাসী। অতিতের মতো শীর্ষ সন্ত্রাসীরা এখন সরাসরি অপরাধের জন্ম না দিলেও উঠতি বয়সী কিশোরদের ব্যবহার করে নানা অপরাধের জন্ম দিয়ে স্বীয় স্বার্থ হাসিল করছে। একদিকে উঠতি বয়সী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের সঠিক তালিকা প্রশাসনের হাতে না থাকায় প্রশাসন ও নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ বা মামলা ব্যতিত তাদেরকে গ্রেফতার করতে পারছেনা। আর এ সুযোগের সদ ব্যবহার করে থানার প্রতিটি এলাকার কিশোর গ্যাং সদস্যরা হয়ে উঠেছে অতিমাত্রায় বেপোরোয়া। আর তাই বলা যায়, শীর্ষ কিংবা তারকা সন্ত্রাসী নয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরাই এখন স্থানীয়বাসীর নিকট মূর্তিমান আতংকে পরিনত হয়েছে।
ধর্ষণ, খুন, মাদক, চুরি, ছিনতাই সহ সমাজ বিরোধী নানা অপকর্মের সাথে সক্রিয় থেকে চায়ের দোকান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের সড়ক, বিভিন্ন অলি-গলি, হোটেল রেস্তোরাগুলোতে কিশোর গ্যাংয়ের একাধিক দলের সদস্য অবস্থান গ্রহণ করে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা দিয়ে থাকে এবং দল বেধে মোটর বাইক নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। চায়ের দোকানগুলোয় সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আড্ডায় মেতে থাকে। আর স্কুল-কলেজের ছুটির সময়ও এদের উৎপাতে অস্থির হয়ে ওঠেন সেখানে আগত অভিভাবকরা। এখন করোনা ভাইরাসের কারনে স্কুল কলেজ বন্ধ থাকলেও রাস্তাঘাটের নিরিবিলি পরিবেশকে তারা মুহূর্তেই অশান্ত করে তোলে। এমনই নানা অভিযোগ স্থানীয়দের।
তথ্য মতে, এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা ফতুল্লা রেল স্টেশন এলাকায় ও শারজাহান রোলিং মিলস এলাকায় পরপর দুটি গণধর্ষনের ঘটনার জন্ম দেয়। তবে প্রশাসনের তৎপরতায় ঘটনার পরপরই জড়িতরা গ্রেফতার হয়। বিশেষ করে শারজাহান রোলিং মিলস এলাকায় সংঘটিত হওয়া গণধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িত ছয় ধর্ষককে ঘটনার ৮ ঘন্টার ব্যবধানে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয় থানা পুলিশ।
লক ডাউনের শুরুর দিকে দেওভোগ এলাকায় সংঘটিত শরীফ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলো একদল কিশোর। ঘটনার রাতেই থানা পুলিশ জড়িত বেশ কয়েক ঘাতককে গ্রেফতার করতে সমর্থ হয়। গ্রেফতারের পর তারা হত্যাকান্ডের কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দী ও দেয়। এ ছাড়া কিশোর গ্যাং সদস্যরা তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায় সময় জড়িয়ে পড়ছে বড় ধরনের সহিংস ঘটনায়।
স্থানীয় সচেতন মহলের অভিযোগ, শীর্ষ স্থানীয় সন্ত্রাসীরা প্রশাসনের ভয়ে এখন আর নিজেরা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়াচ্ছে না। তবে তারা উঠতি বয়সী কিশোরদের ব্যবহার করে তারা জন্ম দিচ্ছে একের পর এক অপরাধ।
পাগলা রেললাইন বটতলা এলাকার এক চায়ের দোকানি এ প্রতিবেদককে বলেন, বেশ কিছু কিশোর তার দোকানে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে থাকে। কিছু বললেই তাকে মারতে আসে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দোকানে বসে থাকে। ছোট্ট বাচ্চা। বয়স মনে হয় ১৫/১৬ বছর হবে। আর এরাই একটার পর একটা সিগারেট টানে। কোনো মুরব্বিও মানে না। যতক্ষণ থাকে তাদের দখলে চলে যায় দোকানটা। তিন-চারজন নয় একসঙ্গে আট-দশজন এসে আড্ডা মারে। এক গ্রুপ চলে গেলে আরেক গ্রুপ এসে আড্ডা মারে। কখনো সখনো আড্ডা নিয়ে ও তাদের মধ্যে মারামারির মতো ঘটনা ও ঘটে। আর এমনই একটি হত্যার ঘটনা ঘটেছিলো গত এক বছর পূর্বে ফতুল্লা রেল লাইন বটতলা এলাকায়।
