উজানের ঢলে বাড়ছে হাওরের পানি, উৎকণ্ঠায় লাখো কৃষক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১২ এএম, ৫ এপ্রিল,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:২৭ এএম, ২১ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
শাল্লার দাড়াইন নদীর পানি যেভাবে বাড়ছে এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছে এলাকার কৃষকরা। গতরাতেও প্রায় ৪ ইঞ্চি পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। হাওর পাড়ের তলানি উপজেলা শাল্লার কৃষকের সময় অতিবাহিত হচ্ছে উৎকন্ঠার মধ্যে। উজানে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি এখন বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এই উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা কৃষক লীগ আহবায়ক রঞ্জিত কুমার দাস। যদি আগামী ২/৩ দিন এই হারে পানি বৃদ্ধি পায় তাহলে ২০১৭-এর মতো ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। উপজেলার ছোট ছোট বেশ কয়েকটি হাওর পাউবোর আওতায় না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বর্তমান পরিস্থিতিতে। উপজেলার এই সব হাওর হলো শাল্লা সদর নিকটবর্তী জোয়ারিয়া, কৌইয়া, কোনারবন, পুইট্টা, নাইপতার চর। দামপুর গ্রামের পাশে বাঘার হাওরে প্রায় ৩ হাজার একর বোরো ফসলি জমি হুমকির মুখে। জোয়ারিয়া হাওরের কৃষক ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গ্রামের মিটু চন্দ্র দাস জানান, দুই বছর আগেও এসব হাওরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ করেছিল। হঠাৎ করে বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করে দেয়ায় আজ এসব ছোট হাওর হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি জানান, এসব হাওরের কৃষকরা তাদের একমাত্র স্বপ্নের ফসল রক্ষার্থে জমির পরিমাণ অনুযায়ী টাকা উত্তোলন করে বাঁধে দিনরাত মাটি কাটছে।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ইউএনও ও জনপ্রতিনিধিরা অনেকই বাঁধ পরিদর্শন করেছেন। এসময় সহায়তার আশ্বাসও দেন তারা। কিন্তু রবিবার ১১টা পর্যন্ত সরকারি কোন প্রকার আর্থিক সহায়তা করা হয়নি।
জাতীয় পার্টির সাধারণ সম্পাদক কালিপদ রায় বললেন, শাল্লায় বয়ে যাওয়া দাড়াইন নদীতে যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে আতংকে রয়েছে কৃষকরা। ফলে লাখো কৃষকের মাঝে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। ফসল রক্ষার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থানীয় লোকজন। এখন ঈশ্বর উপর ভরসার আর এলাকার কৃষকের বাঁধ নির্মাণের সংগ্রাম মিলে যদি শেষ রক্ষা হয় । পুইট্টা হাওর পাড়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অনাদী তালুকদার বললেন, ২০১৭ সালের পর চৈত্র মাসের এই সময়ে এতো পানি নদীতে আর দেখিনি। ছায়ার হাওরের বেড়িবাঁধের বাইরের ছোট ছোট কয়েকটি হাওরের ফসল নিয়ে চিন্তায় আছি। কখন যে কি হয় বলা মুশকিল।
তিনি আরো বলেন, গত দুবছর আগে ও এসব হাওরে পাউবো বাঁধ নির্মাণ করেছিল, এবার নেই। এসব ছোট হাওরে ছোট ছোট পাউবো প্রকল্প দিলে কয়েক হাজার একর জমি বন্যা থেকে নিরাপদে থাকতো। আজ এসর হাওর নিয়ে দিন রাত কৃষকের ঘুম হারাম হতো না। কৃষক রক্ষার্থেই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছে সরকার। তবে ওরা কেন এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো আমার বোধগম্য নয়। একারণে এই সব হাওরের কৃষকদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। শাল্লা হাওর রক্ষা বাঁধের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার ১১টায় কথা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পাউবো সভাপতি মোঃ আবু তালেবের সঙ্গে।
তিনি জানান, বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি আমরা নজরদারি করছি। উপজেলার ঝুঁকিপুর্ণ ২২টি ক্লোজারের সভাপতি সম্পাদকদের নিয়ে গতকাল এক জরুরি সভা ডাকা হয়েছিল। সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে এই সব গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলোতে রাতে পাহারাসহ ২৪ ঘণ্টা নজরদারি রাখার জন্য। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জরুরি সমস্যা সমাধানের জন্য একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপনসহ নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম বললেন, এপ্রিলের দুই তারিখে বা চৈত্র মাসের এই সময়ে এতো পানি সুনামগঞ্জের কৃষকরা গেল চার বছরে দেখেননি। ৩১শে মার্চ রাতে ভারতের চেরাপুঞ্জি ও আসামে ১৯১ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। সুনামগঞ্জের হাওরে পানির বিপদসীমা ৬.৫ সেন্টিমিটার, শনিবার পানির উচ্চতা ছিল নদীতে ৪.৮০ সেন্টিমিটার। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।
তিনি জানান, অতীতের রেকর্ড অনুযায়ী দুই এপ্রিলে ২০১৮ সালে নদীর পানির উচ্চতা ছিল ১.২২ সেন্টিমিটার, ২০১৯ সালে ০.৮৫ সেন্টিমিটার, ২০২০ সালে ০.৬৩ সেন্টিমিটার, ২০২১ সালে ২.০৩ সেন্টিমিটার। এবার ৭২৭ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি জেলার বৃহৎ ৪২টি হাওরে ১২১ কোটি টাকার ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ করেছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ—পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বললেন, নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত দেখে শুক্রবার রাতে আমিও ঘুমোতে পারিনি। নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরও অনেক হাওরেই বিপদ হতে পারে বলে মন্তব্য করলেন তিনি।
তিনি জানান, এবার সুনামগঞ্জে দুই লাখ ২২ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ করে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ২২০ মে.টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ আবু সাঈদ জানালেন, রোববারও সুনামগঞ্জে এবং উজানে (মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে) বৃষ্টি হয়েছে। সোমবার থেকে পরবর্তী ৫ দিন বৃষ্টি কম থাকবে। এরপর আবার বৃষ্টি হতে পারে।
জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বললেন, গত দুতিন দিনে চেরাপুঞ্জি ও আসামে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে দুশ্চিন্তার কারণ হয়েছে। সকল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের শনিবার সকালেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পাউবো, পিআইসির লোকজন ও স্থানীয় জনপ্রনিধিদের নিয়ে পর্যাপ্ত বস্তাসহ বাঁধে বাঁধে অবস্থান নেবার জন্য। তিনি জানান, সপ্তাহ খানেকের মধ্যে হাওরে ধানা কাটা শুরু হবে।