পলাশের রুগীর কালিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মামলার ধরন পাল্টে দিতে জখমি সার্টিফিকেটে অনিয়ম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭:৫৮ পিএম, ২৯ মে,রবিবার,২০২২ | আপডেট: ১১:৩১ এএম, ১৮ নভেম্বর,সোমবার,২০২৪
অপরাধীকে বাঁচাতে জখমি সার্টিফিকেটে ধারালে অস্ত্রের স্থলে ভোতা অস্ত্রের আঘাত দেখিয়ে সার্টিফিকেটের ধরন বদলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা: লুবনা খানমের বিরুদ্ধে এবং ওই অসংগতি সার্টিফিকেট সংশোধনের আশ্বাস দিয়ে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি ও অশোভন আচরণের অভিযোগ উঠেছে কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মঞ্জুর এলাহীর বিরুদ্ধে। এর প্রতিকার চেয়ে গত ২৩ মে ২০২২ সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিষ্টার বরাবরে প্রকৃত জখমের চিকিৎসা সনদ ও অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদানের আবেদন জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের ইসলামপাড়া গ্রামের পাথর ব্যবসায়ী কামরুল হোসাইন, তার ভাই কাপড় ব্যবসায়ী খাইরুল ও মূসা মিয়া নামে তিনজন ভোক্তভোগী। অভিযোগের অনুলিপি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সির্ভিল সার্জন গাজীপুর বরাবরে জমা দেওয়া হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ভোক্তভোগী কামরুল হোসাইন ও তার ভাই খাইরুল গত ৩ এপ্রিল রাতে কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে বাড়ি ফেরার পথে সন্ত্রাসীরা তাদের পথ আটকিয়ে চাইনিজ কুড়াল ও রাম দা দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ব্যবসায়িক ১১ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। তাদের ডাক চিৎকারে প্রতিবেশী মুসা মিয়া তার ছেলে স্বাধীন ও ইমন এগিয়ে আসলে তাদেরকে ও কুপিয়ে জখম করে তারা। পরে স্থানীয় এলাকাবাসী উদ্ধার করে পলাশ-কালিগঞ্জ সীমান্তবর্তী এলাকা কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার ডাক্তার লুবনা খানম যার কোড নং- ১২২৬৫১ তার ভাই খাইরুল ইসলাম ও মুসা মিয়ার মাথায় প্রায় ৩০ টা সেলাই করেন। অন্য দিকে আহত কামরুলের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফাড করেন। পরে কামরুলের স্বজনরা রাত পৌঁনে এগারটার দিকে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার তার হাতের মাংসের ভিতর ও বাহিরের তিনটি স্থরে আঠাশটি সেলাই করেন এবং ওই হাসপাতালে আহতদের ভর্তি দেন। এরপর পলাশ থানা পুলিশ তদন্ত করে একটি মামলা রেকর্ড করেন। যার মামলা নং ০১, তারিখ ৪ এপ্রিল ২০২২। দীর্ঘ চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জানতে পারেন, কালীগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে তাদের জখমের যে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে সেখানে কোন ধারালো অস্ত্রের আঘাতের কথা উল্লেখ নাই। এমনকি (শার্প কাটিং গিভিয়াস) এর স্থলে সবগুলো সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে (ব্লান্ট উইপন সিম্পল) বলে। যা তাদের শরীরের আঘাতের সাথে হাসপাতাল থেকে দেওয়া জখমি সার্টিফিকেটের বাস্তব মিল নেই।
পরবর্তীতে এই অসংগতিপূর্ণ সার্টিফিকেট সংশোধনে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ মঞ্জুর এলাহীর দারস্থ হলে তিনি শরীরের আঘাতের চিহ্ন, ওই সময়ের জখমের ছবি দেখে হাসপাতালের অন্য ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করে সার্টিফিকেট সংশোধন করে দেওয়ার আশ্বস্ত করে মূল কপি আনতে বলেন। মূল কপি আনার পর লিখিত দেওয়ার কথা বলেন। তাতেও রাজি হলে বলেন ডুপ্লিকেট কপি আসামি পক্ষের হাতে গিয়ে থাকলে একটা ঝামেলা হতে পারে। এসব কথা বলে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি ও অশোভন আচরণ করতে থাকেন। সার্টিফিকেট সংশোধন করে দিবে না বলে অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন।