জানা যায়, কিশোরদের এই গ্রুপগুলো ফতুল্লায় বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়। একেক জায়গায় একেক গ্রুপ বসে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি মোটরসাইকেলে তিনজন করে আসে। চায়ের দোকানে ভিড় করে হইহুল্লোড় করেই ক্ষান্ত হয় না কিশোর গ্যাংয়ের ওই দলগুলো। ফতুল্লা, দাপা বিভিন্ন এলাকায় বেড়াতে আসা সাধারণ মানুষদেরও উত্ত্যক্ত করে তারা। বিশেষ করে কোনো প্রেমিক যুগলকে একসঙ্গে বসে গল্প করতে দেখলে নানাভাবে বিরক্ত করে। এতে কেউ ক্ষিপ্ত হলে তার ওপর চড়াও হয়।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, একদল কিশোর যাদের বয়স ১৬/১৭ বছর। কারো পরনে পাঞ্জাবী। আবার কেউ সাধারণ পোশাকে। ফতুল্লা রেল স্টেশন দিয়ে শারজাহান রুলিং মিল রেল লাইনের দিকে একটু এগিয়ে দেখা মেলে তাদের। একসাথে প্রায় ১৫/২০ জন দল বদ্ধ হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। পার্শ্ববর্তী এক ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে জানা গেল, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই চটপটি ব্যবসায়ী জানান, প্রায়ই তার দোকানে এসে আড্ডা দেয় কয়েকটি গ্রুপ। তবে একাধিক গ্রুপ একসঙ্গে আসে না। তাদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্ধের কারণে কেউ কারো সামনে আসে না। এদের মধ্যে মারামারির ঘটনা হয়। মাঝে মাঝে এই রাস্তার উপরই মারামারি শুরু করে। মারামারির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই চটপটি ব্যবসায়ী বলেন, কি নিয়ে মারামারি হয় সেটা তাদের আগে থেকেই ঠিক করা থাকে। তবে একই এলাকায় ‘সিনিয়র-জুনিয়র’ হওয়া নিয়ে মারামারি বাঁধে। কয়েকবারই দোকানের সামনে এসে মারামারি করেছে। মাঝে মাঝে তাদের এসব কান্ড দেখে ভয়ে অনেকে এখানে বসতে চান না।
এদিকে থানার বিভিন্ন এলাকার মতো কিশোর গ্যাংগুলোর আতংকে আতংকিত দাপা ইদ্রাকপুরবাসী। এ সকল কিশোর গ্যাং সদস্যরা কোনো প্রকার কারন ছাড়াই মিথ্যা অজুহাত তৈরী করে মোবাইল ছিনিয়ে নেওয়ার মতো অপরাধ খুব সহজেই করে থাকে। কিশোর গ্যাংয়ের প্রতি এলাকার শীর্ষ স্থানীয় সরকার দলীয় বড় ভাই এবং শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আর্শীবাদ থাকায় প্রতিবাদ করার সাহসটুকু পর্যন্ত কেউ করে থাকেনা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিশোর হওয়ার কারণে দন্ডবিধিতে পুলিশ এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, ১৮ বছর বা এর কম বয়সী শিশু-কিশোরের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের জেলে নেওয়ার পরিবর্তে উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠাতে হবে, যাতে তারা সংশোধিত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে। তাই তাদের আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠাতে হয়। বয়সে কিশোর হওয়ার সুবাধে শাস্তির আওতায় আনতে আইনের যথেষ্ট ফাঁকফোকর থাকায় এর সুযোগ নিচ্ছে এসব গ্যাংয়ের লিডারসহ বাকি সদস্যরা। অনেক বড় বড় অপরাধ ঘটিয়েও বয়সের অজুহাতে সহজেই পাওয়া যাচ্ছে জামিনে বের হওয়ার সুযোগ। জামিনে বাইরে এসে এরা আবারও জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।