আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রেম, ৫৫ বছরের বানুর সঙ্গে ৬২ বছরের আশরাফের বিয়ে
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৫৯ এএম, ২১ ফেব্রুয়ারী,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:০২ পিএম, ১৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৪
শারীরিক প্রতিবন্ধী আশরাফ আলী ব্যাপারী (৬২)। কয়েক মাস আগে বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার চাখার ইউনিয়নের সোনাহার গ্রামের শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ওঠেন। সেখানেই পরিচয় হয় বানু বেগমের (৫৫) সঙ্গে। ধীরে ধীরে একে অপরের মধ্যে তৈরি হয় ভালোলাগা। সেই ভালোলাগা থেকেই ভলোবাসা। তবে দুশ্চিন্তায় ছিলেন তারা। এ বয়সে তাদের সম্পর্ক জানাজানি হলে লোকে কী বলবে এ চিন্তায় দিন কাটছিল। গোপনেই প্রেম চালিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। অবশেষে সম্প্রতি বানুর স্বজন এবং আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের মধ্যে বিষয়টি জানাজানি হয়। তবে কেউ তাদের প্রেমে বাধা হননি। উল্টো চারহাত এক করতে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। চাখার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুল হক টুকু ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের উদ্যোগে আশরাফ আলী এবং বানু বেগমের বিয়ে দেয়া হয়েছে। মহা ধুমধামে শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) রাতে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। এর আগে ফুল-রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয় বর-কনের বাড়ি। দুদিন ধরে চলে অনুষ্ঠান। গান-বাজনা, হৈ-হুল্লোড় কোনো আয়োজনেরই ছিল না কমতি। এ যেন উৎসবে রূপ পায়। বিয়ের প্রীতিভোজে আমন্ত্রিত ছিলেন পাঁচ শতাধিক অতিথি। আশ্রয়ণ প্রকল্পে এটিছিল প্রথম কোনো বিয়ের আয়োজন। এ কারণে বিয়ের আগে শুক্রবার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানও জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে করা হয়। এতে বর-কনে ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ছাড়াও দুই শতাধিক অতিথি উপস্থিত ছিলেন। অতিথিরা বর-কনেকে হলুদ মাখিয়ে দেন। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে অতিথিদের মিষ্টি, পিঠা ও পায়েস দিয়ে মিষ্টিমুখ করানো হয়। শনিবার রাত ৮টার দিকে বিয়ের আসরে আনা হয় বর-কনেকে। ছেলে পক্ষের উকিল ছিলেন চাখার ইউনিয়নের বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান মিনাল সিকদার। কনে পক্ষের উকিল হন চাখার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুল হক টুকু। বিয়ে পড়ান স্থানীয় কাজি মাহমুদুল হাসান। রাতে একই স্থানে বিবাহোত্তর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সবাই নববিবাহিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দোয়া করেন। সেখানেই হয় প্রীতিভোজ অনুষ্ঠান। সবার জন্য ছিল বিরিয়ানি, মিষ্টি ও কোমল পানীয়। আশ্রয়ণ প্রকল্পের কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শারীরিক প্রতিবন্ধী আশরাফ আলী ব্যাপারী একসময় থাকতেন বানারীপাড়ার জম্বদ্বীপ এলাকায়। সেখানে তার ঘর ছিল। সংসারও ছিল। কিন্তু ১৫ বছর আগে নদী ভাঙনে তার ঘর বিলীন হয়ে যায়। এরপর তিনি ভিক্ষা করেই সংসার চালাতেন। অভাবের কারণে স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান। সেই থেকে নিঃসঙ্গ জীবন কাটছিল তার। আশরাফ আলী কয়েক মাস আগে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বরাদ্দের ঘরে ওঠেন। অন্যদিকে ২০ বছর আগে সন্তানসহ বানু বেগমকে রেখে চলে যান তার স্বামী। তিনি বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করে একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেন। কয়েকমাস আগে তার মেয়ে জামাই সুমন আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পান। এরপর থেকে মেয়ে ও মেয়ে জামাইর সঙ্গে আশ্রয়ণ প্রকল্পে বাস করছেন বানু বেগম। সম্প্রতি তাদের প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হয়। তবে প্রথমে তারা লজ্জায় এ বিষয়ে কিছুই বলতে চাননি। কয়েকদিন তারা নিজেদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ করে দেন। পরে চেয়ারম্যান ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা তাদেরর চার হাত এক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিয়ের আয়োজনের সব খরচ বহন করেন চেয়ারম্যান মজিবুল হক টুকু। প্রেমের সম্পর্ক বিয়েতে রূপ নেওয়ায় খুশি আশরাফ আলী।
তিনি বলেন, এতদিন নিঃসঙ্গ ছিলাম। আপন বলতে কেউ ছিল না। কয়েকমাস আগে বানু বেগমের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার জীবনও অনেকটা আমার মতো। সুখ-দুঃখের কথা বলতাম। সেও অনেক কথা বলতো। তার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগতো। কিন্তু তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবো, এমন ধুমধাম বিয়ের আয়োজন হবে, আগে ভাবতে পারিনি। তবে চেয়ারম্যান ও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা পাশে দাঁড়িয়েছে বলে আমাদের সম্পর্ক বিয়েতে রূপ নিয়েছে। বানু বেগমও আনন্দিত। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। ইউপি চেয়ারম্যান মজিবুল হক টুকু বলেন, বানু বেগমের মেয়ের মুক্তা আক্তারের কাছে প্রথমে বিষয়টি জানতে পারি। এরপর আশরাফ আলী ব্যাপারীর সঙ্গে কথা বলি। কথা বলি বানু বেগমের সঙ্গেও। প্রথমে তারা লজ্জা ও সংকোচে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে তাদের গভীর সম্পর্ক বুঝতে পেরে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে আশরাফ আলী ও বানু বেগমের বিয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ধুমধাম বিয়ের আয়োজন করা হয়। তাদের মধুর প্রেমের পরিণতি রূপ নিলো বিয়েতে। চেয়ারম্যান আরও বলেন, এ বিয়েতে আরও একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে। তাদের বিয়ে পড়ান কাজী মাহমুদুল হাসান। আশরাফ আলী ও বানু বেগমের বিয়ের মধ্য দিয়ে কাজি মাহমুদুল হাসান ১০০টি বিয়ে পড়ানোর কাজ শেষ করেছেন। এ কারণে কাজি মাহমুদুল এ বিয়ে পড়িয়ে একটাকাও খরচ নেননি।