রায়ের পরও মিলছে না ভাতা, মানবেতর দিন কাটছে বীর মুক্তিযোদ্ধার
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:১৯ এএম, ১৪ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:৪০ পিএম, ২২ নভেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
মুন্নু মিয়া। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার গুনবহা ইউনিয়নের চন্দনী গ্রামে। বাবার নাম মৃত আবুল হোসেন মিয়া। তিনি জীবনবাজি রেখে প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে যুদ্ধ করেছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হয়েছে, নিজেরাও পেয়েছিলেন স্বাধীনতার স্বাদ। তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। পাচ্ছিলেন ভাতাও। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তিনি। দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে। এক সময় তিনি বোয়ালমারী উপজেলা পরিষদে নাইটগার্ড হিসেবে চাকরি করতেন। কিন্তু বয়স হওয়ায় তিনি আর কাজ করতে পারেন না। মানুষের কাছ থেকে ধার-কর্য করে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক মিয়া মুন্নু বলেন, হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই বন্ধ হয়ে যায় আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। বিভিন্ন দফতরে ঘোরাঘুরি করে ভাতা চালু করতে না পেরে দ্বারস্থ হই উচ্চ আদালতের। ভাতা পাওয়ার জন্য রিট আবেদন করেন তিনি। আদালত তার পক্ষে রায়ও দেন। আদেশ দেন যে তারিখ থেকে ভাতা বন্ধ হয়েছিল সেই মাস থেকেই ভাতা চালু করতে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজও চালু হয়নি তার মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা। এ নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি। মানুষের সহযোগিতা নিয়ে দিন যাপন করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্নু মিয়া!
মুন্নু মিয়ার ভাষ্যমতে, ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেলায় পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। এ বিষয়ে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার মো. জামিল হাসান (বিপি নং-৭১০১১১৬৪৫৮) ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের ক্যান্ডিডেট রেজিস্টার অনুযায়ী মুন্নু মিয়ার সিরিয়াল নং ১০৬। এরপর তিনি রাজশাহী ইপিপিআরে (পুলিশ লাইন্স) যোগদান করেন। যার নং কনস্টেবল/৩২২ (রাজশাহী)। রাজশাহীতে পুলিশে কর্মরত অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ তিনি সম্মিলিতভাবে রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২৪ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে পাক-বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেন। পরে পাকিস্তানিরা রাজশাহী পুলিশ লাইন্স দখল করে নিলে পালিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে ভারতের মুর্শিদাবাদে চলে যান। সেখান থেকে কলকাতা বাংলাদেশ মিশনে ১নং সেক্টরে যোগদান করেন। ১০ নভেম্বর জেনারেল ওসমানি কমান্ড সার্টিফিকেট দিয়ে ভোলারহাট থানার জোনাল অফিসার মালদহের কাছে প্রতিবেদন করার নির্দেশ দেন এবং ২৭ ডিসেম্বর শিবগঞ্জ থানায় বদলি করেন।
তিনি জানান, শিবগঞ্জ থানায় কর্মরত থাকাকালীন বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা দেয়, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্য যে জেলায় কর্মরত ছিলেন ওই জেলায় পুনরায় চাকরিতে যোগদান করবেন। ওই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মুন্নু মিয়া ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে পুনরায় যোগদান করেন। পরে রাজশাহী জেলায় কর্মরত থাকা অবস্থায় ঠিকমতো বেতন-ভাতা না পাওয়ায় স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে চলে আসেন।
মুন্নু মিয়ার বিভিন্ন কাগজপত্র, দলিলপত্র সূত্রে জানা যায়, হেডকোয়ার্টার্স স্মারক নম্বর কল্যাণ/৬-৯৮/১৯৯০ (১০০), তারিখ ১১.০৭.৯৯ খ্রি. এর ২০ পাতায় মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় মুন্নু মিয়ার নাম অন্তর্ভুক্ত আছে বলে পুলিশের এআইজি (কল্যাণ) মো. হুমায়ুন কবীর প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। একই বিষয়ে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মো. আরিফুর রহমান ২০০১ সালের ১২ অক্টোবর একটি সনদপত্র দিয়েছেন। ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা গ্রন্থে’ ২য় খন্ডে ৭০৯ নম্বর পাতায় রাজশাহী জেলার কনস্টেবল/৩২২ মানিক মিয়া ওরফে মুন্নু মিয়ার নাম অন্তর্ভুক্ত আছে। ওই অনুযায়ী ২০১৫ সালের ১৫ এপ্রিল রাজশাহী পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবীর প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন। ২০১৫ সালের জুলাই মাসে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বন্ধ হওয়ার পরে মানিক মিয়া ওরফে মুন্নু মিয়া উচ্চ আদালতে রিট করেন। হাইকোর্টের বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী এবং বিচারপতি রাজিক আল জলিল ২০১৬ সালের ১২ জুলাই মুন্নু মিয়ার পক্ষে রায় দেন। রায়ে ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে বকেয়াসহ ভাতা চালুর নির্দেশ দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ বিবাদীদের। যার হাইকোর্টের রায় নম্বর ২০৮৫/২০১৬। রায়ের পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্তকরণ ও সনদ প্রত্যয়নের জন্য ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তা বিভাগ পুলিশ শাখা-২ এর উপ-সচিব ফারজানা জেসমিন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর চিঠি পাঠান। যার স্মারক নম্বর ৪৪.০০.০০০০.০৯৫.১১.০০৫.১৯.৪১৬। কিন্তু এর পরও মুন্নু মিয়ার মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা চালু হয়নি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্নু মিয়া বলেন, যুদ্ধের সময় এমএজি ওসমানির প্রদত্ত সনদপত্র রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা গ্রন্থেও আমার নাম রয়েছে। সে অনুযায়ী আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাই এবং ভাতা পেতে শুরু করি। ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বশেষ পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাতা পেয়েছি। ভাতা বই নং ১৫০। সোনালী ব্যাংক বোয়ালমারী শাখায় আমার হিসাব নং ৩৪০৯৬৫৭৪।
তিনি বলেন, পরে ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে হঠাৎ করে আমার ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে হাইকোর্ট ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে আমার বকেয়াসহ ভাতা দেয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে নির্দেশ দেন। সে অনুযায়ী কাগজপত্র জমা দিয়ে আমি মন্ত্রণালয়ে ভাতা দেয়ার জন্য আবেদন করি। কিন্তু এখনো আমার ভাতা চালু হয়নি।
এ ব্যাপারে বোয়ালমারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা প্রকাশ কুমার বিশ্বাস জানান, তার কাগজপত্রসহ রায়ের কপি দেখেছি। এটা মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বিষয়। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে গেজেটভুক্ত করে নির্দেশনা দিলেই ভাতা চালু করে দেওয়া সম্ভব। বোয়ালমারী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদ্য সাবেক কমান্ডার অধ্যাপক আব্দুর রশিদ বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি মুন্নু মিয়াকে চিনি। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমানে তার সংসারের পরিস্থিতি ভালো নয়। খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। দ্রুত মুন্নু মিয়ার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালুর জোর দাবি জানান তিনি।