নাটোরে কাবিটা প্রকল্পে হরিলুট, বঞ্চিত দরিদ্র শ্রমিক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১:৪১ এএম, ৯ আগস্ট,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ১১:০১ এএম, ২০ নভেম্বর,
বুধবার,২০২৪
নাটোর সদর উপজেলায় কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) প্রকল্পে বড় ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারের গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির কর্মসূচি ব্যাহত হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সদর উপজেলার ৭১টি প্রকল্পে মোট এক কোটি ৯৪ লাখ ৪৩ হাজার ৪৮ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার। গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে শ্রমিক দিয়ে মাটি কেটে এসব প্রকল্পের কাজ করার বাধ্যবাধকতা থাকলে কথা থাকলেও, মেশিন দিয়ে সস্তায় মাটি কেটে সরকারের কোটি টাকা আত্মসাৎ করছেন এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সদস্যরা। প্রায় সবগুলো প্রকল্প কমিটি শ্রমিক দিয়ে কাজ করার মাস্টাররোল অফিসে জমা দিলেও, আসলে কাজ করছে এস্কেভেটর (স্থানীয়ভাবে ভেকু নামে পরিচিত) মেশিন দিয়ে। কিছু প্রকল্পে বাইরে থেকে মাটি কিনে নিয়ে এসে চলছে মাটির কাঁচা রাস্তা সংস্কার কাজ। এ ছাড়া, চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে এসব শেষ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও, কোথাও কোথাও কাজ শুরুই হয়েছে জুনের পরে। এসব অনিয়মের সবই হচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের চোখের সামনে। কিন্তু, কাউকেই কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এ প্রতিবেদক নাটোর সদর উপজেলার ৫৬টি প্রকল্প ঘুরে প্রত্যেকটিতে অনিয়ম এবং দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন। কাফুরিয়া ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের প্রকল্পটি এসব প্রকল্পের একটি। এ প্রকল্পের কাজে দরিদ্রদের সুযোগ দিয়ে তাদের কর্মসংস্থান তৈরির কথা ছিল। কিন্তু, স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বাইরে থেকে মাটি এনে জায়গা ভরাটের কাজ করা হচ্ছে এখানে। দরিদ্ররা কাজের কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না। এমনকি সরকারি টাকায় পুকুর বা জলাশয় ভরাট না করার নির্দেশনা থাকলেও, সেখানে কাবিটা প্রকল্পের আওতায় প্রকাশ্যে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। চাঁদপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং প্রকল্প কমিটির সদস্য আনন্দ বিশ্বাস বলেন, এটি পুরনো পুকুর ছিল। এখন এখানে মাটি ভরাট করে শিশুদের খেলার মাঠ তৈরি করা হচ্ছে। জানতে চাইলে প্রকল্পের সভাপতি পলাশ বারৈ বলেন, ৭০ ট্রাক মাটি ফেলে এখানে পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। আরও ৩০ ট্রাক মাটি ফেলতে হবে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তুষার নামের একজনকে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনিই টাকা নিয়ে পুকুর ভরাট করে দিচ্ছেন। পুকুর ভরাট করে খেলার মাঠ তৈরি হওয়াতে তারা খুশি বলে উল্লেখ করেন পলাশ। এ ব্যাপারে তুষারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি পুকুর ভরাট করে দিচ্ছি এবং টাকা নিচ্ছি। এটা ইউএনও স্যারের প্রজেক্ট। পিআইও স্যার ও ইউএনও স্যারের নির্দেশনায় কাজ চলছে। কমিটির লোকেরা আরও মাটি চাইলে দেবো। নাটোর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাহাঙ্গীর আলম অবশ্য বলেন, তিনি তুষার নামের কাউকে চেনেন না। পলাশ বারৈ ভুল করছেন। এ প্রকল্পে মাটি সরবরাহকারী আব্দুল গাফফার বলেন, এখানকার পুকুরে প্রতি ট্রাক মাটি ১২০০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। আরও ৩০ ট্রাক মাটি দিলেই পুকুর ভরাট হয়ে যাবে। আব্দুল গাফফারের হিসাব অনুযায়ী, ১০০ ট্রাক মাটি কিনে পুকুরটি ভরাট করতে খরচ হচ্ছে মাত্র এক লাখ ২০ হাজার টাকার টাকা। যদিও, এ প্রকল্পের জন্য তিন লাখ ২৮ হাজার টাকা বরাদ্দ ছিল।