অভিযোগে বলা হয়, আসামী পক্ষের করিম নামে একজনকে এ ঘটনার এক দিন পর ওই হাসপাতালের রেজিস্টার এন্টি দেখিয়ে ওই মাসের ২৬ তারিখের কোন এক প্রাইভেট ক্লিনিকের এক্স-রেফারেন্স দেখিয়ে হাত ভাঙ্গার গিভিয়াস সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। অথচ এ ঘটনার পর থেকে ঐ লোক এলাকায় সুস্থ-স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করছে।
অভিযোগকারি কামরুল হোসাইন বলেন, তাঁর ডান হাতে সন্ত্রাসীদের ধারালো অস্ত্রের কোপ এতটা গুরুতর ছিলো যা কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক সেলাই করতে না পেরে তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করেন।
জখমি সার্টিফিকেটে অসংগতি ও রেফারের বিষয় জানতে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. লুবনা খানমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কামরুল হোসাইনের ডান হাতের জখম স্থান থেতলানো থাকায় এক্সরে ব্যতীত সেলাই দেওয়া সম্ভব ছিলোনা। রাতের বেলায় এক্সরে করার সুযোগ না থাকায় ওই রোগীকে রেফার করা হয়েছে। এ ছাড়া অন্য রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
সার্টিফিকেট প্রসঙ্গে তিনি জানান, সার্টিফিকেটে কোন অসংগতি নেই। কামরুল হোসাইনকে সঠিক সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে, কালিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মঞ্জুর এলাহীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কামরুল হোসাইনের দুই হাতেই ইনজুরি ছিলো এক হাতের গিভিয়াস দেওয়া হয়েছে। অন্য হাতের কোপের স্থান এ্যাবড়ো থেবড়ো থাকায় গিভিয়াস দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া তিনি যে এক্স-রে রিপোর্টগুলি এনেছে তা সঠিক নয়। আমরা এ বিষয় নিয়ে টিম বসিয়ে দেখেছি কর্তব্যরত ডাক্তার যে সার্টিফিকেট দিয়েছেন তা সঠিক আছে। সার্টিফিকেটে কম-বেশি লেখার সুযোগ নেই। সার্টিফিকেটের মুল কপি আনতে বলা লিখিত দিয়ে সার্টিফিকেট পরিবর্তন ও আসামী পক্ষের কাছে ডুপ্লিকেট কপি আছে কিনা এমন প্রসঙ্গ আনতেই এ কর্মকর্তা বলেন, মুল সার্টিফিকেট আনতে বলেছি সত্য, তবে অন্য যে অভিযোগ গুলো করা হয়েছে তা সঠিক নয়।
এ বিষয়ের গাজীপুরের সির্ভিল সার্জন ডা:মো: খায়রুজ্জামানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অধিদপ্তরের যদি অভিযোগ করে থাকে অধিদপ্তর আমাদের নির্দেশনা দিবে। আমরা তদন্ত করে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিব।
পলাশ থানার ওসি তদন্ত সফিকুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পরে পলাশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আহতদের দেখতে গিয়ে কামরুল হোসাইনের ডান হাতের জখম তিনি দেখেছেন। জখমের ধরণ দেখে মনে হয়েছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক জখম স্থান সেলাই দিতে না পেরে তাকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করেছেন। পরে পলাশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. নিয়াজ মোর্শেদ হক জখমি স্থানে তিন স্তর বিশিষ্ট সেলাই করেন। এ ঘটনায় পলাশ থানায় মামলা হয়েছে। যার মামলা নং ০১ তারিখ ৪ এপ্রিল ২০২২। বর্তমানে মামলাটি নরসিংদীর ডিবিতে তদন্তাধীন আছে বলে জানান পলাশ থানার তদন্ত কর্মকর্তা।