নোয়াখালী হাসপাতালে ডা. ফজলে এলাহীসহ ৯ জনের ‘সাগরচুরি’
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:০০ এএম, ৪ মার্চ,শুক্রবার,২০২২ | আপডেট: ০৪:৪৫ এএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
নোয়াখালীর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের (আমাউমেক) নেফ্রোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফজলে এলাহী খানের সরবরাহ করা এক টেবিলের দাম চার লাখ ৯০ হাজার টাকা ধরা হলেও বাস্তবে এর আনুমানিক বাজারমূল্য ১০ হাজার টাকা হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নোয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের এক তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেই আড়াই কোটি টাকা আত্মসাৎসহ এ খাতে ডা. এলাহীদের ‘সাগরচুরির’ প্রমাণ পেয়েছে দুদক। ২০২০ সালের শেষ দিকে নোয়াখালী দুদকের সহকারী পরিচালক সুবেল আহমেদ ডা. ফজলে এলাহী খানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দাখিল করলেও অজ্ঞাত কারণে গত দেড় বছরেও মামলা রুজু হয়নি। অভিযুক্ত নোয়াখালী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ও আমাউমেকের সহকারী অধ্যাপক ডা. ফজলে এলাহী খানকে (কোড নং-১১১৭৭২) ওএসডি করে চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রোগ্রাম ম্যানেজার-১ (পদের আইডি-১৬৭৪৬৩) হিসেবে বদলি করা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তরা হলেন- হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. এএইচএম মোসলেহ উদ্দিন (৬৫), মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাক্টওয়েল টেকনোলজি (বিডি) লিমিটেডের চেয়ারম্যান নাসরিন চৌধুরী (৪৫), তার স্বামী ব্যবস্থাপনা পরিচালক জায়েদুল করিম চৌধুরী ওরফে পলাশ চৌধুরী (৪৯), মেসার্স শাহজাহান চৌধুরীর মালিক মো. শাহজাহান চৌধুরী (৬৬), সাবেক আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী (৫৩), সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি) ডা. এ কে এম ফজলুর রহমান ওরফে ফজলুর রহমান মানিক (৪৯), আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মহিউদ্দিন হুমায়ুন কবির চৌধুরী (৪৬), একই কলেজের আরেক সহকারী অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মো. কামরুল হোসেন (৪৩)।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন। এতে ১০টি আইসিইউ বেডসহ মোট আটটি আইটেম সরবরাহ না করেই সরকারের দুই কোটি ৪০ লাখ ৭৫ হাজার ৮০৪ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তিনটি পেশেন্ট মনিটর বাবদ ১৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে একটি হসপিটাল অটোমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বাবদ ২০ লাখ ৫০ হাজার টাকা, একটি সাউন্ড সিস্টেম বাবদ ২০ লাখ ১৩ হাজার ৭২০ টাকা, একটি ফ্রন্ট প্যানেল লাইটিং বাবদ ১০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা, ১০টি ইনসেন্টিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) বেড বাবদ ৩৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, অপারেশন থিয়েটারের (ওটি রুম) ১২টি অবজারভেশন টেবিল বাবদ ৪৩ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪ টাকা, একটি ডেন্টাল চেয়ার বাবদ ২০ লাখ ৭০ হাজার টাকা, দুটি ফোরডি-পোর্টেবল আলট্রাসাউন্ড মেশিন বাবদ ৭১ লাখ টাকার কোনো পণ্যই সরবরাহ না করে ওই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, যেসব পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে তার সবই নিম্নমানের। এরমধ্যে সরবরাহ করা ছোট আকারের একটি কনফারেন্স টেবিল যার আনুমানিক বাজার মূল্য হবে ১০ হাজার টাকা, অথচ তার ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে চার লাখ ৯০ হাজার টাকা। আর সাড়ে ১৫ লাখ টাকার ‘ব্লাড সেল কাউন্টার’ সরবরাহ করা হলেও তা কখনো ব্যবহার করা হয়নি।
এদিকে এসব পণ্য ক্রয়ে যথাযথ নিয়মে দরপত্র আহ্বান করা হয়নি বলেও তদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে মালামাল ক্রয়ের জন্য ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। এগুলো হলো- অ্যাক্টওয়েল টেকনোলজি (বিডি), মেসার্স পলাশ চৌধুরী ও মেসার্স শাহজাহান চৌধুরী। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তিনটি দরপত্রের মধ্যে দুটি দরপত্রই নন-রেসপনসিভ ছিল এবং অ্যাক্টওয়েল টেকনোলজি (বিডি) লিমিটেডের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বে¡ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন করা হয়। অন্যদিকে চুক্তির শর্তানুযায়ী মালামাল বিদেশ থেকে এলসির মাধ্যমে আমদানির কথা থাকলেও অ্যাক্টওয়েল টেকনোলজি (বিডি) প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো এলসি খোলেননি এবং বিদেশ থেকেও কোনো মালামাল আমদানি করেননি। এ থেকে তদন্ত কর্মকর্তা নিন্ডিত হন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও সার্ভে কমিটির সদস্যরা পরস্পরের যোগসাজশে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে স্থানীয় বাজার থেকে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ দেখিয়ে বিল উত্তোলন করেছেন। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সার্ভে কমিটিতে ছিলেন ডা. ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, ডা. মহিউদ্দিন হুমায়ুন কবির চৌধুরী ও ডা. সৈয়দ মো. কামরুল হোসেন। অন্যদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সার্ভে কমিটিতে ছিলেন, ডা. ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী, ডা. ফজলে এলাহী খান ও ডা. এ কে এম ফজলুর রহমান ওরফে ফজলুর রহমান মানিক। ২০২০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদফতরের উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরাসহ সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেও অ্যাক্টওয়েল টেকনোলজি (বিডি) লিমিটেডের সরবরাহ করা পণ্যের মডেল ও ব্র্যান্ড ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় পণ্য শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ওই বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন- কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের উপপরিচালক (সিএমএসডি) ডা. মো. নিজাম উদ্দীন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল-৪) ডা. মো. আহসানুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. শহিদুল ইসলাম, মহাখালী নিমিউ অ্যান্ড টিসির সহকারী প্রকৌশলী (ইলেকট্রনিক্স) এমএন নাশিদ রহমান ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হসপিটাল সার্ভিসেস ম্যানেজমেন্ট (ডিপিএম) ডা. সুরজিৎ দত্ত।
তদন্ত কর্মকর্তা নোয়াখালী দুদকের সহকারী পরিচালক সুবেল আহমেদ বলেন, ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের (সজেকা) ৮২৯ নম্বর স্মারকমূলে আমাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্ত শেষে ৯ জনকে অভিযুক্ত করে সরকারি টাকা আত্মসাতের মামলার সুপারিশ করে ২০২০ সালের শেষের দিকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের সাবেক সহকারী অধ্যাপক ও বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরে প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. ফজলে এলাহী খান বলেন, দুদকের তদন্তের বিরুদ্ধে পুনঃতদন্তের আবেদন করা হয়েছে। দুদকের নোয়াখালী সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (ডিডি) সৈয়দ তাহসিনুল হক প্রথমে ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে প্রতিবেদনের কপি হাতে এসেছে বলার পর তিনি বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ডা. এ এইচ এম মোসলেহ উদ্দিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় এবং বাকি অভিযুক্তরা মোবাইল ফোন পরিবর্তন করে ‘গা-ঢাকা’ দেয়ায় তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।