অন্যদিকে, প্রকল্পের নথি অনুযায়ী, চন্দ্রকলা পূর্বপাড়া কেন্দ্রীয় গোরস্থান সংস্কারের আরেকটি প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু কত টাকা বরাদ্দ হয়েছে সেটা গ্রামবাসী বা গোরস্থান কমিটিও ঠিকভাবে জানে না। চন্দ্রকলা পূর্বপাড়া কেন্দ্রীয় গোরস্থান কমিটির সভাপতি মকসেদ আলী বলেন, আমরা জানতাম না প্রকল্পে আসলে কত টাকা বরাদ্দ আছে। প্রকল্প কমিটির সভাপতি আনোয়ার আমাদের এক লাখ টাকা বরাদ্দ বলে জানিয়েছেন। সেই হিসাবে তিনি আমাদের সাত হাজার দ্বিতীয় শ্রেণির ইট দিয়েছেন, যার মূল্য মাত্র ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু এখন আপনাদের মাধ্যমে জানতে পারলাম বরাদ্দ আসলে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে প্রকল্প কমিটির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকল্পের কাজ চলছে। গোরস্থান কমিটি যখন যা বলেছে দিয়েছি। আরও কাজ করা করলে টাকা দেয়া হবে। সূত্রধরপাড়া মাটির রাস্তা সংস্কার প্রকল্পেরও একই অবস্থা। জানতে চাইলে দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের ওয়ার্ড সদস্য এবং প্রকল্পটির সভাপতি হেলেনা বেগম বলেন, আমি শুধু কাগজেই সভাপতি। সই করা দিয়েই আমার কাজ শেষ। সব কাজ করেন অন্যরা। আমি জানিই না যে এ প্রকল্পে দুই লাখ ৮৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। একই ইউনিয়নের পশ্চিম হাগুরিয়া মাটির রাস্তা সংস্কার প্রকল্পেও দরিদ্র লোকজনের বদলে এস্কেভেটর (ভেকু) দিয়ে মাটি কেটে রাস্তার সংস্কার করা হয়েছে বলে জানান প্রকল্পের সভাপতি এবং স্থানীয় ইউপি সদস্য নাদিরুজ্জামান মৃধা।
তিনি বলেন, কাবিটা প্রকল্পে ইউনিয়ন পরিষদের যত কাজ হয়, সব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর শরীফ চৌহান নিজে করেন। আমি জড়িত নই। সভাপতির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ প্রকল্পে পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও, খরচ হয়েছে মাত্র দেড় লাখ টাকা। দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের নয় নম্বর ওয়ার্ডের খাল সংস্কার প্রকল্পেও দেখা গেছে অনিয়ম। ৩০ জুনের মধ্যে খাল সংস্কার শেষ হওয়ার কথা থাকলেও, কাজ শুরুই হয়েছে ১ জুলাই থেকে। তবে মজার বিষয় হচ্ছে, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) এক প্রতিবেদনটি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন, ৩০ জুনের মধ্যেই প্রকল্পের কাজের শতভাগ অগ্রগতি হয়েছে। এ প্রকল্পে পাঁচ লাখ ৮১ হাজার টাকা বরাদ্দ থাকলেও, শ্রমিকের বদলে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা খরচ করে পুরো টাকা আত্মসাৎ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এসব বিষয়ে দিঘাপতিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওমর শরীফ চৌহানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কয়েকটি প্রকল্পে কিছু দুর্নীতি হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি আমার দলের (আওয়ামী লীগ) বিশ্বস্ত নেতাকর্মী এবং কয়েকজন মেম্বারকে ইউনিয়ন পরিষদের সব কাজ দেখা শোনার দায়িত্ব দিয়ে রাখি। যাতে কাজগুলো ঠিকমত হয়। তা না হলে এসব প্রকল্পে দুর্নীতি করে ইউপি সদস্যরা সব আত্মসাৎ করে ফেলতেন। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কাজ শুরু করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু কাজের জন্য বরাদ্দের টাকা এখনও হাতে পাইনি। কিন্তু কর্মকর্তারা দ্রুত কাজ শেষ করার তাগিদ দিচ্ছেন। তাই দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য শ্রমিকের পরিবর্তে ভেকু দিয়ে খাল ও রাস্তা সংস্কার করা হচ্ছে। দিঘাপতিয়া ইউনিয়নের ছয় নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুমন আলী সর্দারের দাবি, করোনা পরিস্থিতির কারণে শ্রমিক না পাওয়ায় তারা পিআইওর অনুমতি নিয়ে ভেকু দিয়ে মাটি কেটেছেন। তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো নথিতে দরিদ্র শ্রমিকরাই মাটি কেটেছেন লেখা হয়েছে বলে স্বীকার করেন তিনি।
সুমন বলেন, পিআইও স্যারের সঙ্গে কথা বলেই আমরা ভেকু দিয়ে মাটি কেটেছি। তবে মাস্টার রোল জমা দিয়েছি শ্রমিকের। করোনার কারণে শ্রমিক পাওয়া যায়নি। সে কারণে আমি পিআইওকে অনুরোধ করেছি, পরবর্তীতে যেন সরকার ভেকু দিয়ে মাটি কাটার অনুমতি দেয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে।
পিআইও বলেছেন, তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলবেন। তবে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওমর খৈয়াম কোনো দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন।
তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে কিছু প্রকল্পে মেশিন দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। তবে কাবিটার টাকায় কোনো পুকুর ভরাট করা হয়নি। চাঁদপুরের প্রকল্পে পুকুর নয়, ডোবা ভরাট করা হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে নাটোর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, কাবিটা প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হলে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।